মেঘ থেকে মেঘান্তরে
প’ড়ে যাচ্ছি, প’ড়ে যাচ্ছি, দ্রুত
প’ড়ে যাচ্ছি। প’ড়ে যেতে-যেতে
ভাবছি কেন যে অকস্মাৎ এ-পতন
আমার? করেছি কোন গূঢ় অপরাধ?
কিছুক্ষণ পর দেখি ঝুলছি গাছের
ডালে আর শরীর আমার বড় বেশি
কাঁটাবিদ্ধ। ঝুলতে ঝুলতে ডালে প্রায়
অজ্ঞান হওয়ার পথে কাতরাতে থাকি।
বড় বেশি জনহীন অন্ধকার পথে
প’ড়ে গিয়ে চিৎকার করার চেষ্টায়, মনে নেই
কী হ’ল আমার। বেশ কিছুক্ষণ পর
দেখি এক জীব দ্রুত চাটছে আমার আর্ত্মুখ।
কিছুক্ষণ পর বহু কষ্টে মুখ পশুর লোভের
গর্ত থেকে ফেরিয়ে সহজ,
বিশুদ্ধ পথের দিকে নিয়ে আসি। ফলে
দুর্গন্ধের জিহ্বার সান্নিধ্য থেকে মুক্তি পাওয়া গেল।
একটি সফেদ ঢের রূপময় পাখি, ডানা যার
ঢেকে ফ্যালে উৎসুক যাত্রীকে, অকস্মাৎ
আমাকে আরোহীরূপে নিয়ে ওড়ে মেঘ থেকে
মেঘান্তরে, আমি তার প্রসাদের দান করি সানন্দে গ্রহণ।
যদি সে-পাখি বলে যেত
হঠাৎ মধ্যরাতে কেন যে উধাও হল ঘুম,
বুঝতে পারিনি। অনেকক্ষণ জানালার বাইরে
তাকিয়ে অন্ধকার আর গাছের পাতাগুলোর
কাঁপুনি দেখে নিজেকে কেন যেন ভীষণ
অসহায় মনে হল। বুঝিবা জানালায়
রাতজাগা এক পাখি এসে বসল।
পাখিকে বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকতে দেখে
ভাবলাম সে বুঝি বোবা। অথচ
বেশ পরে ওর বেজায় খড়খড়ে স্বর শুনে নিজের
ভুল গেল ভেঙে। ওর ওই নীরবতা এবং
হঠাৎ প্রায় গর্জে-ওঠা শুনতে পেয়ে খানিক
ভীত হয়ে পড়ি! কে এই পাখি? আমাকে
করবে না তো আক্রমণ? কিছুক্ষণ আবার
চোখ বন্ধ রেখে জানি না কিসের ভরসায় আবার
দৃষ্টি মেলে ধরি। হঠাৎ পাখিটি কী ক’রে যে মধুর
সুরে ডেকে ওঠে, কথা বলে মানবিক ভাষায়-
বিস্ময়ে চমকে উঠে দিখে ওকে। হঠাৎ পাখি
উড়ে চ’লে যায়-জানব না কখনও। শুধু ভাবব!
ভাবছি এতকাল পরে আজও, যদি সে
পাখি বলে যেত আমাকে জীবন আর কাব্যের
নানা সমস্যার সমাধন তা হ’লে খেদ যেত ডুবে
আক্ষেপের শত ঢিল। এখনও হাতে কলম
নিয়ে কী দিনে কী রাতে কাগজে আঁচড় কাটি; জানি না
কখনও সার্থকতা আমাকে চুম্বন করবে কি না।
যুবক ও যুবতীর নিজস্ব ঋতু
ভোরবেলা বাতাসের চুমোয় ঘুমের মাতলামি
কী মধুর ন’ড়ে ওঠে। জানালার বাইরে নজরে
পড়তেই নেচে ওঠে পুষ্পিত গাছের
ডালে দু’টি প্রেমমুগ্ধ পাখির চুম্বন
আমাকে পূর্বের কে প্রভাতের প্রণয়-বিলাস
বড় বেশি আলোড়িত করে। যেন ফের নতুনের স্বাদ পাই।
এই ঋতু যুবক এবং যুবতীর একান্ত নিজস্ব ঋতু-
যদি বলা হয় চতুর্দিক জুড়ে, তবে
বিন্দুমাত্র হবে না সত্যের অপলাপ। তাই আজও
শরতের সৌন্দর্যের মহিমা সর্বদা তারুণ্যের
অন্য নাম। বুঝি তাই বয়স বাড়তে থাকলেও
সতর্ক, নিপুণ যারা বার্ধক্য তাদের কাবু পারে না করতে!
