মুখিয়ে রয়েছে
[সালেহ চৌধুরী বন্ধুবরেষু]
মধ্যরাতে একা রিক্শা থেকে নেমে দেখি, কী আশ্চর্য,
মুখিয়ে রয়েছে চির চেনা বাড়ি, যেন
আমাকে চেনে না, যেন তার বাসিন্দার ঘ্রাণ নেই
আমার শরীরে।
দরজার কড়া বাজাবার
সাহস হলো না, কিছুক্ষণ নিজের বাসার কাছে চুপচাপ
অচেনা লোকের মতো অস্বস্তির ঘামে
নেয়ে উঠি, একবার সরে যাই, ফিরে আসি ফের।
আমার এ আচরণ
নিজের কাছেই কী রকম খাপছাড়া
লাগে, দেখি অকস্মাৎ মাটি ফুঁড়ে আঁধারে লাফিয়ে ওঠে তিন
মাথা-অলা নরকের দ্বারের কুকুর।
চোখের পাতার স্তূপ থেকে বাহু তুলে
উঠে আসে একটি কুমারী,
তারপর প্রবাল রঙের শাড়ি খুলে হেঁটে হেঁটে চলে যায়
ধারারো নখের ঝোপঝাড়ে।
ক্ষুধারও আঙুল আছে, আছে নোংরা নখ,
যা উপড়ে আনে নাড়িভুঁড়ি, বলে তিনজন ঢ্যাঙা, প্রায় নাঙা,
ভিখারী ছায়ার মতো দাঁড়ায় আমার
কাছ ঘেঁষে, মাথা তোলে নরকের দ্বারের কুকুর।
বাড়িটার চোখ ফেটে পানি পড়ে, রক্ত ঝরে, বুড়ো
ভিখারীরা রক্ত চেটে খায়,
কে যেন বিছিয়ে দ্যায় পারস্য গালিচা,
গালিচায় হেঁটে যেতে গিয়ে অন্ধ পাখির ধরনের উড়ে যাই।
যখন কখনো চণ্ডীদাস
যখন কখনো চণ্ডীদাস মধ্যরাতে নক্ষত্রের
দিকে তাকাতেন, মনে হয়, তখন দু’চোখ তাঁর
বাষ্পময় হয়ে উঠতো, অকস্মাৎ নামহীন ভয়
করতো দখল তাঁকে; হয়তো নিঃসীম শূন্যতা দেখে
ভূমণ্ডলে, নভোমগুলের স্তরে স্তরে, অস্তিত্বের
তন্তজালে, শিহরিত হতেন নিজের অগোচরে।
অথবা তখন দেখতেন প্রথম কদম ফুলে
ক্ষয়চিহ্ন, রজকিনী প্রেমের সম্ভাব্য নশ্বরতা
করতো কি বিচলিত তাঁকে? দূরাগত কোকিলের
আর্ত ডাক তাঁর পদে কীসের অস্পষ্ট গুঞ্জরণ
ব্যাকুল মিশিয়ে দিতো! অনাগত সময়ের ধ্বনি?
হতে পারে, নিঃস্ব কবি একদিন হেঁটে যেতে যেতে
দেখলেন মাধ্যাহ্নিক ভস্মরাশি নিয়তির মতো
তাকিয়ে রয়েছে তাঁর দিকে। অপার ঔদাস্যে তিনি,
নাকি বিলুপ্তির অন্ধ ভাবনায় ভেসে পুকুরের
ঘাটে এসে বসলেন চুপিসারে। সবার উপরে
সত্য যে মানুষ তার ভিড় কিংবা খুব একা কেউ
মনের ভেতরে তাঁর নৈঃশব্দকে করে গান। তিনি
গুঞ্জরিত মনে গিয়ে গৌরী ধোপানীর সন্নিকটে
নিঃস্বতাকে বানালেন অপরূপ স্মৃতির ভূষণ।
যাচ্ছি প্রতিদিন
জানো কি কোথায় আছি? আমার নিবাস
একটি ঠিকানা শুধু, বলা যায়, ফেলে-যাওয়া কোনো
খামে লেখা, তোমার নিকট,
তার বেশি নয়।
এ-ঘরে আসোনি কোনোদিন,
কী রকম ভাবে
কাটে বেলা এখানে আমার, পায়চারি
করি কতক্ষণ কিংবা চেয়ারে হেলান
দিয়ে দূর আকাশের দিকে
তাকাই কখন, কতটুকু
দেখি প্রজাপতিদের ওড়াউড়ি, অথবা কখন
কী মোহন ভূতগ্রস্ততায়
লেখার টেবিলে ঝুঁকে গোলাপ এবং
ফণিমনসার ঘ্রাণময়
পর্ব ভাগ করি,
তোমার অজানা।
আজো আছি, অসুস্থ বৃদ্ধের
ঈষৎ কাঁপুনি
বাড়িটার সার গায়ে। মেশিনের ঝাঁকুনি সত্তায়
গাঁথা, টলে মাথা, বুক কখনো মেঘলা
