স্বপ্নের নাম শ্রীমতী
কতিপয় হত্যাকারী, অতিশয় নিষ্ঠাবান, কেউ কানে খাটো,
একচুক্ষ কেউ,
কেউ বা ঈষৎ খোঁড়া, প্রাচীন ছোরার মতো কেউ,
রাত্রিদিন ঘোরে
চারদিকে নানা ছদ্মবেশে
আমার প্রকৃত স্বপ্ন হননের জন্মন্ধ লিপ্সায়।
ওদের সান্নিধ্যে ওড়ে দুর্মর বাদুড় শত শত,
ওদের নিঃশ্বাসে বয় আজরাইলের
তিমির নিশ্বাস।
নগর পোড়াতে পারে ওরা, পারে হওয়ায় উড়িয়ে দিতে
গ্রামের সকল ঘাস, সহজে বানাতে পারে হাজার হাজার
বস্তিকে বিধ্বস্ত গোরস্থান।
নরখাদকের মৃত্যু দেখি অধুনা সর্বত্র, দেখি
ওরা দ্বিধাহীন
প্রকাশ্যে সাজিয়ে রাখে লাশ,
তামস ভঙ্গিতে
আমাকে আহার করে চেটেপুটে, আমার ভগ্নাংশ
থাকে পড়ে এক কোণে, মাথাটা অভুক্ত থাকে শুধু
এবং নিজেকে মনে হয়
পরাস্ত দেশের মতো অত্যন্ত ধোঁয়াটে,
হাহাকারময়, স্বপ্ন চেয়ে থাকে আমার উদ্দেশে
উপদ্রুত মানুষের মতো।
আমার স্বপ্নের আছে ঘুরঘুট্রি আঁধারের ভয়,
আমার স্বপ্নের আছে রাতে পোকামাকড়ের ভয়,
মাটির তলায় নিত্য জিন্দা দাফন হবার ভয়
আমার স্বপ্নের ভয়, যদি
সহসা সাতায়
বাজ ভেঙে পড়ে,
ব্যাধের ফাঁদের ভয় আমার স্বপ্নের অহর্নিশ।
মাইল মাইলব্যাপী জনমান্ধের ভিড়ে
আমার আপন স্বপ্ন ভয়ে
কাঠ হয়ে থাকে।
কিছু স্বপ্ন, যতদূর জানি,
আকাশে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গেই
চকিতে মিলিয়ে যায় আলোয় হাওয়ায়,
অশত্থ গাছের নিচে মেতে ওঠে আত্মহননের নান্দীপাঠে,
কোনো কোনো স্বপ্ন ফের ফিনিক্সের মতো
জন্মন্তরলোভী,
বারবার ডানা ক্ষিপ্র ঝাপটায় সজীব, গান গায়
চেতনায়, বুঝি তাই হত্যাকারী স্ট্রাটেজি পাল্টায় প্রতিদিন।
আমার স্বপ্নের নাম রেখেছি কখনো, পুনরায়
ভুলে গেছি শত ডামাডোলে, হট্ররোলে।
আমার অনেক স্বপ্ন শিরোনামহীন
কবিতার মতো রয়ে গেছে
এবং কখনো
ব্যর্থ মানুষের
চোখের পানির মতো ঝরে বারে-বারে রিক্ত ফুটপাতে,
নিদ্রাছুট আহত বালিশে।
কখন যে কবে কোন সালে, খ্রিস্টপূর্ব কালে?-মনে মনে শুধু
একটি স্বপ্নের নাম রেখেছি শ্রীমতী আজ আর
মনেই পড়ে না।