জানা আছে বিলক্ষণ, মানুষের মরণের মুখোমুখি হতে
হবেই, নিস্তার নেই মৃত্যুর করাল অন্ধকার থেকে। তবু
আমরা কি সবাই খেলার ছলে লুপ্ত হতে চাই?
হয়তো এমন কেউ-কেউ আছেন সংসারে যাঁরা
বিলক্ষণ মরণ-পিয়াসী। কিন্তু যে যা-ই বলুক
যৌবন কি বার্ধক্য কখনও পৃথিবীকে ছাড়তে প্রস্তুত নই।
২২-০৯-২০০৫
যেতে-যেতে বড় ক্লান্ত
অনেকটা পথ একা হেঁটে যেতে-যেতে বড় ক্লান্ত
হয়ে যেন ঢ’লে পড়ি বালির লুকানো
মৃত্যুফাঁদে। গা বেয়ে শীতল
ঘর্ম-স্রোত বয়ে যেতে থাকে।
কী করি? কী করি?-প্রশ্ন বারবার
হানা দেয় অন্তরের একান্ত শোণিতে।
এই যে এখানে আমি তোমার দুয়ারে ভোরবেলা,
দুপুর, বিকেল আর সন্ধ্যায়, গভীর
রাত্তিকে ভিখিরি হয়ে পড়ে থাকি একা,
সে শুধু ঝঙ্কৃত কিছু শব্দাবলি কাগজের বুকে
সাজানোর আকাঙ্ক্ষায়। তখন আমার
বুক চিরে রক্তধারা বয় ঢের সকলের অগোচরে।
এখন এখানে ছোট ঘরে এক কোণে ব’সে
সফেদ কাগজে কালো কালির অক্ষর
দিয়ে প্রায়শই পদ্য লিখি-
সংসারে চালের হাঁড়ি শূন্য হয়ে এল
কখন, খেয়াল,-হায় থাকে না প্রায়শ।
অথচ বাগান, নদী, আকাশের তারা চোখে ভাসে!
১৩.১০.২০০৫
শারদ বিকেলে, রাত্তিরে
শারদ বিকেলে মন অকস্মাৎ নেচে ওঠে দূরে
কোথাও জীবনসঙ্গিনীকে
নিয়ে চ’লে যেতে প্রাত্যহিক এলেবেলে
ঝুট-ঝামেলার দাঁত-খিঁচুনি পিছনে ফেলে রেখে।
আমরা সদরঘাটে পৌঁছে মোটামুটি
সুন্দর একটি নৌকো ভাড়া ক’রে ভুলে গিয়ে সব
গ্লানি, অর্থক্ষয়ের দুশ্চিন্তা আর নায়ের নতুন গতি
মুছে দিল শারীরিক গ্লানি আমাদের স্বামী-স্ত্রীর।
প্রকৃতির পবিত্র চুম্বনে এই আকাশের নিচে
জীবনসঙ্গিনী জোহরার চেহারায়, মনে হ’লে,
ফুটেছে স্বর্গীয় আভা, যা আগে দেখিনি বহুদিন।
চিত্রকর হ’লে সে-মুহূর্তে আঁকতাম প্রাণ খুলে তার ছবি।
আকাশে জেগেছে চাঁদ। ভাবি, এই চাঁদ
হাজার বছর ধ’রে জাগে, মানবের দৃষ্টি থেকে
স’রে যায়, আসে আর যায়। তবু তার রূপ
রয়ে যায় চিরদিন। থাকবে কি শেষ তক? এলোমেলো ভাবি
আমার গাঁয়ের প্রায় কাছে এসে পৌঁছে গেছি ভেবে
নৌকোর মাঝিকে ফিরে যেতে বলি। হায়, এতে
জানি না কী ভাবল সে। আমিও যে আচানক
এইমতো সিদ্ধান্ত নিলাম-তাকে আমি বোঝার কী করে?
মনে হ’ল পূর্বপুরুষদের ভিটেবাড়ি ভুলে
বেগানা কোথায় যেন এসে
পড়েছি জ্যোৎস্নার মায়াজালে বড় প্রতারিত হয়ে।
নিজেকে ধিক্কার দিয়ে মাঝিকে তক্ষুনি নৌকা ফেরাতে জানাই।
মাঝি নৌকা ফেরাতেই কারা যেন, মনে হল,
বাঁকা হাসি হেসে ভ’রে দিলো চারদিক।
শুধু আসমানে ক্ষয়ে-যাওয়া বাঁকা চাঁদ
হাসছে কি কাঁদছে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
০৩.০৯.২০০৫