মাইক
ভেবেছেন আপনারা আমাকে এভাবে কোণঠাসা
করে রাখবেন চিরকাল? ক্ষিপ্র অর্ধচন্দ্র দিয়ে
সরিয়ে দিলেই আমি সুড়সুড় লেজটি গুটিয়ে
সটকে পড়ব স্টেজ থেকে? মাইরি জবর খাসা
লোক আপনারা, এ আপদ গেলে, জিলিপি-বাতাসা
বিলোবেন গণ্ডা গণ্ডা, আছে জানা। ইনিয়ে বিনিয়ে
জপিয়েছেন যা এই শ্রোতাদের ত্র্যাদ্দিন তা নিয়ে
তৃপ্ত থাকা দাম, আর কত খেলবেন ভুল পাশা?
উইংস-এর আড়াল থেকেই ফিরে যাব বার বার
তা হবে না, মাইকটা ছেড়ে দিন, মানে মানে স’রে
দাঁড়ান বলছি, নইলে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে ঘোর।
অধুনা আমার কণ্ঠস্বরে মর্চে ধরে গেছে, যার
মানে, আমি এতদিন চুপচাপ নিজের ফোকরে
ছিলাম, আনব কণ্ঠে আজ দীপ্র জোয়ারের তোড়।
যে কেউ ডাক দিক
বন্ধ ঘরে প্রতিদিন প্রতীক্ষার ভার বয়ে চলি; অন্ধকারে
সর্বক্ষণ তার পদধ্বনির দিকেই কান পেতে রাখি আর
নিদ্রার মিতালি করি অস্বীকার, ভয়
যদি সে দরজা থেকেই নিঃশব্দে অভ্যর্থনাহীন
চলে যায়। বার-বার দরজার দিকে ছুটে যাই,
কিন্তু তার দেখা নেই আমার এই নিবাসে কোথাও।
মধ্যরাতে অকস্মাৎ একটি গোলাপ,
আমার নিভৃত ঘরে ভাসমান, যেন ব্যালেরিনা;
বলল, ‘কতকাল
তাকাও না ফিরেও আমার দিকে, তাই
সকল বন্ধন ছিঁড়ে স্বয়ম্বরা হলাম এখন।
গোলাপি সত্তায় তার উত্তর বুলোই
হৃদয়ে তোমার ক্রূর কাঁটা রক্ত ঝরায় কেবলি।
তোমাকে ডাকিনি আমি, মিছেমিছি তুমি কেন এলে?
‘শুধু আমি নই’, বলল সে খণ্ডিতা নারীর মতো,
‘নক্ষত্র, চন্দনা পাখি, নদীর কিনার,
এবং জ্যোৎস্নার মোজাইক
সবাই ডাকছে
তোমাকে বাইরে, কতকাল তুমি এই বন্ধ ঘরে
ব’সে আছ, উদাসীন। নিঃসঙ্গতা তোমাকে করাচ্ছে
তুর্কি স্নান।
আমি আজ অন্য কারো ডাকে সাড়া দিতে
ঘুম গুম খুন করে বসে নেই। দোহাই তোমার,
চলে যাও, আমি শুধু একটি পদধ্বনির জন্যে
প্রতীক্ষায় আছি।
দরজায় টোকা পড়ল কি ফের? যদি গিয়ে তাকে
না দেখি সে ভয়ে দরজাটা আর খোলাই হয় না।
যে খেলা আমার সঙ্গে
যে খেলা আমার সঙ্গে খেলে যাচ্ছ অবলীলাক্রমে
বাস্তবিক আমি তার নিয়ম জানি না। অতএব
এ খেলায় কোনো দিন আমার জেতার আশা নেই।
আমি যে তোমার কাছে প্রথম থেকেই পরাভূত
তা জেনেও তুমি খুব নেড়েচেড়ে ফেলছ দান, যেন
বুঝতে দেবে না এই অসম প্রতিপক্ষকে, কার
জিৎ কার হার হবে কোথায় কখন। বোকা পাখি
ধরেছ অনেক তুমি চতুর চালের হের ফেরে-
আমিও পড়েছি ধরা। তবু এই খেলা যতক্ষণ
পারি খেলে যাব, হায়, বাজি রেখে সর্বস্ব আমার।
যেন অর্ফিয়ুস
বিস্ফোরণে ভয়ংকর ফুল হিরোশিমা আর মায়া
সভ্যতার পাথুরে নৈঃশব্দ
আমাদের চতুষ্পার্শ্বে অগণিত হাড়
পচা মাংসে পোকার মিছিল
কাদায় খণ্ডিত কত বেনামি শরীর ইতস্তত
ভিয়েতনামে কি বাংলাদেশে
জীর্ণ জুতো পদহীন এই পটভূমি
তুমি কি দেখতে পাচ্ছ সে আকাশ যেখানে সর্বদা
সূর্যাস্তের মূক কলরোল
তুমি কি দেখতে পাচ্ছ দুই
বিপরীত দিকে দুটি হাত
পড়ে আছে মধ্যে ভস্মস্তূপ রুক্ষ পথে
প্রান্তরে বিষণ্ন ক্লান্ত উদ্বাস্তুর ভিড় বিশ্বময়
হঠাৎ কোত্থেকে এক বিশীর্ণ বালক
মৃত্যুর মুখোশ এঁটে মাতে মূকাভিনয়ে এখানে
নৈঃসঙ্গের হুহু ঠোঁট ঘেঁষে কত লোক
শূন্যতায় এলোমেলো করে বিচরণ
তাদের ললাটে ঝোলে দুঃখের ফলক
আমরা দু’জন আছি পাশাপাশি যেমন দু’ফোটা
জল থাকে বেদনার্ত দুটি চোখে এ নৈরাশ্যে
আমি রাখি ব্যগ্র ওষ্ঠ থরোথরো অধরে তোমার
সে চুম্বন থেকে জন্ম নেয় অলৌকিক পদ্ধতিতে
অজস্র নক্ষত্র
এবং জীবন ওঠে নেচে বাঁশি হাতে ভস্মের আড়াল থেকে
নতুন গোলাপ নিয়ে যেন অর্ফিয়ুস
রক্তে কখন
পুষ্পমদির রক্তে কখন লক্ষ পাখি ডেকে ওঠে,
চমকে উঠি বনতরাসে।
এই নাগরিক ফ্ল্যাটে হঠাৎ কেন বনের দীর্ঘ ছায়া
এমন করে দিচ্ছে হানা অবিরত?
