আরণ্যক
দেবদূতদের প্রিয় ছিল, বলা যায়, সেই
বন, ওরা ওড়াতেন রঙিন বেলুন
মাঝে-মাঝে বনের ভেতর। বলতেন, ঈশ্বর দেখুন
কী রকম সাজিয়ে রেখেছি এই
বনরাজিনীলা। তারপর
পরস্পর
হাত ধরে গোল হয়ে নাচে মেতে খানিক সময়
দিতেন কাটিয়ে
বস্তুত স্বপ্নের ঘোরে। আনন্দ অক্ষয়
ভেবে ছায়াদের নিয়ে
ইন্দ্রিয়বিলাসে মগ্ন হতেন হ্রদের তীরে। কেউ
কেউ অবসাদে জলে ঢিল ছুড়ে জাগাতেন ঢেউ।
একদিন গোধূলি বেলায়
যখন অরণ্যচারী কিছু প্রাণী ছিল মেতে মিথুন-খেলায়,
অকস্মাৎ সেই বন আগুনের ঢল
কী বাপক এল নেমে! লতাগুল্ম, গাছপালা, জল,
পশুপাখি আগুনের তাপে উবে যায় ক্রমান্বয়ে,
সবাই প্রলয়াভাসে ভয়ে
ছোটে দিশেহারা, দেবদূতগণ চকিতে উধাও; দাবানলে
জ্বলে শুধু জ্বলে
চতর্দিক। এখন সেখানে আপাতত
নেই কিছু ভোজ্য কিংবা পেয়।
কেবল এটি আর্ত পাখি ধৈর্য ধরে করাচ্ছে স্নেহার্দ্র স্নান ক্রমাগত
সুর ঢেলে দগ্ধ বনস্থলীটিকে ভস্মীভূত হবে সে জেনেও।
এখন নিজেকে বলি
এখন নিজেকে বলি মাঝে-মধ্যে, বেলা নিভে আসে
ক্রমে, তুমি যমে ও মানুষের টানাটানি
দেখেছো গ্রামের ঘরে, শহরের ফ্ল্যাটে,
আর অধিবাস্তব নাটোর
কুশীলবদের সাজঘরে অকস্মাৎ বজ্রপাত
করেছো প্রত্যক্ষ সাঁঝরাতে। তাছাড়া পাহাড়ি পথে
ধস নেমে যেতে দেখে আঁৎকে উঠেছি,
এবং পুরানো দালানের
ভিত নড়া, ভেঙেপড়া আমার সত্তার কাঠামোকে
নাড়িয়ে দিয়েছে তীব্রতায়। ভবঘুরে
কাবিলের মতো
যন্ত্রণর দাগ বয়ে বেড়াচ্ছি নিয়ত সাত ঘাটে।
বাগান যাই না ইদানীং, কোনোদিন যদি চলে
যাই ভুলে, ভয়
ফণা তোলে, ফুলগুলি নিমেষে করোটি হয়ে যায়,
বৃক্ষরাজি বিশীর্ণ কংকাল। গোধূলিতে
বাগান উগরে দেয় ক্রমাগত পুরাতন শব। শেয়ালের
দাঁতে বিঁধে থাকে যুবাদের হৃৎপিণ্ড।
আমার গন্তব্য নয় নদীতীর আর, ঢেউয়ে ঢেউয়ে
ছই-অলা নৌকা
অথবা ডিঙির দোলা দেখে আজকাল
পাই না আমোদ, ভাটিয়ালী
শোকগাতা হয়ে জলে মেশে, নদী বারবার
আমার উদ্দেশে ছুড়ে দেয় শুধু শ্মশানের ধোঁয়া।
আকাশ তো আগের মতোই নীল রঙে
ভরপুর, তবু তাকাই না
আকাশের দিকে রাত জেগে। তারাগুলি
ডাইনির চোখের ধরনে চেয়ে থাকে,
এবং গর্জনশীল নদী বারবার
ভীষণ কামড়ে ধরে কাজল মাটির ঘাড়, দেবদূতগণ
খেঁকশেয়ালের মতো হয়ে যান দ্রুত।
কখনো কখনো
মেঘ ফেটে রক্ত ঝরে, কয়েকটি লাশে
ঢেকে গেছে আমাদের সমস্ত আকাশ।
কালদীর্ণ কোকিলের মতো
অপার প্রসন্নতায় ছিলেন তিনি ঘর-দুয়ার
আগলে; নোংরা গলিতে,
রাস্তায় রাস্তায় বাজতো
তাঁর জুতোর আওয়াজ বাদ্যযন্ত্রের মতো। কখনো
দেখা যেত, হেঁটে চলেছেন
তিনি প্রান্তরের নীল প্রান্ত ঘেঁষে,পেরুচ্ছেন সাঁকো,
শস্যক্ষেতের ফসল ছাপিয়ে
জেগে উঠছে হরফ আলিফ-এর মতো তাঁর
