গুণী বন্ধু আনিসুজ্জামানের উদ্দেশে
যখন পাঞ্জাবি আর পাজামা চাপিয়ে
শরীরে সকালে কিংবা বিকেলে একলা হেঁটে যান
প্রায় প্রতিদিন দীর্ঘকায় সবুজ গাছের
তলা দিয়ে তাঁকে বাস্তবিক সাধারণ মনে হয়।
যখন বাজারে গিয়ে মাছ, তরকারি
কিংবা মাংস কেনার তাগিদে
কসাই-এর সঙ্গে দামদর করেন কি ঠিকমতো?
তখন কিছুতে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে
কিছু ছাত্র-পড়ানো শিক্ষক ছাড়া অন্য কিছু ভাবা
মুশকিল। মাছের হিসাব ছেড়ে বিক্রেতার সংসারের খোঁজ নেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের ক্লাসে
সেই অধ্যাপক ধীরে প্রবেশ করলে
ক্লাস মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত বক্তৃতা তাঁর সারাক্ষণ-
ছাত্রছাত্রী সবাই সাজাত মনে শ্রদ্ধার মঞ্জরি।
আত্মভোলা নন তিনি, নন অচেতন সমাজের
কল্যাণ কি অকল্যাণ বিষয়ে কখনও যতদূর
জানি দৃষ্টি তাঁর সদা মানবের প্রগতির দিকে
প্রসারিত। কী প্রবীণ, কী নবীন সকলের বরেণ্য নিয়ত।
এখনও সিদ্ধির পরে, খ্যাতির শিখরে পদার্পণ
করেও সাধনা তাঁর থামেনি, বরং মাঝে-মাঝে
এখনও গভীর রাতে ঘুমন্ত জীবনসঙ্গিনীর পাশে শুয়ে
অথবা টেবিলে ঝুঁকে থিসিসের ভাবনায় কাটান প্রহর।
জ্যোৎস্নামাখা মধ্যরাতে
জ্যোৎস্নামাখা মধ্যরাতে নিঝুম পথে
একলা আমি যাচ্ছি হেঁটে।
আগে পিছে দৃষ্টি রাখি, কিন্তু কোনও
আদম কোথাও দেয় না দেখা।
এই যে আমি বিজন পথে বড় একা
খুঁজছি ডেরা একটু শুধু ক্লান্তি-কণা মুছে নিতে
কিংবা ঘুমের মেঘে ভেসে জড়িয়ে কোনও
সোহাগিনীর দীপ্ত শরীর উধাও হতে।
হেঁটে-হেঁটে পথের ধারে একটি গাছের
কাছে গিয়ে ছায়ার আদর গায়ে মেখে
ঋষির ঢঙে বসে পড়ি। হঠাৎ দেখি, সামনে আমার
দাঁড়ানো এক বাউল হাতে একতারাটা ঝুলিয়ে নিয়ে।
দেখেই তাকে উঠে দাঁড়াই, শ্রদ্ধা জানাই নুইয়ে মাথা।
চেহারা তার চেনা খুবই, সাধক তিনি লালন সাঁই-
মাথায় আমার হাত রেখে তাঁর স্নেহ বুলিয়ে,
একটি চোখের আলোয় তিনি দেন ভাসিয়ে পথিকটিকে।
একতারাকে সুর বানিয়ে লালন এক লালনগীতি
গাইতে গাইতে গেলেন মিশে জ্যোৎস্না-ধোওয়া
চক্রবালে। আমি শুধু মন্ত্রমুগ্ধ চেয়ে থাকি
ধূসর পথে; সাগর মেতে ওঠে মনে, পা চালিয়ে এগিয়ে যাই।
১৪,১০,২০০৩
ঢের পথ ঘুরে এক হ্রদের কিনারে
ঢের পথ ঘুরে এক হ্রদের কিনারে এসে বসি
সন্ধেবেলা শারীরিক ক্লান্তি মুছে ফেলে
শান্তির শীতল স্পর্শে ডুবে
যাওয়া খুব সহজেই হবে-
এমন ধারণা খেলা করছিল কিছুক্ষণ থেকে।
ফলত হ্রদের দিকে তাকাই আনন্দে প্রীত জলে।
মনে হ’ল, প্রীত জল থেকে মাথা তুলে
তাকাল আমার দিকে অপূর্ব সজল চোখে আর