সে স্বপ্ন, শ্রীমতী নাম্নী স্বপ্ন, একজন
সোনালি মাংসল স্থাপত্যের মতো জেগে থাকে।
তপ্ত হত্যাকারীর দঙ্গলে,
মঙ্গলের চেয়েও অধিক ভয়ঙ্কর লোকালয়ে,
পাশব নিবাসে, আর বিপুল নৈরাশে
নিবিড় সৌন্দর্য তার আমার মুখের রেখাবলী
থেকে দুঃখ পান করে প্রহরে, প্রহরে…
আমি সে স্বপ্নের মমতার তটরেখা থেকে আর
কোনোদিন জাগতে চাই না।
সেখানে স্মৃতিরর চন্দ্রোদয়, কিংদন্তির মতো
সেখানে বসন্ত আসে বারেবারে; আবার পালিয়ে যায়, যাক;
স্বর্গের বর্ণিল স্মৃতি
এই তো দাঁড়ানো তুমি সম্মুখে আবার একাকিনী
চোখে নিয়ে শতাব্দীর অস্তরাগ। মনে হয়, সাত
সুমুদ্দুর তের নদী পেরিয়ে এসেছো, রিনিঝিনি
রক্ত বাজে আমার শিরায়। জ্যোৎস্নাময় মধ্যরাত
তোমার শরীর, স্মিত ত্বকে বাংলাদেশের গ্রীষ্মের
মোহন দহন প্রাথমিক এবং তোমার ঠোঁট
যেন তরমুজ-ফালি তৃষ্ণার্তের কাছে। এ দৃশ্যের
বর্ণনা কী করে দিই? পারতেন নক্ষত্রের কোট-
পরা কোনো চিত্রকর ভালোবেসে আঁকতে তোমাকে,
পারতেন সহজেই ফর্ম ভেঙে পিকাসো মার্তিস
নব্য কোনো ফর্মে অমরতা দিতে তোমার সত্তাকে।
গোপনে তোমাকে দেখে দেবতাও দেয় দীর্ঘ শিস।
আমার স্বপ্নের অন্তরঙ্গ সবুজ উপত্যকায়
তোমার যৌবন শত নীলকণ্ঠী পাখি সৃষ্টি করে,
যে-যৌবন গুণীর তানের মতো ঢেউ দিয়ে যায়
নিসর্গের জায়মান আনাচে কানাচে। বায়ুস্তরে
বিদ্যুল্লতা, জ্বলজ্বলে নগ্নতাকে ঢাকবার ছলে
রাখো হাত যোনিতে এবং সামুদ্রিক উদ্ভিদের
ঘ্রাণ জেগে থাকে বাহমূলে, দুটি শ্বেতপদ্ম জ্বলে
বুকে নির্নিমেষ, বুঝি তুমি হাতের মুঠোয় ফের
রহস্য রেখেছো পুরে, আমার গহন অন্তস্তলে
শামুক, পাথর, শঙ্খ এবং সোনালি মাছ মাতে
বন্দনায় তোমার নিদ্রিত নগ্নতার ছায়াবীথি
গড়ে ওঠে তোমার আমার মধ্যে ঢেউয়ের আঘাতে।
এমন নীরব তুমি, যেন কোনো ভাষা জানা নেই
এখনো তোমার, শুধু এক সুর উভিন্ন সত্তার
বাঁকে বাঁকে বয়ে যায়। হে আমার নতুন অতিথি,
ফেনা থেকে উঠে-আসা, আমার হৃদয় তোমাতেই
নিজস্ব আশ্রয় খোঁজে। জলবিন্দুময় স্তনভার
আমার চৈতন্যে আনে হৃত স্বর্গের বর্ণিল স্মৃতি!