ঋজু আর অনন্য শরীর। বনরাজিনীলার রহস্যময়তা
আর ডাগর নদীর ছলাৎছল শব্দ
কণ্ঠে ধারণ ক’রে তিনি সকলের জন্যে গাইতেন
ঘর ছাড়ার কীর্তন, ঘরে ফেরার গোধূলিপ্রতিম পদাবলী
তাঁর সুরে বিষ-কাটালির ঝোপঝাড়
রূপান্তরিত হতো রজনীগন্ধাবনে, গুচ্ছ-গুচ্ছ পলাশে
চেয়ে যেত মেঘের পাড়,
নদী হতো অজস্র নারীর কলস্বর,
পাহাড় মস্তিতে ভরপুর দরবেশ। সে-গানে
আকাশ পরতো সূর্যের মুকুট।
সেই গীতধারায়
স্নাত গাছপালা পেতো স্বর্গীয় সৌন্দর্য।
অলংকারহীন সে-গান পান্থশালায়,
গেরস্তের কুটিরে, কারখানার চত্বরে চত্বরে,
খনির সুড়ঙ্গে, হাসপাতালের করিডোরে, ঝর্ণার ধারে
উড়ে-আসা পাতায়,
বেকারের বিবরে কী ব্যাপক
ছড়িয়ে পড়তো যেন স্মৃতিমুখর তেজালো জোয়ার।
যত অন্তরারেই থাকুন তিনি, সে-গান
ঘোষণা করে তাঁর উপস্থিতি। ঘোর অমাবস্যায়
তাঁর হাতের মুঠোর থেকে ছল্কে পড়ে জ্যোৎস্না,
চোখ থেকে ঝরে ফুলের রেণু,
জামার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে
রঙ-বেরঙের পাখির ঝাঁক। তিনি যখানেই যান,
তাঁর সঙ্গে যায় লোক, রাস্তা-উপচে-পড়া লোক,
যেন তিনি এক মোহন ঐন্দ্রজালিক,
যার ইঙ্গিতে মাটিতে মুখ-থুবড়ে-পড়ে-থাকা শহর
নিমেষে তোলে মাথা,
মৌরসীপাট্রার ভুয়া দলিল দস্তাবেজ পুড়ে যায়
এবং বেজায় ছত্রভঙ্গ আততায়ীর দল।
প্রহরে প্রহরে ওদের বেয়নেট শাসালো তাঁকে, ওর
ভেবেছিল এতেই নড়বে টনক,
কিন্তু যাঁর ভিতরে গুঞ্জরিত কবিতার ঝলক, তিনি কেন
মাতা নত করবেন পিস্তল আর বন্দুকের নলের অভিযোগের
সামনে? কেন তিনি নিজের স্বপ্নমালাকে
দলিত হতে দেবেন উন্মত্ত হাতির পারের পায়ের তলায়?
আখেরে তাঁর, সেই কবির, ঠাঁই হলো আকাশ-ছোঁয়া
দেয়াল-ঘেরা কয়েদখানায়। দিনের পর দিন,
মাসের পর মাস যায়, অর্ধাহারে,
একাতিত্বের দংশনে গুকায় তাঁর শরীর, হাড়ে ধরে ঘুণ,
অথচ তাঁর আত্মায়
বিরতিহীন দেয়ালি, মৌন উৎসবের নহবৎ।
ওরা ভেবেছিল, তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ
করলেই, তাঁর পিঠে চাবুকের চেঁচিয়ে-ওঠা ছোবলে
কালসিটে পড়লেই রুদ্ধ হবে
দূরন্ত এক কাহিনীর গতি, কিন্তু তাঁর কবিতাবলিকে
ওরা হাতকড়া পরাতে পারেনি কিংবা বেড়ি। পৃথিবীর
কোনো কয়েদখানারই সাধ্য নেই
তাঁর ঈগলের মতো কবিতাকে
আটকে রাখতে পারে, ডানা তার ঝলসায় আকাশে আকাশে।
উত্যক্ত হয়ে ওরা একদিন কবিকণ্ঠে
পরালো মৃত্যুর ফাঁস; আর কী আশ্চর্য, ফাঁসির মঞ্চে
ঝুলন্ত কবির শরীরর প্রতিটি রোমকূপ থেকে বিচ্ছূরিত হলো
কবিতার পর কবিতা, যেন মেঘকৃষ্ণ গর্জনশীল আসমানে
বিদ্যুচ্চমক এবং সেই কবিতাবলি কালদীর্ণ কোকিলের মতো ডেকে
ডেকে
ভীষণ রক্তিম ক’রে তুললো নিজেদের চোখগুলো।