শাহ এম এস কিবরিয়ার মৃত্যু নেই
শাহ এম এস কিবরিয়া নামটি যখন
উচ্চারিত হয় এমনকি মৃদুভাবে,
একজন গুণবান মানব জৌলুস নিয়ে
নিমেষে ওঠেন ভেসে দৃষ্টিপথে আজও আমাদের।
শিক্ষার আলোয় তিনি উদ্ভাসিত ছিলেন ব’লেই
মানুষের অগ্রহতি, কল্যাণ-কামনা
ছিল তাঁর ভাবনার প্রধান বিষয়। তাঁকে শাহ
কিবরিয়া ব’লে মনে দিয়েছিল ঠাঁই ভালোবেসে।
অথচ শক্রর দল হিংসায় উম্মত্ত হয়ে এই
গণহিতকামী পুরুষের গৌরবের
আলোয় হিংসায় সেই পুরুষের জীবননাশের
কূট মতলবে তাঁর বুকে হানল মৃত্যুর ক্রূর ছোপ।
শাহ এম এস কিবরিয়া মুছে যাবেন ভেবেই
যারা তাঁর বুকে হেনেছিল ছোরা কী-যে মূঢ় ওরা।
কেননা ওদের জানা নেই শাহ এম এস কিবরিয়া
যারা, তারা মরে না ছোরা কিংবা অন্য অস্ত্রাঘাতে!
১৯.০১.২০০৬
শেষ চেয়ারের গদি ছেড়ে
যখন প্রথম দেখি সেই স্বল্পভাষী, প্রায়
নিঝুম, নিঃশব্দ, কিছুতেই
বুঝিনি অন্তরে তার উদ্দাম, বিদ্রোহী
যুবক লুকানো ছিল। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই-
বয়সে আমার চেয়ে বেশ ছোট হওয়া
সত্ত্বেও ক্রমশ কোনও কোনও ক্ষেত্রে
তাকে আমি শ্রেয় বলে মেনে নিই, যদিও সে হেসে
আমার শ্রেয়তা মেনে নিত
তার পরিচিতদের সকলের কাছে।
মনে পড়ে, বহুদিন আগে সেই যুবা,
শাহাদত চৌধুরী এবং তাঁর এক
জ্বলজ্বলে বিদ্রোহী বান্ধব সন্ধ্যাবেলা
হলেন হাজির এক বিদ্রোহী কাজের মতলব
নিয়ে আর সেই সঙ্গে তাদের কথায় ফুটে ওঠে
অপরূপ ফুলঝুরি। মুগ্ধ হয়ে শুনি আগামীর নবীন দলিল।
শাহাদত চৌধুরী নিজের অন্তরের জ্বলন্ত আগুন
প্রিয় মাতৃভূমির কল্যাণে করেছেন
অর্পণ সর্বদা হাসিমুখে। তাঁর দেশপ্রেমের স্বাক্ষর
আমার স্মৃতিকে চিরদিন করতে উজ্জ্বল,
যেমন বিশিষ্ট হাসি তার ভেসে থাকে, যখন কাজের
শেষে চেয়ারের গদি ছেড়ে যেতেন একদা।
সত্তা তাঁর সুর হয়ে যাচ্ছে ভেসে
একদা যখন জ্বলজ্বলে ছিল তাঁর
সত্তা তাঁকে দেখে
লেগেছিল ভালো আর অন্তর্গত আভা
দশজন থেকে স্পষ্ট করেছিল বিশিষ্ট, আলাদা।
কণ্ঠে তাঁর বাংলার মাটি আর নদীর ঢেউয়ের
অপরূপ ধ্বনি জেগে অজস্র শ্রোতাকে
আনন্দিত করেছে এবং আজও জ্যোৎস্নারাতে
অনেকে শুনতে পায় তাঁর গান তৃতীয় প্রহরে।
মোমতাজ আলী খান মৃত্যুর পরেও
কখনও কখনও তাঁর সুর
শহরে ও গ্রামে মানুষের হৃদয়ের
গভীরে ছড়িয়ে দিয়ে তাদের সুদূরে নিয়ে যান।
এখনও নিষ্ঠুর এই কোলাহলময়,স্বার্থপর
কালে মোমতাজ আলী খানের সন্তান
নানা প্রতিকূল বেড়া ডিঙিয়ে পিতার,
গুরুর সাধের মান রাখবে নিশ্চিত।
এইতো গোধূলিলগ্নে দৃষ্টিপথে ভেসে ওঠে-দূরে
দীর্ঘদেহী একজন পুরুষ যাচ্ছেন হেঁটে ধীরে
পেরিয়ে বাঁশের সাঁকো দূরে, বহু দূরে-সত্তা তাঁর
সুর হয়ে যাচ্ছে ভেসে মেঘের অন্তরে।
সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি
এ-গভীর রাতে চুপচাপ আমার শয্যার পাশে
কে তুমি দাঁড়িয়ে আছ? কে তুমি এমন
স্তব্ধতা সত্তায় নিয়ে আমার শোণিত
চুষে নিতে তীক্ষ্ণ শাদা দাঁত
উন্মোচিত ক’রে সেই কবে থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছ?
