বুদ্ধদেবের চিঠি
দুপুর ঝুঁকে পড়ছে বিকেলের দিকে, ফেরিঅলা
হাওয়ায় আমন্ত্রণী ডাক মিশিয়ে
দাঁড়ায় মধ্যবিত্ত দরজার কাছে আর উড়নচণ্ডী এক কিশোর
লগি হাতে ছোটে কাটা ঘুড়ির পেছনে পেছনে,
কলতলায় আস্তে সুস্থে বাড়ে জটলা। ভাঙা দেয়ালে
রাঙা এক পাখি হিন্দি ফিল্মের নায়কের মতো শিস দ্যায়।
ড্রেনের ধারে কান্তিমান কুকুর
সোহাগ কুড়ায় সঙ্গিনীর।
ঢাকা, হে শহর আমার, তখন সেই মুহূর্তে,
অনেক বছর আগে একজন সদ্য যুবক
কায়েৎটুলীর রৌদ্রছায়ার আস্তানাময় গলির এক দোতলা বাড়িতে
প্রথম দেখলো তোমার পুরানো নন্দিত প্রেমিককে।
তাঁর সত্তায় তুমি ঝরিয়ে দিচ্ছিলে তোমার আলোর আদর,
তাঁর চোখে-মুখে তোমার নিঃশ্বাস আর তিনি
কেন স্বপ্ন-বিহবল সৃষ্টিতে
তাকাচ্ছিলেন আশপাশে, কী যেন খুঁজছেন। বহুকাল উজিয়ে
তিনি এসেছেন দেখতে তুমি কেমন আছো। বারবার
তাঁর চোখ একটা রুপালি জাল ছুঁড়ে দিচ্ছিলো
বাইরে, হয়তো তোমার অতীতের
কিছু শালিক কি চড়ুই ধরার জন্যে।
এবং সেই সদ্য যুবক দেখছিল তাঁকে, যেমন কোনো
পরাক্রান্ত বিদ্রোহের প্রতি তাকায় ভক্ত।
যুবক জানতো, কাব্যবলায় তিনি চূড়াস্পর্শী পারদর্শী আর
গদ্যে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। খ্যাতি ধীমান সেই পুরুষের
পায়ে পায়ে ঘোরে শীয়ামিজ বেড়ালের মতো । পেশাদার সমালোচক,
উঠতি কবি, তুখোড় বুদ্ধিজীবী, লাস্যময়ী মহিলা,
সবাই বেজায় ভন্ ভন্ করছিলেন তাঁকে ঘিরে; তিনি
সেই মৌচাকের কেন্দ্রবিন্দু হয়েও যেন সেখানে ছিলেন গরহাজির।
তিনি সেই সদ্য যুবার দিকে তাকালেন একবার, এরকম দৃষ্টিতে
স্নেহপরায়ণ পিতাই তাকান তাঁর সন্তানের দিকে,
আর এ-ও এক বিস্ময়, বহুজনের মধ্য থেকে সদ্য যুবকেই
নির্বাচিত করলেন
একটি দায়িত্ব পালনের জন্যে। ধবধবে কবুতরের মতো
একটা খাম ওর হাতে দিয়ে
বললেন, ‘এটা পৌঁছে দিও’। তারপর ধরালেন
সিগারেট; ছন্দমিল, মনে হলো এক ঝাঁক
আগুনে রঙের ফড়িং আর প্রজাপতি হ’য়ে তাঁর
চারপাশে ওড়াউড়ি করছিল।
সভা যখন ভাঙলো,ফিকে রক্তজবার মতো রঙ
যখন পশ্চিম আকাশে,
তখন সেই সদ্য যুবক কায়ৎটুলীর গলি ছেড়ে
পা বাড়ালো বড় রাস্তায়। এই চিঠি তাকে
পৌঁছে দিতে হবে আজই। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে
সে হয়রান-পেরেশান হলো,
কিন্তু শেষ অব্দি কিছুতেই শনাক্ত করতে পারলো না বাড়িটাকে।
একটা বাড়ি মাস্তানের মতো চুল ঝাঁকিয়ে
মস্করা করলো তার সঙ্গে,
অন্য এক বাড়ি বৃদ্ধের মতো মাথা নেড়ে নেড়ে
বলেন, ‘এতকাল আছেই এখানে, কই এই ঠিকানার
কথা তো শুনিনি কখনো!’
