দেখছি এখন এই
দেখছি এখন এই খানিক দূরেই পথে এক
বেজায় জখমি লোক প’ড়ে আছে আর
একটি কুকুর তার পাশে ঘোরাঘুরি ক’রে
শুঁকছে আহত প্রাণীটিকে। জখমি পথিক প্রাণহীন।
এমন সময় আসে যখন শহরে আর গ্রামে
সামান্য কথায় কোনও মানুষ অপর মানুষের
প্রাণ কেড়ে নেয় যেন গাছের সামান্য পাতা-
এভাবেই কত-যে প্রাণের হয় অবসান
খবর রাখে কি কেউ? হয়তো রাখলে নিয়মিত
অনেক বিশাল খাতা দিয়ে ঢের ঘর ভ’রে যেত।
কে তুমি এখন এই আমার আঁধার-হয়ে আসা
কালে এলে জেনে নিতে আমার গোপন
কথাগুলো খুঁচিয়ে জেনে নিতে? যাও তুমি
চ’লে যাও। যেটুকু শান্তির মৃদু হাওয়া বয়ে যায়
অন্তরে নীরবে তাকে বইতে দেয়ার পথে ছুড়ে
দিয়ো না পাথর এই শান্তির চরণে।
এখন আমরা যাব দূরে, বেশ দূরে-
যেখানে মানব-শক্রদের শয়তানি,
নানাবিধ হয়রানি শেষ করে সারাক্ষণ মঙ্গলের
পথে হেঁটে যাবে, যদি কোনও পথ কেউ
আগুন জ্বালিয়ে দেয়, ভেঙে ফ্যালে ঘরবাড়ি
তা হ’লে তাদের অপরাধ শাস্তির বেতের বাড়ি
সুদীর্ঘ জেলের ভাত খেতে-খেতে কাটাবে সময়!
নিজেকে বুঝে নিতে চাই
প্রতিদিন নিজেকে খণ্ডিত ক’রে বুঝে নিতে চাই
এতকাল এত পথ হেঁটে,
এত ধুলোবালি গায়ে ঠাঁই দিয়ে আখেরে কী পেয়ে
চৌদিকে ছড়াব ফুলঝুরি? কেউ-কেউ
তাকায় আমার দিকে যেন সে দেখছে কোনও-এক
আজব অদ্ভুত কিমাকার জীব যাকে ধরে নিতে
হবে ঠিক চিড়িয়াখানায়! হাসব কি
কাঁদব না ভেবে আসমানে চোখ রেখে পথ হাঁটি।
মধ্যরাতে কে যে ডাকে ঘুমন্ত আমাকে
পারি না বুঝতে কিছুতেই। দোর খুলে
তাকাই আঁধারে যতদূর পারি কালিমাকে ভেদ
ক’রে আর বাড়াই দু’হাত ছুঁতে আগন্তু কটিকে।
এই যে তোমরা আজ সারাদিন দাঁড়িয়ে রয়েছ
রোদে পড়ে বৃষ্টির ধারায় ভিজে,
কী লাভ হয়েছে তাতে? দয়াপরবশ
কেউ কি এসেছে একমুঠো খাদ্য কিংবা পানীয়ের
বাটি নিয়ে? না, এখন এই আজকের দুনিয়ায়
আসে না সহজে কেউ ক্ষুধার্তের হাহাকার দূর করে দিতে।
না, আমার উক্তিতে নিখাদ সত্য নেই। আজও এই
ইট-চুন-পাথরের যুগেও কোনও-না-কোনও
স্থানে ফুল ফোটে, অপরূপ জল বয়ে যায়।
মানুষ পশুর রূপ সর্বক্ষণ করে না ধারণ কিছুতেই।
২১.০৫.২০০৫
প্রকৃত বোদ্ধা যদি
কে তুমি এখন এই অবেলায় আমাকে ঘুমের
শান্তি থেকে জাগিয়ে তুলেছ
অন্ধকারে? বেশ কিছুক্ষণ পরে নানা শব্দের
অনুরণে চোখ দু’টি বুজে এলে কে যেন হঠাৎ
আমাকে খুঁচিয়ে তুলে দেয়; চেয়ে দেখি
কেউ নেই, বাতাসের খুব জোর স্পর্শ থাকি।
কিছুক্ষণ ডানে বামে ঘুরে পুনরায় ঘুমোবার
চেষ্টায় প্রলুপ্ত হয়ে চোখের পাতাকে
শান্তি দিতে চেয়ে ব্যর্থ হই। কিছুক্ষণ পরে হাতে
হাল আমলের এক বাক্যগ্রন্থ নিয়ে কেন জানি
ব্যর্থ হই। তবে কি আমাকে পদ্য ত্যাগ
করেছে আখেরে? ঘরে এলোমেলো পায়চারি করি।
আমি কি উন্মদ হয়ে যাব? না হলে এমন হাল
হচ্ছে কেন আমার? কবিতা, অনেকেই
জানেন আমার প্রাণ। যদি সে আমাকে
