শক্র
বস্তুত তাদেরই একজন আমি যারা মধ্যরাতে
অভ্যাসবশত
একাকী ঘুমন্ত হাঁটে বারান্দায়, ছাদের কিনারে
ভীষণ বিপজ্জনকভাবে চলে গিয়েও আবার ফিরে আসে
স্বকীয় নিঃসঙ্গতায়। দরজা ককিয়ে উঠলেই
আমি মেরুমণ্ডলের কেউ; অকস্মাৎ কী একটা চোখে পড়ে, ছমছমে কিছু,
রোমকূপগুলো কদম রেণুর মতো হয়ে যায়।
বারান্দায় ছায়াচ্ছন্ন কোণে, ভাবি, কেউ
ওৎ পেতে নেই তো আবার?
ভোজালি উঁচিয়ে কেউ আসছে কি দেয়াল টপকে?
বারংবার মনে হয় শুধু
ঘরে যেন কার রাগী নিঃশ্বাস বিষম হিসহিস
করে সারাক্ষণ। কালো রাজা শবের ওপর ব’সে
বিষণ্ন করছে পান প্রাচীন কারণ; সে কি এতেবারের কাবিল?
না, পথে যাবো না, গেলে শরীরে প্রচুর অস্ত্রাঘাত
নিয়ে ফিরতে হবে কিংবা মর্গে হবে ঠাঁই।
কী করি? কী করি?
চতুর্দিকে সমমুখো অরি, তবে কোন দিকে যাই?
কে আমার শক্র বোঝা দায়; কাছে দূরে, সবাইকে
শক্রতায় অত্যন্ত তুখোড়া মনে হয়। পড়শির
সঙ্গে দেখা হলে তাকে জানাই না হেসে অভিবাদন কখনো।
এমনকি সুহৃদের হাতেও, আমার কী-যে হয়, সূতীক্ষ্ণ কিরিচ
ঝলসে উঠতে দেখি ছায়ানাট্যে, দেখি,
সে আমার খণ্ড খণ্ড হৃৎপিণ্ডের শোভা দেখে তোফা
মেতে ওঠে জয়োল্লাসে। নাকি যার চোখের পাতায়
ভুরুর সাঁকোয় বাঁচি, দুলে উঠি তন্বী বুকের স্পন্দনে, যার
পদধ্বনি শিরায় জোয়ার আনে ফসফরাসের,
আমার চরম শক্র সে-ই?
যে আমার টুঁটি চেপে ধরে অ্যালসেশিয়ানের মতো
পুরোনো আক্রোশে, যে আমার বুকে কিরিচ ঠেকিয়ে
দেয়ালের দিকে নিয়ে যায় বার-বার, যার মত্ত আচরণে
সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাই, সে-ই তো আমার শক্র, সবচেয়ে
ক্রূর শক্র, ধাম যা-ই হোক, নাম তার শামসুর রাহমান।
শান্তির এলাকা
তবু, তবু, ধন্যবাদ জানাই তোমাকে, সবাইকে।
যখনই বাড়াই হাত হাতের সান্নিধ্যে,
শীতের সাপের স্পর্শ পাই কিংবা মনে হয় কোনো মাঘ-নিশীথের
জানালা ছুঁয়েছি ভুল করে,
যাকে আলিঙ্গন করতে যাই তার ছায়াও থাকে না কাছে।
যখন কারুর সঙ্গে কথা বলবার পুষ্পল স্পৃহায়
জলতরঙ্গের মতো বেজে ওঠে আমার ব্যাকুল সত্তা, আমি
কথোপকথনের লোভে প্রতীক্ষায় থাকি,
কখনো পাই না সাড়া, যেন পাথরের সঙ্গে জুড়েছি আলাপ।
বার-বার ক্ষেতে গিয়ে দেখি
প্রতিবার দেরি করে ফেলেছি বিষম,
আমার হাতের বীজ হাতেই বেবাক থেকে যায়, হয় নাকো বোনা।
তবু, তবু, ধন্যবাদ জানাই তোমাকে, সবাইকে।
সকাল বেলায় আমি দাড়ি কাটার সময় দেখি,
বিবর্ণ সংবাদপত্রে জাতিসংঘ ক্লিষ্ট নপুংসকের মতন
উবু হয়ে ব’সে আছে;
দেখি মুক্তিযুদ্ধের পুরোনো ফটোগুলো নিষ্পলক;
জানালায় এক পাল লাল পিঁপড়ে একটি পোকার
শব বয়ে নিয়ে যাচ্ছে আস্তে-সুস্থে যৌথ
ভোজের উৎসবে।
চকিত সে কার মুখ নিয়ে এলো রাত্রিময় জানালা এবং
নিঃসঙ্গতা, যা আমি সহজে ছুঁতে পারি?
