- বইয়ের নামঃ অন্ধকার থেকে আলোয়
- লেখকের নামঃ শামসুর রাহমান
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অজানা পথের ধুলোবালি
কে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে অজানা পথের
ধুলোবালি চোখে-মুখে ছড়িয়ে সন্ধ্যায়?
কেন যাচ্ছি? কী হবে সেখানে
গিয়ে? জানা নেই। মাঝে-মাঝে
বিছানায় শুয়ে সাত-পাঁচ ভেবে চলি। অতীতের
কিছু কথা স্মৃতিপটে ভাসে।
হঠাৎ ভীষণ শব্দ আমাকে কামড়ে ধরে যেন-
ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে। অন্ধকার যেন
আরও বেশি গাঢ় হয়ে যায়, এমনকি নিজ হাত
এতটুকু পড়ছে না স্বদৃষ্টিতে। থেকে
যেতে হ’ল আখেরে সেখানে, যে-স্থানের
সবকিছু বেজায় অজানা!
আজকাল প্রায়শই জানাশোনা লোকের মৃত্যুর
খবর বিষণ্ন করে অতিশয় টেলিফোন,
কখনও সংবাদপত্র কিংবা রেডিওর মারফত।
কোনও-কোনও আত্মীয়স্বজন যারা অতি
সাধারণ, নামের জৌলুসহীন, আড়ালেই থাকে।
লক্ষ, কোটি মানুষের মতো।
কখনও কখনও আয়নায় নিজের চেহারা দেখে
সহসা চমকে ওঠে। এই আমি আজ
আমার আপনজনদের মাঝে হেসে, খেলে
থাকি; একদিন আচানক মুছে যাব
ধুলো-তখন সত্তা, পদ্য এবং আপনজন-সবই
শুধু অর্থহীন, হাহাকার!
১৮.১০.২০০৫
অথচ বেলা-অবেলায়
রাতে চাঁদটা হঠাৎ যেন বেজায়
বেঁকে বসল। বলা যেতে পারে, মেজাজ তার হয়তো
অকারণেই বিগড়ে গেছে। হয়তো
এখনই সে ছিটকে মিলিয়ে যাবে জলের ঢেউয়ে।
হঠাৎ আকাশটাকে কেন যেন বেখাপ্পা
ঠেকছে। বস্তুত যেন আকাশকে কেউ ভীষণ
চড় কষিয়ে তার সৌন্দর্যকে নির্দয়ের ধরনে
ধ্বংস করে ফেলেছে। যে-জলাশয় আমার অনেক
সময়কে সাজিয়ে দিয়েছে বিচিত্র সব
চিত্রের আবদানে তার এই বর্তমান চেহারা
কেন জানি আমি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছি না।
কোনও মুহূর্তেই। এই জলাশয় ছুঁতে পারছি না কিছুতে।
তবু কেন যেন আমি প্রায়শ এই জলাশয়ের
কাছে চলে যাই কখনও ভোরবেলা, কখনওবা
জ্যোৎস্নারাতে; কখনও কখনও ছুঁই তার করুণ
জলরাশি। কিছুতেই তার আকর্ষণ পুরোপুরি ছুড়তে
পারি না বাতিলের নর্দমায়। এত অপছন্দের পরেও
তার দিকেই তাকাই তাকে এত আকর্ষণীয় কেন যে মনে হয়!
ভাবি কখনও আর যাব না কিছুতেই
সেই বিচ্ছিরি জলাশয়ের কাছে নষ্ট করতে
সময়। কী লাভ ক্ষণে-ক্ষণে বেহায়া ব্যাঙের
লাফ দেখে, পচা জলরাশির দুর্গন্ধ শোঁকা?
প্রতিজ্ঞা করি কখনও এদিকে পা ফেলব না কিছুতে,
অথচ বেলা অবেলায় চ’লে আসি; শুনি বাঁকা হাসি!