ছেড়ে যায় ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরের মতো, তবে আমি
ঘরে ও বাইরে ঘুরে বেড়ালেও নিষ্প্রাণ পুতুল
হয়ে থেকে যাব আর বকব প্রলাপ।
এখনও আমার লেখা কবিতা অনেকে,
যতদূর জানি, দিব্যি ভালোবেসে পড়েন এবং
তাদের বিশেষ অপছন্দ হলে ঠিক জানিয়ে ছাড়েন।
প্রকৃতই বোদ্ধা যারা তারা নিন্দা ছুড়ে
দিলে খেদ নেই কোনও, উপরন্তু বেশ কিছু ভেবে
ভবিষ্যতে শুধরে নেয়ার চেষ্টা থেকে হই না বিরত।
প’ড়ে আছি রুক্ষ দ্বীপে
দেখছি আমার পাশ কাটিয়ে একটি লোক লাঠি
হাতে খুব খোঁড়াতে খোঁড়াতে
আমাকে পেছনে ফেলে যেতে চায় যেন। কিছুক্ষণ
পর একজন অন্ধ বৃক্ষতলে শীর্ণ হাত পেতে ব’সে আছে।
তাকে কিছু দেব ভেবে হাতড়াই পকেট; অথচ
পকেট ধূসর মরুভূমি।
মনে-মনে নিজেকে ধিক্কার দিতে-দিতে
বড় ক্লান্ত বোধ করি। কিয়দ্দূর হেঁটে
গেলে পর চোখে পড়ে গাছের ছায়ায়
কে এক বিচ্ছিরি বিকলাঙ্গ পুরুষ রয়েছে শুয়ে, পাশে তার
একটি মাটির পাত্র। আমি সেই পাত্রে কোনও
কানাকড়ি কিংবা টাকা দিতে ব্যর্থ হয়ে কষ্ট পাই বাস্তবিক।
নিজেকে ধিক্কৃত জীব ভেবে হেঁটে যেতে থাকি পথে।
পথময় কত-না মোটরকার, ঢের চোখ-জুড়োনো দৃশ্যের
মিছিল এবং পাশাপাশি বড় বেশি
কষ্টময় ক্রন্দনের রোল, শৌখিন আসরে
নরনারীদের নৃত্য, কোথাও উল্লাস আর কোথাও মাতম!
ক্লান্তির দংশন মনে হ’ল মৃত্যুপুরী গিলে খাবে।
গা ঝেড়ে দৃষ্টিতে অপরূপ পুষ্পরাজি টেনে আনি
কল্পনার মায়াজালে বুনে। চকিতে কখনও
আমার দু’কাঁধে মখমলি
পাখা গজাতেই দূর মেঘমালায় উড়তে থাকি-
মনে হয় নীল পরী, লাল পরী আমাকে চুম্বনে
ঢেকে দেবে। খানিক পরেই মনে হয়, প’ড়ে আছি রুক্ষ দ্বীপে।
বহুদিন আগে একজন বৃদ্ধ
বহুদিন আগে একজন বৃদ্ধ এক বিকেলের
নম্র অবসরে শোনালেন
আমাকে অজানা এক গল্প যা বানানো নয়
এক রত্তি। কোনওকালে না-শোনা কাহিনী শোনা গেল।
মনোযোগ সহকারে পাতাময় গাছের তলায় কিছুক্ষণ।
স্তব্ধতায় কথকের গাঢ় উচ্চারণ সৃষ্টি করে ভিন্ন প্রভা।
বৃদ্ধ কথকের কথা শুনতে চেয়ে দেখি
আকাশে সূর্যের আলো ঝিমিয়ে এসেছে
আর কয়কটি পাখি গাছের শাখায়
এসে ব’সে নিয়েছে আশ্রয়। বৃদ্ধ তার
সফেদ দাড়িতে হাত বুলিয়ে গল্পের
সূচনা করেই থেমে আকাশের দিকে তাকালেন।
ইতোমধ্যে পার্শ্বাবর্তী হ্রদে মৃদু ছলছল ক’রে ওঠে জল
আর বৃদ্ধ কথকের চোখে ভেসে ওঠে
তিনজন যুবতীর অপরূপ সাঁতার এবং কিছুক্ষণ
কেটে গেলে দেখা দেয় অন্য উপসর্গ হয়তো-বা
কেটে গেলে জ্যোৎস্না এই প্রিয় পৃথিবীতে-
মায়ামায় দুনিয়ার যেন আর কোনও জান্নাতের সৃষ্টি করে।
একদিন বৃদ্ধ তার এই প্রিয় শহরের নানা পথ ঘুরে
কেমন বেদনা বোধ করে ধীরে ব’সে পড়লেন
আর চতুর্দিকে নানা মানুষজনের
কাণ্ডকারখানা দেখেটেখে আকাশের দিকে
চেয়ে খুব জোরে হেসে উঠলেন। এই আচরণে
পথচারীদের কেউ-কেউ থামলেন, অনেকেই বাঁকা হেসে দূরগামী।
২৪.০৯.২০০৫