বাড়ি ফেরা
বাড়ি ফিরতে রোজ আমি দেরি করে ফেলি,
বড় বেশি দেরি করে ফেলি।
চেনা রাস্তা অলিগলি যতই জটিল হোক, পথ
ভুল করবার কথা নয়, নয় কখনো নিজের বাড়ি
মনে করে অন্য কারো দরজার কড়া নাড়া অস্থির ব্যাকুল।
তবু বাড়ি ফিরতে রোজ দেরি করে ফেলি,
বড় বেশি দেরি করে ফেলি।
কোনো পিছুটান নেই, সূর্যাস্ত দেখার লোভে কোনো
নদীতীরে অথবা টিলায় দাঁড়ানোর অবসর
আজকাল মেলা ভার। পার্কে ব’সে কিংবা ঘাসে শুয়ে
ভাবনা বিলাসে মেতে উঠবো যে, তারও জো নেই সম্প্রতি, তবু
বাড়ি ফিরতে রোজ আমি দেরি করে ফেলি,
বড় বেশি দেরি করে ফেলি।
সে কবে আড্ডার পাট গেছে চুকে, ইদানীং মতান্তর
দাঁত-নখ-বের-করা মনান্তরে বদলে যায় খুব সহজেই,
এমনকি বন্ধুর কাছেও মন খোলা দায়। বার বার
দায়সারা বাক্যালাপে শেষ হয় চতুর আসর।
মাঝে-মধ্যে আমি নিজে কী দারুণ খল হয়ে যাই;
ইতরামি শুঁয়ো পোকা যেন, আমার ভেতর থেকে
ক্রমাগত অতিষ্ঠ বেরিয়ে আসে ভব্যতার পলেস্তারা ঠেলে।
প্রত্যেকে কপট ভেবে প্রত্যেককে কেবলি বিচ্ছিন্ন
হয়ে যাই ঝরে-পড়া পাখিদের মতো দিগ্ধিদিক।
এ কেমন সময় করছে গ্রাস দ্রুত আমাদের?
আড্ডার কোটরে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শুনে প্রতিদিন
কাটে না আমার বেলা কিংবা কোনো মোহিনীর ডাকে
তাকাই না ফিরে; ইঁদুর-দৌড়েরও আমি কেউ নই,
তবু বাড়ি ফিরতে রোজ দেরি করে ফেলি,
বড় বেশি দেরি করে ফেলি।
বাড়ি ফিরে দেখি, সেখানে কোথাও কোনো
ঘরবাড়ি নেই; অন্ধকারে হাসে বুভুক্ষু শূন্যতা।
বিন্যাসের সপক্ষে
তোমার মতোই আমি বিন্যাসের সপক্ষে এখনও।
মানুষের স্বরচিত মূর্তি, খিলানের কারুকাজ
কিংবা কোনো গাঢ় চতুর্দশপদী-যা কিছু প্রসূন
ঐকান্তিক বিন্যাসের আমার আনন্দ তাতে আজও
অবাধ অটুট; কিন্তু মাঝে মাঝে অনেক কিছুই
অবিন্যস্ত হয়ে যায়, অকস্মাৎ এলোমেলো।
মানুষ সঙ্গমকালে বিস্মৃতি লালন করে বুঝি
অগোচরে সারাক্ষণ। বেশবাস প’ড়ে থাকে কোণে,
অগোছাল, সুস্মিত সুগোল টিপ অলক্ষ্যে কখন
কপালে ছড়িয়ে যায়। বুকে, নাভিমূলে, থুতনিতে
অথবা গ্রীবায় লেগে থাকে থরো থরো চুম্বনের
ম্যাজেন্টা স্বাক্ষর, সেই দাগ ক্রমান্বয়ে নীল হয়,
তবে কি মানুষ ওষ্ঠে পুষে রাখে বিষ অন্তরালে?
