কালো মেয়ের জন্যে পঙ্ক্তিমালা
আমার নামধাম তোমার জানার দরকার নেই, কালো মেয়ে।
আমি শাদা কি কালো, হলদে কি বাদামি,
সবুজ কি বেগুনি
তাতে কী এসে যায়? ধ’রে নাও, আমার কোনো বর্ণ
নেই, আমি গোত্রহীন। বলা যায়, আমি শুধু
একটি কণ্ঠস্বর, যা মিশে থাকে ঘন কালো অরণ্যের
লতাপাতায়, ঝিলের টোল-খাওয়া পানিতে
হরিণের মুখ রাখার ভঙ্গিমায়,
উটের গলার ঘণ্টধ্বনিতে। এই কণ্ঠস্বর
বয়ে যায় বিষুব রেখায়, উত্তর মেরুতে, বঙ্গোপসাগরের
তরঙ্গে তরঙ্গে আর আফ্রিকার
অজস্র জেব্রার কুরধ্বনিময় প্রান্তরে।
কালো মেয়ে, তুমি যতই কালো হও,
তোমার সত্তায় আমি দেখেছি গীর্জার মোমবাতির
আলোর মতো আভা, সে আভাকে
প্রণতি জানায় এই কণ্ঠস্বর।
তুমি যখন প্রথম চোখ মেলেছিলে, কালো মেয়ে,
স্বল্পালোকিত কাঠের কেবিনে,
তখন তোমার মুখের দিকে ঝুঁকেছিল একটি কালো মুখ।
যে-স্তন তোমার শিরায় শিরায় বইয়ে দিয়েছিল
জীবনের ধারা, কালো সেই স্তন।
তোমার দোলনা দুলিয়েছিল যে-হাত
সে-হাত কালো,
তোমার জন্যে রুটি বানিয়েছিল যে-হাত,
সে-হাত কালো,
তোমার হাতে প্রথম কাঠের পুতুল
তুলে দিয়েছিল যে-হাত
বড় স্নেহার্দ্র, বড় কালো সে হাত।
কালো মেয়ে, তুমি দারিদ্র্যের গহ্বরে
হামাগুড়ি দিয়ে
মিথ্যার মতো শাদার উৎপীড়নে ধুঁকে ধুঁকে
লাঞ্ছনার অট্রহাসি শুনে বঞ্চনার শত খানাখন্দ
পেরিয়ে গায়ে উপহাসের কাদা মেখে,
পা ঝাড়া দিয়ে জ্যোৎস্নার চন্দনলিপ্ত হরিণীর মতো
এসে দাঁড়িয়েছো যৌবনের চূড়ায়। তোমার বরকে ওরা
ঘরচাড়া করেছে, ওর কালো মথমলের মতো কণ্ঠস্বর
ওরা স্তব্ধ করে দিয়েছে, তোমার কানে কোনোদিন আর গুঞ্জরিত
হবে না তার তারা-ঝলসিত গান। কিন্তু, কালো মেয়ে,
তরমুজের মতো তোমার উদরে
মাসের পর মাস বেড়ে উঠছে ওর সন্তান।
যেদিন তোমাদের দু’জনের সন্তান ওর অস্তিত্ব ঘোষণা করবে
প্রথমবার, সেদিন
সূর্যোদয় গালিচা বিছিয়ে দেবে তার উদ্দেশে,
গান গেয়ে উঠবে রঙ-বেরুঙের পাখি,
গাছপালা করতালিতে
মুখর ক’রে তুলবে দশদিক।
তোমার কোল-আলো-করা ছেলে বেড়ে উঠবে
শক্রর বন্দুকের ছায়ায়
বছরের পর বছর, রাত গভীর হ’লে
স্বাধীনতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে
সাক্সফোনে সে তুলবে তোমার পূর্ব পুরুষদের যন্ত্রণার সুর,
জীবনকে মৃত্যুর দেশ থেকে ছিনিয়ে আনার সুর;
তোমার ক্রুশবিদ্ধ মর্যাদার ক্ষতগুলো ধুয়ে
সেখানে ফোটাবে সে প্রসন্ন অর্কিড,
সে তার জোরালো কালো হাতে মুছিয়ে দেবে আফ্রিকার
কালো হীরের মতো চোখ থেকে গড়িয়ে-পড়া অশ্রুজল।
কেন মানুষের মুখ
কেন মানুষের মুখ বারবার ম্লান হয়ে যাবে?