হৃদয় কপিলাবস্তু
মানব হারায় পথ বারংবার, জগৎ সংসার
সুবিশাল ঊর্ণনাভ হয়ে প্রবল জড়ায় তাকে
সারাক্ষণ, অমানিশা সত্যকে আড়াল করে রাখে
দৃষ্টি থেকে; হয়ে যায় দৃশ্য ও অদৃশ্য একাকার।
এখন ফেরারি শান্তি, নিয়ত সংঘর্ষ পৃথিবীতে
কী ব্যাপক শ্মশানের ধোঁয়া ছড়ায় নিমেষে, শত
শত দীপ্র নগরে মড়ক ব্যেপে আসে। তথাগত
দেখলে এমন ধ্বংস হতেন ভয়ার্ত অম্বালিতে।
এই তো দেখছি আমি নিরন্নের বিশীর্ণ ভিক্ষায়
ব্যথিত সিদ্ধার্থ বসেছেন ধ্যানী উপবাসে; তিনি
সর্বব্যাপী অন্ধকার দেখে আনন্দের দিকে হাত
বাড়িয়ে সত্যের দীপ তুলে ধরেছেন। প্রতীক্ষায়
সুজাতা তণ্ডুল নিয়ে বসে আছে স্তব্ধ, একাকিনী-
হৃদয় কপিলাবস্তু, স্তূপময় পূণ্য সারনাথ।
হেড আর টেল
সকালে দাড়িতে খর রেজার চালানো, ডোরাকাটা
তুর্কী
টাওয়েলে প্রভাতী ভেজা মাথা মোছা, শুকনো রুটি
চিবোনো, অফিসে
কী ব্যস্ত রুটিন যাত্রা, টেলিফোন, টেলিগ্রাম, চিঠি,
জরুরি এবং অদরকারী, রাশি-রাশি, নীরস সংলাপ,
মাঝে মাঝে টিনবদ্ধ খাদ্যের মতন প্রেমকথা,
সান্ধ্য আড্ডা, ঘুম, কোনো-কোনো রাতে কর্কশ অনিদ্রা
একটানা, সকালে দাড়িতে খর রেজার চালানো।
অকস্মাৎ ঘুমে নাকি জাগরণে, যেন কুয়াশার
অন্তরাল থেকে দেখা সামুদ্রিক উদ্যানে অজস্র
ব্যালে নর্তকের মতো মাছ, প্রবালের গা ছুঁয়ে একটি
সবুজ কাছিম নেচে ওঠে।
বাজি ধরি, মাঝে-মধ্যে নিজের সঙ্গেই বাজি ধরি-
হেড আর টেল, হেড আর টেল, হেড হেড হেড,
টেল টেল টেল
হেড টেল হেড
টেল হেড টেল।
আমার তিনটি শার্ট পড়ন্ত বিকেলে খুব উৎফুল্ল সারস,
হেড।
আমার চোখের অভ্যন্তরে নক্ষত্রের অভিসার বারংবার,
টেল।
দর্জির দোকানে ট্রাউজার ঈগলের ডানা হ’য়ে
মেঘলোকে উধাও সম্প্রতি-
হেড
গলির সেলুনে সাবানের বিবর্ণ বাটিতে ভাসে
সুগন্ধি নারীর ঘ্রাণ, টেল।
একটি সোনালি সিংহ গোলাপের সঙ্গে প্রেম করে,
হেড।
অন্ধকারে খনি শ্রমিকের ভারী পদধ্বনি সুখদ ব্যালাড,
টেল।
এই তো পায়ের নিচে বাদশাহী মোহর লুকনো,
হেড।
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের সবগুলো ঝকঝকে নোট ওড়ে
পরীদের গাউনের মতো,
টেল।
কবির হাদয়ে পিয়ানোর বিড় সমুদয় নৃত্যপর,
হেড।
আইবুড়ো মেয়েটির আঙুলে ফোয়ারা, অলৌকিক,
টেল।
গ্রীষ্মের প্রখর আলপিন ফোটে সমস্ত শরীরে,
লালট ঈষৎ সিক্ত মাঠ, ক্লান্তি, চোখে তীব্র জ্বালা,
পুলিশের বাঁশি বাজে ঘোলাটে দুপুরে,
ত্র্যাম্বুলেন্স কী ক্ষিপ্র ছুটেছে হাওয়া চিরে
প্রশস্ত রাস্তায়, হাসপাতালের বেডে রোগী
আসে, রোগী যায়, হায়, লেগেছে আগুন-
দমকল বাহিনী কোথায়?
অকস্মাৎ ঘুমে নাকি জাগরণে, বুঝি কুয়াশার
অন্তরাল থেকে দেখা-পাতালের প্রবাল সিঁড়ির
স্মিত ধাপে গহন স্বপ্নের ম্যাক্সি-পরা তুমি, অবিকল তুমি,
শুধু তুমি।