স্যানাটোরিয়াম
কী এক অসুখ আজ আমাদের অস্থিমজ্জায় বেঁধেছে বাসা।
সত্তায় ধরেছে ঘুণ, এতদিনে জেনে গেছি, বস্তুত এ রোগ
সহজে সারার নয়। চৈতন্যের এলাকায় এ কেমন ওলটপালট
চলছে সর্বদা বেলা-অবেলায়-দেখি, সব বৃক্ষ খর বানে
যাচ্ছে ভেসে শিকড় সমেত; পাখিগুলো মুখ থুবড়ে প’ড়ে আছে
কাদা জলে। একরাশ পচে-যাওয়া পাতা, কতিপয় ভাঙা ডাল,
একদা যা ছিল বৃক্ষ তার করুণ ভগ্নাংশ, মৃত্তিকাস্থ;
আমি সেই বৃক্ষটিকে বৃক্ষের চেয়েও বেশি ঋদ্ধ কিছু ভাবতাম।
দীঘল ঘোমটা টানা বউ, বরযাত্রী, সাপুড়ে, জুয়াড়ী আর
ভবঘুরে ধোপা আর নব্য যুবা ইত্যাদি সমেত এক সাঁকো
কোথায় তলিয়ে যায় অকস্মাৎ। দেবতুল্য মানুষের মুখ
কুকুরের অবয়বে হতেছে বিলীন। বার বার অনুরূপ
দৃশ্যাবলি ওঠে ভেসে চতুর্দিকে-এ রোগের এই তো লক্ষণ।
আমি তো কাদায় আজ ভীষণ ডুবিয়ে পদযুগ কী ব্যাপক
শূন্যতায় চেয়ে থাকি আর আলো বিশ্বাসঘাতক বলে খল
অন্ধকারে মশানের অভ্যন্তরে থেকে যাই, মাথায় আগুন
নিয়ে ঘুরি, পোড়া কাঠ অথবা করোটি বেজে ওঠে পায়ে লেগে
ইতস্তত, ফিরি শোক গাঁথা হয়ে; ব্যাপ্ত অস্থিমজ্জায় বীজাণু।
অসুখ সারাব বলে যেতে চাই নিরঞ্জন স্যানাটোরিয়ামে।
অথচ পাহাড়ে কিংবা নদীতীরে কোনো স্যানাটোরিয়াম নেই।
হে সুদীপ্তা মোহিনী আমার
কী করে তোমাকে ভুলি? সৌন্দর্যের মতো আছ ব্যেপে
হৃদয়ে আমার।
আমার মন্ময় ঘরে দেখি
তোমার চকিত চাওয়া, হাত নাড়া, হাঁটুতে থুতনি রেখে একা
ব’সে-থাকা, ভাসমান মনখারাপের মেঘমালা
এদিক ওদিক।
তোমার চুলের কালো উদ্দাম প্রান্তরে স্বপ্নবৎ
রৌদ্র আর ছায়ার জেব্রারা ছোটে অবিরাম, দেখি,
সুখের যৌবন ছুঁয়ে ব’সে আছ বিষাদের সঘন শৈশবে।
কখনো নদীর বাঁকে, বনে, দ্বীপে, কখনো পাহাড়ে,
কখনো বা কার্পেটের মতন উপত্যকায় খুঁজেছি তোমার
নিভৃত দৈহিক রেখা। দেখেছি পাথরে, বাদ্যযন্ত্রে
অকস্মাৎ তোমারই প্রতিমা।
পাখি, মাছ কিংবা সুপুরির গাছ, সারি সারি, চোখে
পড়লেই মনে পড়ে তোমার সত্তার দৃশ্যাবলি,
স্বদেশের মুখ আর তোমার সজীব প্রতিকৃতি
অভিন্ন জেনেছি।
স্বদেশে আমার প্রিয়জনদের কেউ কেউ পাগলাগারদে
এখন বইয়ে দিচ্ছে বেলা এলোমেলো
চুলে বিলি কেটে,
নিজের ছায়ার সঙ্গে কথা বলে আঙুলের ফাঁকে
ওরা সূর্যোদয় দেখে ওঠে, কেউ কেউ কয়েদখানায়
ব’সে সূর্যাস্তের রঙে দ্যাখে ডুবছে শৌখিন খাট।
তোমার জন্যেই
আমাকে গাইতে হবে গান আজও আগেকার মতো,
করতে হবে জড়ো কবিতার জাগর ভগ্নাংশগুলো,
যেমন প্লাবন চলে গেলে কৃষক কুড়িয়ে নেয় শস্যকণা তার।
তোমার জন্যেই
দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ঘরের চৌকাঠ ধরে এই অবেলায়।
যেমন ক্ষুধার্ত লোক চায় ঈষদুষ্ণ স্বাদু রুটি,
যেমন নিঃসঙ্গ অন্ধ চায় চোখের পবিত্র জ্যোতি,
যেমন বিচ্ছিন্ন পাখি চায় মৃতা পক্ষিণীর প্রাণ,
যেমন কর্মিষ্ঠ হাত চায় কাজ প্রহরে প্রহরে,
যেমন বিদেশী চায় পরবাসে নিষ্কণ্টক একটি আশ্রয়,
যেমন বিধ্বস্ত রণক্ষেত্রে ক্লান্ত বিবর্ণ সৈনিক চায় শান্তি,
যেমন ভরাট কোনো স্বপ্ন চায় অনিদ্রার রোগী,
যেমন সাধক চায় সর্বক্ষণ ধ্যানের মুহূর্ত,
আমিও তোমাকে তেম্নি চাই
হে সুদীপ্তা মোহিনী আমার।
তুমি যে আমার অলংকৃত কারাগার
এবং তুমিই
আমার রৌদ্রের ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময় এক অবাধ প্রান্তর।