আমার অন্তর জুড়ে শহুরে-গ্রামীণ সুরধারা
এ এমন কাল বন্ধ চোখ খুলতেই দেখি
শরীর-জ্বালানো তেজ নিয়ে
আমাদের পোড়ায় কখনও, কখনও-বা
উত্তেজিত করে খুব ছড়াতে দ্রোহের অগ্নিশিখা।
দিনরাত বৃষ্টিধারা দেয় না ভাসিয়ে নানা শহর ও গ্রাম।
কখনও-সখনও বর্ষা, যতদূর জানি,
কোনও কোনও কবির, লেখার
খাতার উন্মুখ পাতা বর্ষার ধারায় সেজে ওঠে।
বয়স হয়েছে ঢের। জীবনের নানা
ক্রূর ঘাত-প্রতিঘাতে কেউ-কেউ ভণ্ড বান্ধবের
পোশাকে দিয়েছে হানা অতর্কিতে। যখন পেয়েছি
টের, ততদিনে বড় দেরি হয়ে গেছে; বয়ে গেছে কৃত্রিমতা।
আমার এ বয়সে ও কখনও দাদা, নানা
বাবা, চাচাদের জন্মস্থান পাড়াতলী
গ্রামে যাই ঢের পথ পেয়েছি মেঘনা নদী। ছলছলে জল,
ক্ষেতের সবুজ ঢেউ চোখে কত স্বপ্ন দিত জ্বেলে।
শ্রাবণের রাতে শুয়ে বিছানায় অথবা টেবিলে
একলা নিঃশব্দে ঝুঁকে কবিতা লেখার কালে চোখে
হঠাৎ ঝলসে ওঠে জননীর মুখ। হাতে তাঁর, মনে হ’ল,
ঝলসিত কোরানশরিফ। ঘরে ভাসে স্বর্গীয় সুরের রেশ।
কখন যে শরতের জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে
এসে দাঁড়িয়েছি একা হাওয়ায় দোলানো
ফসলের ক্ষেতের সান্নিধ্যে, বুঝ উঠতে পারিনি-
যেন কেউ দেখাচ্ছে আমাকে স্নেহভরে এই দৃশ্য।
শেষরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি চাঁদ
হাসছে কৌতুকে এই শহুরে লোককে দেখে, যার
সমস্ত শরীর ফুঁড়ে কী সহজে বেরুচ্ছে গ্রামীণ রূপ।
আমার অন্তর জুড়ে শহুরে-গ্রামীণ সুরধারা।
১৬.০৮.২০০৫
আমার শহর, প্রিয়তম শহর
তোমরা আমাকে ঠেলেঠুলে ঢের নিচে
ফেলে দিতে চাও-
বুঝতে আমার খুব বেশি মুশকিল
হয় না, যেমন বেড়ালের হাসি ফোটে অন্ধকারে!
তোমরা তো জানোই, কক্ষণও আমি কার
বাড়া ভাতে বালি
ছিটিয়ে নিজের বগলকে ঢোল ভেবে
অতিশয় মৌজে ঘরে নর্তন করব।
এই তো এখন বসে আছি, কেউ নেই
ব’লে দৃষ্টি মেলে
নীরবে আমার দিকে, সে কি অকস্মাৎ
আমাকে হত্যার জন্যে লড়ছে হঠাৎ!
না, মিথ্যা আমার মনে কালো কিছু ছায়া
আমাকে সহসা
ভড়কে দেয়ার জন্য এসে পড়ছে এবং
আমি সেই ফাঁদে দ্রুত পা দিয়ে ডুবছি!
জানালার বাইরে পুষ্পিত চাঁদ হাসিমুখে
তাকিয়ে রয়েছে
পৃথিবী এবং এই কবির দিকেই অপরূপ বদান্যতা
ছড়িয়ে, নন্দিত এই শহরের মহিমাবর্ধনে ঐকান্তিক।
এই তো দাঁড়িয়ে আছি
এই তো দাঁড়িয়ে আছি তোমার কাছেই
কিছু কথা বলার আশায়। জানতে কি
চাও সেই কথা
এখনই রাত না পোহাবার
আগেই? কী করে সম্ভব তা? সে-সাধ্য আমার নেই।
অপেক্ষা তোমাকে কিছু করতেই হবে।
এই তো আমার হাত ছড়ানো তোমার
দিকেই কখন থেকে-স্পর্শ করো, তুলে
নাও হাত; দেখবে হাতের স্পর্শ যে-কোনও যুবার
চেয়ে কিছু কম স্পষ্ট জলজ্যান্ত নয়।
দেখছ তো আমাকে এখন বড় বেশি
কাছ থেকে। পাচ্ছ নাকি উষ্ণ
বিশ্বাস বয়স্ক মানবের? লক্ষ করলেই, হে মানবী,
বুঝবে তোমার গালে, ঠোঁটে পুরুষের চূম্বনের ফুলঝুরি!