ইশারায় দিল ডাক। অপরূপ তরুণীর আহ্বান উপেক্ষা
করার ক্ষমতা কোনও মানবের নেই। আমি জলে নেমে
যাওয়ার আগেই দৃশ্য তরুণীবিহীন হয়ে গেল।
বিষাদ আমাকে ছেয়ে ফেলে, তবুও মুক্তির আভা জাগে।
বেশ কিছুক্ষণ পর আসমানে যুবতীর সুডৌল স্তনের
মতো চাঁদ জেগে ওঠে। জ্যোৎস্নাধারা হ্রদ,
পাশের গাছপালা, ঝোপঝড় যেন
বাতাসের স্পর্শে নর্তকীর মতো হয়ে যায় আর আমি
লোভী বালকের মতো তাকাই কাছের
প্রকৃতির দিকে, ভাবি কী মহিমা ছড়ানো চৌদিকে।
সমুখে তাকিয়ে ভাবি, আমি কি এখন হ্রদে নেমে
ভাসাব নিজেকে? হয়তোবা আমার প্রকৃতি-প্রেমে কোনও
জলপরী মুগ্ধ হয়ে কাটবে সাঁতার বেপরোয়া
কবির সান্নিধ্যে-হয়তোবা তার মায়া
ক্ষণিকের হলেও বয়েসি লোকটির কতিপয় মুহূর্তকে
রাখবে অক্ষয় ক’রে। দেবে কি কবিকে অমরতা?
১৮.০৮.২০০৫
দিগন্তের বুক চিরে
কখনও কখনও আমি একান্তে নিজেকে
বিশ্লেষণ করার ইচ্ছায় গৃহকোণে
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসি,
আকাশ-পাতাল ভাবি, এলোমেলো অনেক ভাবনা
আমাকে বিব্রত করে। বুকশেলফ থেকে
বই টেনে নিই দুশ্চিন্তার মাকড়সা-জাল থেকে মুক্তি পেতে।
তবুও নিস্তার নেই যেন, আচমকা ভাবনার
খোলা পথে দেশের দশের ছায়াছবি
রূপায়িত হয়ে
কোন সে পাতালে ঠেলে দেয়, হাবুডুবু
খেতে থাকি। কারও সাতে-পাঁচে নেই, তবু
কেন ঘোর অমাবস্যা ভাবনার মূর্ণিমাকে দ্রুত গ্রাস করে?
কী এক আজব খেলা চলছে স্বদেশে ইদানীং,
বুঝেও বুঝি না যেন! আমরা কি
সবাই এখন উলটো পায়ে হাঁটছি কেবল? ব্যতিক্রম কিছু
আছে বটে, তবে তারা এক কোণে ব’সে
থিসিসের মায়াজালে বন্দি হয়ে ক্লান্তির বিস্তীর্ণ কুয়াশায়
পথ, বিপথের ফারাক না বুঝে ঘুরছেন, শুধু ঘুরছেন।
কালেভদ্রে কিছু কলরব শ্রুত হয় পাড়ায় পাড়ায় আর
জাগৃতির ঢেউ দ্রুত বুদ্বুদের মতো
মিশে যায়। এই কি নিয়তি সকলের? ‘নয়, নয়
কখনও তা নয় ধ্বনি জেগে ওঠে দূর দিগন্তের বুক চিরে।
দুলছে হাওয়ায় তাজ
বেজায় ছোটোখাটো একটি
পক্ষীশাবক মাটিতে প্রায় গড়াতে
গড়াতে এগোচ্ছিল। ওকে দেখে
বড় মায়া হ’ল। জানি না কী ঘটবে ওর
ভবিষ্যতে। এই খুদে পাখি কি কাঁটাবন,
ইট-পাথর কিংবা কারও পায়ের আঘাত
পারবে সইতে? পারবে কি
বেঁচে থাকতে শেষতক?
কিছুদিন পর সেই একই পথ অতিক্রম
করার কালে কে যেন আমার
কানে সুর ঢেলে করল উচ্চারণ, শোনো
হে পথিক, তুমি যে অসহায় ক্ষুদ্র
পক্ষীশাবকটিকে দেখে করুণায় আপ্লুত হয়েছিলে
অবেলায়, দ্যাখো চেয়ে ঐ গাছটির উঁচু ডালে
কেমন যুবরাজের ধরনে বসে আছে। দ্যাখো ওর
মাথায় কেমন দুলছে হাওয়ায় তাজ।