মনের ভেতর ঝোপের পাতা সুদূর কোনো
পিতামহের কণ্ঠস্বরে
বলে কথা,
বাকল-পরা দূরবাসিনী, ভাষাহীনা বন্যপশুর
চর্বি-গলা আলোয় হাসে।
ভব্য আমি ট্রাউজারে আর ঝোপকামিজে।
কথায় কেমন হিসেব-টিসেব থাকে গাঁথা;
পথের মোড়ে ক্ষণেক দাঁড়াই,
চেনা-জানা কাউকে দেখে মৃদু হেসে
হাতটি বাড়াই, যেন হঠাৎ
ভাড়া-করা উষ্ণতাকে জিইয়ে রেখে,
সিগারেটের ভস্ম ঝরে যথারীতি।
কিন্তু তবু কখন যেন বেলাবেলি
কী ঘটে যায়,
অচেনা কেউ গৃহহারা
সামনে দাঁড়ায় মুখোমুখি-
রক্ত তখন ‘হে প্রবাসী কখন এলে?’-
বলেই ওহো খলখলিয়ে
হেসে ওঠে।
আমাকে সেই পান্থ কেবল বনবাদাড়ে
টেনে বেড়ায়।
খানাখন্দে পড়তে পড়তে সামলে উঠি।
দৈবক্রমে।
হায়রে তবু মনের বিষম অন্ধকারে
দৈব টৈব মারে উঁকি।
এমন ধন্দে কে ছড়াল হাতের আলো?
কোন সে পান্থ সতর্কতায় ঝলমল?
অবাক-মানা চক্ষু মেলে দেখি এসে দাঁড়িয়ে আছে মুখোমুখি
রুক্ষ পথে নগ্ন পায়ে
ভালবাসা।
রঙিন টালি ইত্যাদি
একটু আগে কোথায় ছিলে? কোন নিবাসে?
নিছাদ ঘরে আস্তে-সুস্থে
বিঘৎ বিঘৎ জ্যোৎস্না যেমন
ভাসতে থাকে
স্মৃতির মতো একা একা,
তেমনি তুমি কোথাও বুঝি লুকিয়েছিলে।
টালি টালি, রঙিন টালি, সব টালিতে
রৌদ্রছায়া লেপ্টে থাকে,
হয়তো কিছু স্বপ্ন থাকে
ফাঁক-ফোকরে
তুমি কি সেই স্বপ্ন হয়ে
টালির রঙে মিশে ছিলে খুব আড়ালে?
রৌদ্ররাঙা মেঘে ছিলে? কিংবা ছিলে
দেশান্তরী পাখির বুকে?
হয়তো ছিলে আতর-হারা
শিশির ভেতর
কিংবা কোনো টেরাকোটায়
সুদূরতার সঙ্গী হয়ে মগ্ন ছিলে।
ত্র্যানেমিয়ায় কাতর কোনো নারীর চোখে,
জুয়োয় বন্দি একলা লোকের
উজাড় হা-হা বুক-পকেটে,
শুকনো ঠোঁটে
ঘুমিয়ে ছিলে নির্জনতায় হয়তো তুমি।
ট্যাংকে-বসা নানা রঙের পায়রাগুলো
উষ্ণ-কোমল পাখা থেকে
অনেক দামি বীজের মতো
তোমায় বুঝি
ঝরিয়ে দিল এই বিজনে।
পেলাম তোমায় আমার ত্বকে, শিরায় শিরায়।
একটু আগে ছিল না তো। কেমন করে
এই নিমেষে হলে তুমি?
দৈব দয়ায়? নাকি চতুর
শয়তানেরই
প্ররোচনায় জন্ম নিলে
অন্তরালে মূক কিশোরীর স্তনের মতো?
এই প্রহরে তুমি হলে আমার সাধের
অলৌকিকের ছোঁয়া-লাগা।
কয়েক কাঠা জমি জিরেত।
ভেতর ঘরের
জাদুকরের হাতের নড়ায়
উঠল সেজে থরে থরে রঙিন টালি।