অট্রহাসি হেসে আমার উৎসাহকে ঝরাপাতার মতো
উড়িয়ে দিলো অহংকারী এক বাড়ি।
কাল অবশ্যই বিলি করবো এই চিঠি, নিজেকে আশ্বস্ত ক’রে
সেদিনের মতো সে ফিরে গেল নিজের ডেরায়।
পরদিন ভোরবেলা সে গেরো অভীষ্ট ঠিকানার
খোঁজে। কী অবাক কাণ্ড, সেখানে
কোনো বাড়ির চিহ্নমাত্র নেই, শুধু প্রকাণ্ড এক মাঠ
ধু-ধু করছে। মাঠে সে প্রেতাত্মার ধরনে ঘুরলো অনেকক্ষণ,
ঠিকানা ভালো ক’রে পড়ার জন্যে আবার সে চোখ বুলালো
খামের ওপর। খাম সেই মাঠের মতোই ফাঁকা,
ওতে কালি একটি আঁচড়ও নেই। তারপর
বছরের পর বছর
এক ঠিকানাবিহীন ঠিকানায়
চিঠি বিলি করা’র উদ্দেশে ক্রমাগত তার আসা-যাওয়া।
ভাড়াটে
পুরানো ভাড়াটে চলে গেলে কোনো বাসা বেশিদিন
খালি পড়ে থাকে না এখন।
পুনরায় ‘বাড়ি ভাড়া দেওয়া হইবেক’ ফলকটি
বসতে না বসতেই সরে যায়, অন্ধকার
ঘরে আলো জ্বলে, বারান্দায় হেঁটে যায় কেউ কেউ,
জানালায় পর্দা লাগে, শিশুর আনন্দধ্বনি বাজে
মাঝে-মাঝে, কাসেট প্লেয়ারে
রবীন্দ্রনাথের চিরকালীন গহন ব্যাকুলতা।
এখানে সিঁড়িতে আগেকার কেউ যে-কথা বলেছে
প্রায়ই তার প্রতিধ্বনি এখন আরেক
কণ্ঠে জাগে। অনেক পুরানো সিন্দুকের ডালা-খোলা
গন্ধময় স্মৃতি ঘোরে আনাচে কানাচে। কার হাসি
সোনালি ঘণ্টার মতো বেজে ওঠে হেমন্ত-বিকেলে?
এখন যে ভায়োলেট-রঙ
শাড়ি প’রে সাজাচ্ছে চায়ের সরঞ্জাম,
তার? নাকি আগেকার কারো?
পুরানো দেয়ালে কিছু দাগ জমা হয়, সাঁঝবাতি
জ্বালায় না কেউ;
অন্দরে বেদনা শুয়ে আছে সাবলীল ঘরে-ফেরা
নাবিকের মতো, বয়ে যাওয়ার সময়, তবু
টেবিলে আসে না কেউ। ভোরে
দরজার কাছে এসেছিল ট্রাক, একটি কি দু’টি কাক
ছাদের কার্নিশে উঠেছিল ডেকে। কোথায় যে গেল
ওরা লটবহরসমেত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি রেখে?
মশারির ঘেরাটোপে
মশারির ঘেরাটোপে চোখ মেলে দেখি-
অন্ধকার সরে যাচ্ছে, যেন
জেলে আস্তে সুস্থে তার জাল
ক্রমশ গুটিয়ে নিচ্ছে খুব
নিরিবিলি; একটি কি দুটি পাখি ডাকে,
নারকেল গাছের পাতার ঝিলিমিলি,
মেঝেতে গড়ায় প্রজাপতি, মরা; হাওয়া,
বাথরুমে গেলে নিলবে তো
পানি? যাই। প্রতিবেশী বাড়ির জানলা
খোলা, হলদে পর্দা নড়ে
এবং আমার ঘরে ওড়ে কত পদাবলী নানান যুগের,
দেয়ালে দেয়ালে, বারান্দায়
সকালবেলার স্বাধিকার।
বাজলো কলিং বেল, দরজাটা খোলো।
খবরের কাগজের চেনা গন্ধ, আসছে পাশের
ঘর থেকে
চায়ের সোনালি ঘ্রাণ, টোস্টার সেঁকছে
ঈষৎ বাদামি রুটি; লেখার টেবিলে
বসে আছি, শুক্রবাসরীয়
পাতায় বন্ধুর কবিতার দ্যুতি, খরার বাত্তিরে
বিদ্যুল্লতা, তাঁর
সঙ্গে কাল ফোনে হয়েছিল কিছু কথা,
সে-কথায় অসমান্য ঝলক লাগেনি,
তিনি কি লেখেন সত্যি, নাকি অন্য কেউ,
অন্তর্গত, গোপনে জপায়
তাঁকে অলৌকিক
তস্বিদানার মতো অক্ষরের মালা?
খরায় লেখনী তাঁর হোক
অন্নপূর্ণ; খাবারের প্লেট,
কানায় কানায় ভরা হাতে
এলেন গৃহিণী, চলে যাই একা-একা
মায়া কাননের দিকে।
তাকেই কি বলে কেউ ইদানীং অজানা স্টেশন
রহস্যের কুয়াশায় মোড়া?
মোটর কারের হর্ণ, গলি
শকুন্তলা, চমকে তাকায়, যায় সুটকেস আর
সামান্য সম্বল নিয়ে একজন রিকশায়, গিটার
হাতে; মুটে বয় সব্জিময় ঝাঁকা, হাঁকে মাঠা-অলা।
কবেকার নির্ঝরের গান লীলায়িত
সমগ্র সত্তায় অকস্মাৎ
মনে হয়-কয়েক শতাব্দী আগে ছিলাম কুটিরে
পদকর্তা মাঝে-মধ্যে অর্ধাহারে অথচ হৃদয়ে
উঠতো বেজে যখন তখন অনন্তের সুর, ছুটে
যেতাম রোদ্দুরে পুড়ে নীলাম্বরী শাড়ি-পরা সেই
গৌরী ধোপানীর ঘাটে। তার অঞ্জলিতে
ওষ্ঠ রেখে ব্রাত্যের দূরত্ব মুছে ফেলে
আমার তৃষ্ণার জল করতাম পান,
অমরতা নিয়েছিল দত্তক আমাকে।