কবির কল্পনার মায়াবিনী
সে যেন আমাকে সদা ছায়ার ধরনে সেঁটে থাকে,
জানি না কিসের জন্যে। তার এই কাণ্ড
আমাকে নিক্ষেপ করে বিরক্তির বেড়াজালে, কিন্তু
কিছুতেই পাই না রেহাই।
কখনও কখনও আমি চুল ছিঁড়ে নিজের মাথার
স্বস্তি পেতে চাই, কিন্তু সেই নটবর
অদ্ভুত হাসির বৃষ্টি ছিটিয়ে আমার মনে আরও
বেশি বিরক্তির ঢিল ছুড়ে দেয় শিকারের দেকে।
অবশ্য করি না ত্যাগ শেষতক আমার নির্দিষ্ট
কাজ, দিব্যি চালাতেই থাকি কলমের
কাজ, যতক্ষণ ঠিক শব্দ বসে না যথার্থ স্থানে,
মাথায় চলতে থাকে নানাবিধ শব্দের জরুরি আসা-যাওয়া।
জানা আছে জ্ঞানীদের নানা বাণী, যেসব কবির
কোনও-কোনও কাজে উপকারী-যেগুলির
প্রয়োগে নতুন পথ খুলে যেতে পারে
এবং সে-পথে হেঁটে যেতে-যেতে নয়া পথ গ’ড়ে ওঠে।
একদিন যে-ভাবনা ঠিক পথে জ্বলজ্বলে ক’রে তোলা ঢের
মুশকিল ছিল, সার্থকের হাত ধরা
ছিল যেন অসাধারণ, কবির কল্পনার মায়াবিনী!
০৫.০১.২০০৬
কীভাবে আমার উদ্ধার হবে?
কে যেন অনবরত ডাকছে আমাকে বেজায়
উচ্চস্বরে, যেন এভাবে
না ডাকলে মাথার বাজ পড়বে,
চতুর্দিকে আগুন জ্বলবে, পুড়িয়ে
ছারখার ক’রে দেবে নিমেষে সবকিছু।
বেজায় মুশকিলে
প’ড়ে গেলাম যেন। কখনও ডানে, কখনও
বামে ছুটে যাই, চিৎকার করতে গিয়ে
গলা যায় বন্ধ হয়ে, কখনও
ছুটতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে প’ড়ে যাই।
খানিক পরে মনে হয়, কারা যেন
আমার দিকে এগিয়ে আসছে আমাকে বিপদ
থেকে উদ্ধার করার জন্য আর আমি
মাটিতে প’ড়ে গোঙাচ্ছি, ফেটে-যাওয়া
আমার মাথা থেকে ঝরছে রক্তধারা।
গোঙাতে গোঙাতে কখন যে হঠাৎ
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কিছুতেই স্মৃতিপটে ভাসাতে
পারছিলাম না। কে আমি? কোথায় জন্মস্থান আমার-
কোনওকিছুতেই ভেসে উঠছে না স্মৃতির
পরদায়। কে আমি? কী ক’রে এলাম এখানে?
ঘোর অন্ধকার ঘিরে ধরেছে
আমাকে। মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে নিজেই
অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমি কি পাগল হয়ে গেলাম?
কীভাবে আমার উদ্ধার হবে? আমি কি
মনুষ্যত্বের আড়ালে থেকে যাব কোনও?