সংগমের কাল শেষ হলে আমরা দুজন একা
দু’দিকে বিচ্ছিন্ন প’ড়ে থাকি, অবিন্যস্ত, যেন তীব্র
বিস্ফোরণ হেতু দ্বিখণ্ডিত একটি প্রধান সেতু।
অথচ কেমন সুবিন্যস্ত রয় আমাদের প্রেম।
বুদ্ধদেব বসুর প্রতি
বারবার স্বেচ্ছাচারী জ্যোৎস্না কেটে গিয়েছেন হেঁটে
সম্পূর্ণ একাকী, সঙ্গী মুক্তবোধ। চোখে নাগরিক
দৃশ্যাবলি গেঁথে নস্টালজিয়ায় মেদুর গলায়
কবিতার ডাকনাম ধরে ডেকেছেন কী ব্যাকুল।
জলের গভীরে ব্যালে উজ্জ্বল মাছের, দেখে দেখে
কেটেছে অনেক বেলা আপনার। সে-ও এক খেলা,
যা’ নেয় গোপনে শুষে মেদমজ্জা, জীবনের মধু।
জলের ঈষৎ নড়া অথবা ফাৎনার ডুব দেখে
বুক করত ধুক পুক। জল ভাগ করে আচমকা
কখনো গিয়েছে বেঁকে ছিপ মধ্যরাতে, তুলেছেন
কত মাছ একান্ত শিল্পিত প্রক্রিয়ায়; মেরুদণ্ডে
গিয়েছে শিরশিরে স্রোত বয়ে অগোচরে কখনোবা।
সহসা আপনাকেই নিল গেঁথে অদৃশ্য বড়শিতে
আরেক খেলায় মেতে অন্য একজন, কায়াহীন,
অথচ কী শঠ, ভয়ংকর। যখন লুকিয়ে ছিল
সে অদূরে বারান্দায় কিংবা বাথরুমে অন্ধকারে,
তখন না-লেখা কবিতার পংক্তিমালা আপনাকে
ঘিরে ধরেছিল বুঝি জোনাকির মতো, হয়তোবা
লন্ড্রির রঙিন মেমো, কবিতার পাণ্ডুলিপি বুকে
করছিল গলাগলি নাকি সুধীন্দ্রনাথের স্মৃতি
অকস্মাৎ জেগে উঠেছিল দীপ্র, যেমন ঢেউয়ের
অন্তরালে দ্বীপ, হয়তো অসমাপ্ত বাক্য সে মুহূর্তে
মগজের কোষে কোষে হয়েছে মায়াবী প্রতিধ্বনি।
শব্দেই আমরা বাঁচি এবং শব্দের মৃগয়ায়।
আপনি শিখিয়েছেন পরিশ্রমী হতে অবিরাম।
অফলা সময় আসে সকলেই মাঝে মাঝে, তাই
থাকি অপেক্ষায় সর্বক্ষণ। যতই যাই না কেন দূরে
অচেনা স্রোতের টানে ভাসিয়ে আমার জলযান।
হাতে রাখি আপনার কম্পাসের কাঁটা; ঝড়ে চার্ট
কখন গিয়েছে উড়ে, চুলে চোখে-মুখে রুক্ষ নুন,
অস্পষ্ট দিগন্তে দেখি বৌদ্ধ মুখ। আপনার ঋণ
যেন জন্মদাগ, কিছুতেই মুছবে না কোনো দিন।
নিদ্রাতুর আঙুলের ফাঁক থেকে কখনো হঠাৎ
সিগারেট খ’সে গেলে চম্কে উঠে দেখি মধ্যরাতে-
স্মৃতির মতন এক অনুপম স্বপ্নিল বারান্দা
থাকে পড়ে অতরালে অন্তহীন, কবি নেই তার।
বেলুন বেলুন
দৌড়ে যায় পথের সে বালক
ডাইনে বাঁয়ে ক্লান্তিহীন একা;
রৌদ্রে তার শরীর চমকায়,
গ্রীবায় স্বেদ, বাতাসে ওড়ে চুল।
বিরামহীন ছুটছে সে বালক,
দৃষ্টি শুধু সামনে লীলায়িত।
রক্তের নাচে কী-যে অস্থিরতা,
রঙিন এক বেলুন তার হাতে।
চোখের কোণে চড়ুইভাতি আর
স্বপ্নে দেখা সুদূর হ্রদ নিয়ে
ছুটছে শুধু, ছুটছে সে বালক।
অবাক মানে শহুরে সব লোক।
ছায়ার দিকে দৃষ্টি নেই, কড়া
রোদের তাপে চামড়া খরশান।
এ রং শুধু আফ্রিকার কিবা
সূর্য-সেঁকা তীব্র এশিয়ার।
কেউ না কেউ হাত বাড়াবে বলে
বেলুন তার আড়াল করে ছোটে,
দিগ্ধিদিক; পেছনে লোকালয়।
কিন্তু একি পাহাড় ভয়ানক!
যাচ্ছে ডুবে যাচ্ছে সে বালক
কেমন দ্রুত পাহাড়ে অস্ত্রের।
কোথাও আর চিহ্ন নেই তার,
শূন্যে একা বেলুন ওড়ে দূরে।