কোথায়ও এমন জায়গা নেই এতটুকু, যেখানে অষ্টপ্রহর
আশান্তির ধেই ধেই নৃত্য নেই, নেই বিরোধের
কাড়া-নাকাড়ার হট্ররোল।
আমার ভেতরে পাখি-পাখিনীর মদির চঞ্চুতে
চঞ্চু রাখে, জেগে থাকে পোকামাকড়ের
প্রচ্ছন্ন সমাজ,
আমার ভেতরে সাদা খরগোশ হেসে খেলে বেড়ায় কেমন
ঘাসে ঘাসে, খড়ের গাদায়;
বিভিন্ন মরাল ওড়ে একটি মরাল হয়ে আমার ভেতর।
অশান্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমার
হৃদয়কে আজ শান্তির এলাকা ঘোষণা করছি।
সুরের আড়ালে
আমার ক’জন নিত্য জুটে যাই নিঃসঙ্গে প্রাণের
হু হু টানে কোথাও না কোথাও, যেমন ক’টি নদী
মেশে মোহনায়। কথা বলা, খুব রাত্তির অবধি
চাঁদার চায়ের পাট চলে যথারীতি, কখনোবা
নৈঃশব্দ ফলের মতো পেকে ওঠে, কখনো গানের
গুঞ্জনে রূপান্তরিত ঘর, কী রহস্যময় শোভা।
নিপুণ গায়ক নয় বন্ধু, তবু মাঝে মাঝে তার
হৃদয়ের অত্যন্ত নির্জন কূপ থেকে উঠে আসে
সুর, হাঁস-শাবকের অপটু ওড়ার মতো, আর
আমরা প্রবেশ করি যে যার ভেতরে অগোচরে।
বন্ধুর গলায় সুর নর্তকীর ভঙ্গিমায় ভাসে
যেন, কখনোবা তালভঙ্গ হয়, কিন্তু সেই ঘ এ
সুরের আড়ালে জেগে ওঠে সুদূরতা, দুঃখ শোক-
ছাওয়া দৃশ্যাবলি, কারো চুলে, একা-বসে-থাকা, চোখ।
স্বীকারোক্তি
উত্তরচল্লিশ আমি; পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি কিংবা
তারও কম উচ্চতা আমার। চুলের শ্বেত পতাকার
কী বাহার ইদানীং নানান ব্যাধির গলাগলি
এ শরীরে এবং আয়ুর ভেলা নিত্য কম্পমান।
তা’বলে ছাড়িনি হাল, নৈরাশ্যের পংক্তি অনর্গল
করি না আবৃত্তি যত্রতত্র; বরং চরম রৌদ্রে
অকুণ্ঠ বেরিয়ে পড়ি বার বার, নিজেকে জড়াই
উদার অমিত্রাক্ষরে জীবনের, কড়ি ও কোমলে।
যখন বাড়ায় ঠোঁট নিঃসঙ্গতা, আমিও চুম্বন
করি তাকে, নিই শুষে অবিরাম অস্তিত্বের রুক্ষ
প্রান্তরের প্রতিধ্বনিগুলি। অগোচরে অনুভূতি
শেফালির মতো ভেজে গোপন শিশিরে চিরদিন।
লুকিয়ে কী লাভ আর? প্রায়শ ভাঁড়ারে পড়ে টান,
অথচ স্বপ্নের নকশি পিঠে প্রত্যহ আহার করি।
কবিত্বের উৎসে দোলে স্বপ্ন কিবা দুঃস্বপ্নের ছায়া,
সুখের পাখির ডাক শুনি শুয়ে দুঃখের ছায়ায়।
নিজেই অবাক মানি আজকাল, কী নির্লজ্জ আমি।
জনসমক্ষেই তুলি আমার মনের চিটচিটে
খুশ্কি ইতস্তত আর ব্যক্তিগত রাখি না কিছুই-
দিয়েছি প্রকাশ্যে মেলে অন্তর্গত সব ডালপালা।
আমার প্রিয়ার চোখ, চুল, বুক, হৃৎস্পন্দনের
ঢেউ পরিচিত অনেকের কাছে আমারই কৃপায়।
নিজেকে রেখেছি নগ্ন করে সাধারণ্যে আজীবন,
বিনিময়ে লভ্য কিছু খ্যাতি আর মুদ্রা কতিপয়।