মেয়ে তুমি আমার মাথায় কিঞ্চিৎ কালির
আভা দেখে চমকে উঠো না। যদি ভেবে
দ্যাখো, ঠিক দেখতে পাবেই পৌরুষের গুণাবলি
এখনও অক্ষুণ্ণ খুব। তোমার কামিনী
প্রাণের বাগান তীব্র প্রস্ফুটিত হবে ঠিক। তুমি
আমাকে বসন্তকালে ধুলোয় লুটিয়ে ফেলে যাবে না নিশ্চিত।
একটি অনন্য মালা
তিনজন আলেমের বেজায় সুনাম শুনে তাদের
সামনে হাজির হয়ে বড় বেশি
কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়লেন, যেন তিনি তাঁদের
একজন নিয়মিত মাইনে-পাওয়া খাদেম।
সেই আগন্তুকের শরীরে যে-জামাকাপড়
মাঝে-মাঝে কাঁপছিল বাতাসে।
কারা যেন, মনে হল লোকটির,
চিৎকার ক’রে বলছিল,-
‘কেন পা রেখেছিস এখানে হতভাগা
দূর হ এক্ষুনি, ঠাঁই নেই তোর এখানে?’
আখেরে তাকে যেতেই হ’ল সেখান
থেকে অপসারিত হয়ে। ভাবেনি সে, যারা গজল
রচনা করে, জয় করে হাজার
মানুষের মন, তারা এমন কঠোর, এমন
খেয়ালি হয়। তাদের খাদেম যারা তারাও কি
এমন এলোমেলো, আকাশের নীলিমায় ভাসমান?
যে বিরূপ লোকটি শহুরে পরিবেশে নিয়ত
কবি ও কাব্যসিদ্ধ গুণীদের অবহেলা, কাব্যপ্রেমী লোকটি
শহরের রুক্ষতা, ধূসর অবহেলা পিছনে
ফেলে রেখে গ্রামাঞ্চলে জীবনের চাকা ঘোরানোই উত্তম।
দেখা গেল লোকটি কাঁধে কলস-ভরা
জল বয়ে নানা জায়গায় হেটে সামান্য
অর্থের বিনিময়ে বিলি করত তেষ্টা-মোটানো কিছু পানি
আর মনে-মনে তার উচ্চারিত হত স্রষ্টার কিছু নাম।
অতঃপর অতি সাদাসিধে কাপড়-পরা
লোকটির ঘটি সাধারণ গ্রামবাসীদের নিকট
বড় পরিচিত, প্রিয় হয়ে ওঠে, তবে সেই লোকটি,
বলা যেতে পারে, আত্মীয়ের চেয়েও
অধিক বরেণ্য হয়ে ওঠেন। কেউ-কেউ ভাবেন,
তাদের প্রিয় জনটির উপর মধ্যরাতে ফেরেশতার ফুল ঝরে!
আখেরে বেশ কিছুদিন পরে সেই পানি-বিক্রোতার
ফেলে-আসা শহরের চতুর্দিক ঝলসানো বিজ্ঞাপন
সাড়া তুলল সর্বত্র। নির্ধারিত বিকেলে
নানা দিকে বিভিন্ন দেশের বড় বেশি কবি এবং
কবিতাপ্রেমীদের আসর জমল পরোদমে,
নানা স্থানের নানা কবি আবৃত্তি করলেন কবিতা।
মাথায়, কাঁধে আশ্চর্য নিখাদ জল কাঁধে বয়ে
যে-লোকটি গ্রামেগঞ্জে ঘুরেছে
এবং অবসরে আসমানে দৃষ্টি মেলে কাটিয়েছে,
সে বসেছিল ভিড়ের বেশ কিছু দূরে একা-‘এমন সময়
দূর থেকে, কী আশ্চর্য, নাম ধ’রে ডাক এল তার।
অবাক, বিচলিত সেই জন দৃষ্টি মেলে দিল আকাশে।
বেশ কিছুক্ষণ চতুর্দিকে নানা শব্দের জন্ম হলে আখেরে
সেই জল-বিক্রোতাকে খুঁজে পেয়ে
তাকে একজন ধীমান তার সাধারণ গলায়
একটি অনন্য মালা দুলিয়ে তাকে বুকে জড়ালেন।
২৮.০৯.২০০৫