কেন আমাদের হাতে পায়রা পাথর হয়ে যাবে?
মুখের ভেতরে কেন অমাবস্যা ঊর্ণাজাল বুনে
যাবে ক্রমাগত? যোদ্ধবেশে শত শত
কংকাল সওয়ার হয়ে আসে
কেন রাতে ভৌতিক ঘোড়ায়?
কেন আমাদের
এত মৃত্যু দেখে যেতে হবে অসহায় ভঙ্গিমায়?
অবেলায় একটি বিপুল উল্টে-যাওয়া দোয়াতের কালির ধরনে
রক্তধারা বয়ে যায়। রক্তভেজা চুলে শব্দহীন
গোঙানি; চোয়ালে, মেরুদণ্ডে, দুটি চোখে,
হাড়ের ভেতরে স্মশানের ধোঁয়াবিষ্ট
হাওয়ার মতোই কিছু বয়ে যায়, বয়ে যেতে থাকে।
যে-হাত মুছিয়ে দিতো তার চির দুঃখিনী মায়ের
চোখ থেকে জলধারা, সেই হাত কেমন নিঃসাড়, শূন্য আজ।
যে-চোখ দেখতো প্রেমিকার মুখরেখা কনে-দেখা
আলোয় অথবা সূর্যোদয়ে,
সেই চোখ ডিমের ছড়ানো
কুসুমের মতো হয়ে গেছে,
যে-ঠোঁট স্ফুরিত হতো কবিতার পঙ্ক্তির চুম্বনে,
সে-ঠোঁটে ঘুমায় আজ স্তব্ধতার ভাস্কর্য নিধর।
একলা যে-কানে
বোনের সোনালি
চুড়ির শব্দের মতো আনন্দের ধ্বনি
হতো গুঞ্জরিত আজ সে-কানে স্থবির অন্ধকার
কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। কফিনের আলোড়নে
পাখিদের সংগীত পেরেক বিদ্ধ হয়।
মারা গেল, কখনো তাদের কেউ দোর খুলবে না
বাজালে কলিং বেল। বন্ধু এলে ঘরে
হাত ধ’রে নিয়ে বসাবে না কিংবা নিজে
বসবে না চেয়ারে হেলান দিয়ে, বুলোবে না চোখ
টেবিলে-উল্টিয়ে-রাখা আধপড়া বইয়ের পাতায়,
অথবা ব্যথিত, ক্ষয়া চাঁদের নিকট
চাইবে না শৈশবের শিউলি-সকাল
আবার পাবার বর! সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় ভাববে না
কাকে তার বড় প্রয়োজন ছিল। ‘কাল যাবো ঠিক
আমার গ্রামের বাড়ি, ট্রেন থেকে নামবো স্টেশনে
ঝুলিয়ে গেরুয়া ব্যাগ কাঁধে, দেবো সুখে
চুমুক চায়ের ঠুঁটো পেয়ালায় হাশমত আলির দোকানে’-
এই শব্দাবলি
জমাট রক্তের মতো লেগে থাকে শূন্যতার গালে।
যারা গেল, তাদের এখনো
আঁকড়ে রাখতে চায় এ দেশের শেকড়-বাকড়,
আঁকড়ে রাখতে চায় লতাগুল্ম আর
গহীন নদীর বাঁক, আঁকড়ে রাখতে চায় শারদ রোদ্দুরে
ডানা মেলে-দেয়া কবুতরের ঝলক,
আঁকড়ে রাখতে চায় নিঝুম তুলসীতলা, জোনাকির ঝাঁক।
এদেশের পতিটি গোলাপ আজ ভীষণ মলিন,
প্রতিটি সবুজ গাছ যেন অর্ধ-নমিত পতাকা,
আমাদের বর্ণমালা হয়ে গেছে শোকের অক্ষর,