যাও চলে যাও মানবের ডেরা ছেড়ে
অন্য কোনওখানে দূর বিরানায়। এখানে তোমার
ছায়া বিশিক্ষণ পড়লেই অশুভের জন্ম হবে।
কিছুতে নড়ে না সেই ভয়ঙ্কর মূর্তি, আজ রাতে
ধ্বংসের প্রবল সাধ নিয়ে
এসেছে আমার ঘরে। এখানে পূরণ হলে সাধ
যাবে সে প্রতিটি ঘরে এই শহরের। আমি তাকে
নিশ্চহ্ন করার বাসনায় অস্ত্রাঘাত করি তাকে,
অথচ সে ক্রূর হাসি হেসে আমাকে আঘাত করে খুব জোরে
নিজেই গুঁড়িয়ে প’ড়ে থাকে গৃহস্থের পদতলে। কিয়দ্দূরে
শান্তির প্রশান্ত বাণী মধুর ধ্বনিত হতে থাকে।
২১.১০.২০০৩
হাসে ক্রূর হাসি
ভাবিনি চলার পথে এত বেশি কাঁটা
এবং পাথর বারবার
আমাকে ভোগাবে নানাভাবে। ছেলেবেলা
যখন পিতার আর মাতার মমতা
আমাকে রেখেছে নিত্য ঢের
কষ্ট থেকে মুক্ত, জেগেছেন সারারাত।
বেশ আগে পিতামাতা আমাকে সংসারে
রেখে চ’লে গেছেন ওপারে
জীবনের। সত্য কথা করি উচ্চারণ
আমার নিজের প্রায় শেষ-বেলায়-এখন
বস্তুত তাদের কথা প্রতিক্ষণ মনে পড়ে না কিছুতে
মাঝে-মধ্যে পড়ে আর কখনও-সখনও অশ্রু ঝরে।
নিজেও জনক আমি একজন যার
ছোট এক ছেলে হারিয়েছে প্রাণ জলাশয়ে
সাঁতার জানেনি ব’লে। কখনও-সখনও
মনে হয়, বেজায় করুণ সুরে ডাকে সে আমাকে
ভুলে-থাকা মেঠো-পথে। তখন নিজেকে
বড় বেশি অসহায়, এমনকি কেমন নিষ্ঠুর মনে হয়।
আমার সে-সন্তানের মাকে ভুলেও কখনও তার
ছেলেটির কথা তুলে দুঃখ দিতে চাই না কিছুতে।
কখনও-সখনও কী-যে হয়, সন্তানের
অভিমানী মুখ আজও তাকায় আমার দিকে। আমি
ভীষণ লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলি, চুল
ছিঁড়ি বারবার আর জলাশয় হাসে ক্রূর হাসি!
১৮.১০.২০০৫
হীরা কি স্বর্ণ নেই
দেখছি চৌদিকে থেকে কারা যেন ছুটে
আসছে দুরন্ত লাঠিসোঁটা নিয়ে হাতে
আমাদের বড় বেশি শান্ত,
নিঝুম পাড়ার দিকে। জানি না কী ক্ষতি
করেছি আমরা কোনকালে ভয়ঙ্কর উত্তেজিত,
ক্ষরু, অস্ত্রবাজদের! অকস্মাৎ মনে হ’ল, কিছু নেই কাছে।
তা হ’লে কি ঘুমঘোরে দেখছিলাম দুঃস্বপ্ন কোনও?
ইদানীং কল্পনায় ডানাময়ী পরী
আসে না দূরের মেঘমালা থেকে এই শ্যামলীর
বেশকিছু বইময় ছোট এক ঘর,
চেয়ার, টেবিল আর বিছানা এবং টেলিফোন
ছাড়া কিছু নেই বটে। তবে দু’- একটি আরও কিছু আছে বটে।
অকুণ্ঠ স্বীকার করি, ছোট এই ঘরটিকে প্রিয়,
বিশ্বাস্ত আশ্রয় ব’লে গ্রহণ করেছি-
বহুদিন হ’ল এর চার দেয়াল, জানালা, মেঝে
যতবার চোখে পড়ে, সত্যি বলি, বুকের ভেতর
কে যেন বাঁশির সুর নিঝুম ছড়াতে থাকে। আর
জ্যোৎস্নারাত পাশের গলিকে, কী আশ্চর্য, বেহেস্তের রূপ দেয়।
আমার হীরা কি স্বর্ণ নেই, নেই কোনও চোখ দু’টি
ধাঁধালো মোটরকার। আছে শুধু একটি কলম,
গুণীজন কখনও সখনও এই লোকটির কলমের
প্রশংসা করেন বটে- তা নিয়ে থাকতে হয় কিছু শুষ্ক খুশি!
২১.০৯.২০০৫