হয়ে আসে। মাঝে-মাঝে বড় অবাস্তব
মনে হয় এই ডেরা। তোমার নমিত
পদচ্ছাপ এখানে পড়েনি বলে? চোখ
ফটোগ্রাফে, অন্য ছবি, এলোমেলো, ছায়া ফেলে মনে হয়;
কিছুই হবে না জানি, অথচ সর্বদা অপেক্ষার
চোখ অনর্গল।
শিরাপুঞ্জে মেশা
আজো বটে অসংখ্য জোনাকি।
বাসা-বদলের নেশা নেই, তবু যেতে চাই, দেখি
ছায়াচ্ছন্ন চিত্রনাট্যে নানা দেশী উদ্বাস্তর ভিড়,
গুপ্ত প্রেসে ছাপা
পুস্তিকার মতো ভবিষ্যৎ
জপায় নিষিদ্ধ মন্ত্র। যদি
তুমি কোনোদিন আসো এখানে এ-ঘরে
দেখবে তখনও আছি, নাকি পর্যটনে
দৃশ্যান্তরে? হবে না তেমন
প্রত্যহ কিশোর খোজে যেন
কিছুই, হলেও নেই ক্ষতি।
অলক্ষ্যে প্রকৃত
আমার নিকট আমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি প্রতিদিন।
রঙ
এই পৃথিবীতে দেখতে দেখতে
অনেক কিছুরই রঙ বদলায়,
এই চিরচেনা আকাশের রঙ-
তা-ও চদলায় অবেলায়।
কখনো কখনো মেঘ হয়ে যায়
গ্রাম্য মেলার ঢ্যাঙা এক সঙ,
কখনো সে মেঘ এক লহমায়
সুরসুন্দরী, কখনো ঝিনুক,
বুদ্ধ রাজার বিষণ্ন মুখ।
কোনো কোনো ফুল রঙ পাল্টায়,
কোনো কোনো প্রাণী পারে আগাগোড়া
বদলাতে রঙ। শুধু ডোরাকাটা
বাঘ পারেনাতো পাল্টাতে, হায়,
তার বিখ্যাত জ্বলজ্বলে ডোরা।
শব্দের কাছেও
শব্দের কাছেও মাঝে-মধ্যে খুব শান্তি পেয়ে হয়।
দীর্ঘবেলা কাটিয়েছি শব্দের সহিত,
কখনো সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলে সজীব লতার মতো
দেখি টান থেকে যায়, থাকে
এখান সেখানে মায়া, বিষণ্নতা, আনন্দের স্মৃতি।
বাউল যেমন গোধূলিকে একতারাময় বড়
উদাস বাজায়,
কখনো-সখনো শব্দ আমাকেও তেমনি করে ধ্বনি,
সমগ্র সংগীত হয় আমার ভিতরে। তবু জানি
শব্দের কাছেও মাঝে-মধ্যে খুব শান্তি পেতে হয়।
আজো সারাদিনমান আমি শব্দের কথাই ভাবি।
কখনো অত্যন্ত প্রয়োজনে, কখনো-বা, যতদূর
মনে হয় প্রয়োজনহীন
শব্দ খুঁজে নিরুদ্দেশ
গভীর জঙ্গলে, ঝর্ণা তলে, পাহাড়ের
দুর্গম জটিল পথে, সাগর সঙ্গমে, গুপ্ত দ্বীপে।
শব্দের নিজস্ব রীতি সৃষ্টি হয় আনাচে কানাচে
অগোচরে, প্রকাশ্যেও, শব্দ জায়মান
রৌদ্রজ্বলে যেন লতাগুল্ম।
শব্দের কাছেও মাঝে-মধ্যে খুব শান্তি পেতে হয়।
আমিও জেনেছি শব্দ প্রতিশোধপরায়ণ খুব
প্রেতের মতন-
কখন যে রক্ত শুষে নেয়, লেবু কাঁটা হয়ে শ্রুত
ক্ষত তৈরি করে
সত্তাময়। কখনো-বা শিং-অলা হরিণের সরল ধরনে
কেবলি জড়িয়ে যাই শব্দের লতায়। কিছু শব্দ
আমার ভিতরে জেগে ওঠে অকস্মাৎ
আমারই অজ্ঞাত।
যেশাসের গাধাটিকে মনে রেখে উচ্চারণ করি
‘গর্দভ’ এবং সব ওলোট-পালোট, তছনছ হয়ে যায়।
বাসগৃহ ব’লে আমি হেঁটে যাই প্রফুল্ল শরীরে,
অথচ আশ্রয়ে নয়, পৌঁছে যাই বিশদ শ্মশানে।
ভালোবাসা উচ্চারণ করতে গিয়ে হৃদয়ের স্বরে বারংবার
কী রুক্ষ ধিক্কার নিয়ে ফিরে আসি নিজস্ব গুহায়।