আমার প্রতিটি শব্দ কবরের ঘাসের ভেতরে
হাওয়ার শীতল দীর্ঘশ্বাস;
আমার প্রতিটি চিত্রকল্প নিষ্প্রদীপ ঘর আর
আমার উপমাগুলি মৃতের মুঠোর শূন্যতায় ভরপুর,
আমার কবিতা আজ তুমুল বৃষ্টিতে অন্ধ পাখির বিলাপ।
গদ্য কবিতার চালে
দুপুরবেলা খেলাচ্ছলে কোথায় যে যাচ্ছিলাম
আস্তে সুস্থে, কী খেয়াল হলো
হঠাৎ ঢুকে পড়লাম
স্টেডিয়ামের বইয়ের দোকানে, সেখানেই
দেখা তোমার সঙ্গে। নিমেষে দুপুরের অধিক ঝলোমলো
হয়ে উঠলো দুপুর; তোমার চোখে চোখ পড়তেই
ভাবি, অনন্তকালের রঙ কি শাদা
পায়রার মতো? নাকি সমুদ্রের জলরাশির মতো
নীল? অনন্তকাল কি অপরূপ তালে-বাঁধা
কোনো ধ্রুপদী নাচ? সম্ভবত
শস্যের আভাস-লাগা নিঃসীম প্রান্তর, এ-কথা
মনে হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিপথে চকিতে
দুলে ওঠে স্বপ্ন-জাগানো এক লতা
কী নিবিড়,
সাইনবোর্ড, ম্যাগাজিন, বইপত্র, ভিড়
মুছে যায়; ঝালর কাঁপে, অকাল বসন্ত আসে অস্তিত্বের ভিতে।
নিজেকে প্রশ্ন করি, যা ঘটলো এই মুহূর্তে
আমার মনে থাকবে চিরদিন? আর
তোমারও কি পড়বে মনে বহুকাল পর এই সাবেকি
ঘটনা, যখন তুমি অন্ধকারে
ঘরে একলা শুয়ে-শুয়ে ক্যাসেট প্লেয়ারে শুনবে পুরোনো গান
কোনো বর্ষাকোমল রাতে? কে জানে
হারিয়ে যাবে কিনা এইসব কিছুই? শুধু গুণীর তান
হয়ে বাজবে মন-কেমন-করা স্তব্ধতা বিস্মৃতির ভাটার টানে!
তোমার চোখ হলো ওষ্ঠ, ওষ্ঠ চোখ,
আমি একটা বইয়ের পাতা ওল্টানোর ভান করে আনাড়ি
অভিনেতার ধরনকেই, যা হোক,
স্পষ্ট ক’রে তুললাম নিজের কাছে। সাত তাড়াতাড়ি
হাল আমলের একজন তুখোড় কবির
হৃৎপিণ্ডের ধ্বনিময়, বুদ্ধির ঝলকানি-লাগা বইয়ের দাম
চুকিয়ে তুমি আরো একবার গভীর
তাকালে আমার প্রতি। নিজেকে এগোতে দিলাম
আকাশ থেকে ডাঙায় নেমে-আসা
ছন্নছাড়া পাখির ধরনে। কথা বলবো কি বলবো না,
এই দ্বিধার ছুরি চলতে থাকে বুকের ভেতর। আমার ভাষা
যেন সেই কাফ্রি, যার জিভ কেটে
নেয়া হয়েছে, অথচ কথার ঝালর বোনা
হতে থাকে অন্তরে। দুপুরে অমাবস্যা ছড়িয়ে তুমি হেঁটে
গেলে করিডোর দিয়ে, মার স্বপ্নকে ফিকে
করে চোখের আড়ালে,
যেমন মল্লিকা সারাভাই যান খাজুরাহোর মন্দিরের দিকে
স্মৃতিতে জ্যোতির্বলয় নিয়ে গদ্যকবিতার চালে।