কে তুমি আমাকে
কে তুমি আমাকে স্পর্শ করলে
আচমকা শেষরাতের
অন্তিম প্রহরে? চোখ খুলতেই দেখছি
অপরূপ তুমি ঝুঁকে রয়েছে
আমার মুখের উপর চুমো খাওয়ার
ভঙ্গিতে। আমি ভাবতেই পারিনি এমন দৃশ্য।
অপরূপ প্রতিমার মতো হে তরুণী,
তোমার হাসি দেখে মনে হ’ল, এমন
ঠোঁট-ঝরা হাসি দেখে আমি তো কোন ছার
ফেরেশতাও চমকে উঠে তোমাকে স্পর্শ করার
জন্য উদ্বেল হয়ে উঠত। তোমার একটি চুমোর
বদলে হয়তো বেহেশত ছেড়ে দুনিয়ায় বসত চাইত।
খানিক পরে, তখনও আলো খুব জোরালো
হয়নি, ছায়ার মতো অস্তিত্ব যার সে আমার
খুব কাছে এসে গুনগুন করে কী যেন
বলতে চেয়ে বলতে পারছে না। তার দু’চোখ
থেকে ঝরতে শুরু করল ফোঁটা ফোঁটা পানি এবং
আমি তাকে স্পর্শ করতে গিয়ে ধুলোয় গড়াই।
৩০.১২.২০০৫
কেমন আলাদা, স্বর্গফেরা
কখনও এমন হয়, নিজেকে বড়ই
বেগানা কে এক লোক বলে
মনে হয়। যখন আমার দিকে কেউ
তাকায় অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে, বেজায় ভড়কে যাই।
যখন যেখানে যাই তখনই সবার দিকে হাসি-
মুখে কথা বলি সকলের সঙ্গে যদি
বেজায় ঝিমিয়ে পড়ি, তা হ’লে নানান পথে হেঁটে
পৌছে যেতে পারি ঠিক জ্বলজ্বলে কাঙ্ঘিত প্রদেশে।
ঘুম থেকে জেগে দেখি আমার চৌদিক ঘিরে আছে
ক’জন জবরদস্ত অস্ত্রবাজ। নির্ঘাত দুর্দশা
ভেবে নিয়ে আকাশের দিকে চোখ মেলে ধুকধুকে
বুক নিয়ে চির-অন্ধকারের আশায় চোখ খুলি, বন্ধ করি।
হঠাৎ কে যেন দূরে গান গেয়ে পরিস্থিতি দ্রুত
বদলে আমার মনে অপরূপ কিছু
তরঙ্গের সৃষ্টি করে। উপরন্তু কতিপয় নরনারী নেচে গেয়ে প্রাণে
আমার বাগান তৈরি করে আর আমি অন্য কেউ হয়ে যাই।
কেন যে হঠাৎ আশেপাশে কখনও না-দেখা মুখ
জেগে ওঠে, ওরা বড় মধুর সুরের ঢেউ তুলে
চারদিকে গ’ড়ে তোলে নতুন অপূর্ব গেরস্থালি। আমি সেই
সৃষ্টির আলোয় দীপ্ত হয়ে কেমন আলাদা, স্বর্গফেরা!
১৩.০৯.২০০৫
খেলাচ্ছলে ভুল ক’রে
বহুদিন ধ’রে ঢের পথে হেঁটে হেঁটে
প্রায় সন্ধেবেলা পৌঁছে যাই
কেমন আশ্চর্য স্থানে। জনমানবের
চিহ্ন নেই আশেপাশে কোনওখানে, কেবল তিনটি
কেমন আজব গাছ দাঁড়ানো বেজায়
উদ্ধত ধরনে, যেন এক্ষুনি কামড়ে খাবে বেখাপ্পা আমাকে।
বৃক্ষদের রুক্ষ কণ্ঠস্বর আমাকে প্রবল ধাক্কা
দিয়ে উচ্চারিত হয়, ‘এখানে আসার
যোগ্যতা তোমার লাভ করার সুযোগ হয়েছে কি?
নাকি খেলাচ্ছলে ভুল ক’রে এই এলাকায় প্রবেশ করেছ!’
কী জবাব দেব কিছু খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে চুপ
থাকা ছাড়া ছিল না উপায়। মাথা-ছোট
বালকের খেলারত মাথার ধরনে
বেজায় ঘুরতে থাকে যেনবা লাটিম। কিছুক্ষণ
পরে দেখি প’ড়ে আছি ধূসর মাটিতে। তা হ’লে কি
আমি মানুষের কোনও ধ্বংসলোভী জমিনের হয়েছি খোরাক?
চকিতে পড়ল চোখে আসমানে চাঁদের, তারার
উল্লাস এবং প্রায়-মৃত আমার পাশেই একা
আছেন দাঁড়িয়ে বুজরুক দীর্ঘদেহী। তিনি গাঢ়
কণ্ঠস্বরে বললেন, “এখানে আসার জন্যে দেব না তোমাকে
অপবাদ। তবে বড় বেশি বিপদের ক্রূর ছায়া
এখানে কাঁপতে থাকে মৃত্যুর দুয়ার খুলে রেখো”।
দৌড়বাজ পুরুষের ধরনে হঠাৎ ছুটে যাই
সামনের দিকে চোখ রেখে, দ্রুত হাওয়া
আমাকে পেছনে ঠেলে রাখতে বেজায়
বদ্ধপরিকর আর আমি শুধু ছুটছি, ছুটছি।