০৫.১২.২০০৫
অন্ধকার থেকে আলোয়
মধ্যরাতে কোনার ছোট ঘরে টেবিল-ল্যাম্প
জ্বলতেই আমার কলম বিরক্তিতে
বেজায় খুসখুস করতে লাগল
ডান হাতের তিন আঙুলের চাপে।
কলমটিকে যত রাখতে চাই টেবিলে
ততই যেন ওর জেদ চেপে যায়, সরে না
কিছুতেই। কে যেন জেদ ধরেছে
শূন্য পাতাটি ভ’রে তুলবেই অক্ষরে।
যতই কলমটিকে লুকিয়ে রাখতে চাই চোখের
আড়ালে টেবিলের ড্রয়ারে, কিছু
বইপত্রের নিচে কবর দিয়ে তত বেশি লাফিয়ে
ওঠে সে আমার হাতে। মুচকি হাসে যেন বেজায়
পেয়েছে মজা। কলমের কাণ্ড দেখে হাসব
নাকি কাঁদব ঠিক করা মুশকিল ভীষণ। মনে হল,
অদূরে গাছের ডালে এক হল্দে পাখি আমার
দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে কৌতুকী হাসি।
পাখিটি কি ভাবছে ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া লোকটা
জীবনের প্রায় শেষ সীমানায় পৌছে ভীষণ
হাবুডুবু খাচ্ছে? গাছতলায় এসে গলায়
দেবে কি দড়ি? কে জানে? আবার আনন্দের
কত মেলা বসে নানা দিকে-আলোর ফোয়ারা ফোটে।
এই তো আরও আচানক দিগ্বিদিক যুবক, যুবতী
জ্বলজ্বলে নিশান কাঁধে নিয়ে হতাশার তিমির
তাড়িয়ে বালক, বালিকা, বৃদ্ধ, বৃদ্ধার মুখে ফোটায় হাসি।
২০.১০.২০০৫
অপরূপ চিরন্তন ঘ্রাণ
খাতার প্রথম পাতা পুরো নয়, শুধু
দুই তিন পঙ্ক্তি দিয়ে সাজিয়ে হঠাৎ
থেমে যাই। নিজেকে বেজায় খুঁড়ে স্রেফ
থেমে থাকি। কিছুতেই কোনও শব্দ উঁকি
দেয় না অস্থির মনে। কখন অজ্ঞাতে
হঠাৎ মাথায় দুই তিনটি চুল ছিঁড়ে ফেলি-
বস্তুত পাইনি টের। টেবিলে কলম রেখে ধীরে
মাথাটা চেয়ারে রাখতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
চোখ খুলতেই দেখি আলোকিত ঘর আর অদূরে প্রবীণ
একজন রয়েছেন ব’সে-গায়ে তাঁর
হলুদ রঙের আলখাল্লা আর জ্যোৎস্না-রং চুল-দাড়ি
উপস্থিতি তাঁর সাধারণ ঘরটিকে এক
লহমায় স্বর্গের মর্যাদা করে দান। আমি দ্রুত
দাঁড়িয়ে চরণে তাঁর সশ্রদ্ধ প্রমাণ করি নিবেদন।
জানি না হাতের ছোঁয়া তাঁর পেয়েছিল কি না,
মাথাটা আমার। পরমুহূর্তেই দেখি
আমার আঁধার ঘরে রবীন্দ্রনাথের শারীরিক
উপস্থিতি নেই, শুধু রয়ে গেছে অপরূপ চিরন্তন ঘ্রাণ।
০২.০৮.২০০৫
আকাশ এমন দ্রুত কেন কালো
আকাশ এমন দ্রুত কেন কালো হয়ে
গ্রাম আর শহরের অধিবাসীদের
ভীষণ কাঁপিয়ে দিচ্ছে? দৃষ্টি জুড়ে
কী দেখছে তারা আকাশের কালিমায়? ঝাঁক ঝাঁক
ঢের কালো দীর্ঘদেহী শকুন উড়ছে কাঁটাময়
অনাহারে হিংস্র ওষ্ঠ নিয়ে। ওরা ছিঁড়ে খেতে চায়
পথে-হেঁটে-যাওয়া আর বারান্দায় দাঁড়ানো অনেক
নারী পুরুষকে যেন। অকস্মাৎ একত্রে সবাই
লাঠিসোঁটা আর কেউ-কেউ স্টেনগান নিয়ে খুনি
পাখিদের মেরে প্রিয় শহরের আর গ্রামের বাশিন্দা মিলে
তাড়াল নিমেষে দূরে অজানায়। শান্তি এল ফিরে।
২২.১০.২০০৫
আখেরে আঁধারে
ঢের পথ হেঁটে আখেরে আঁধারে
জনহীন স্থানে এক কৃষ্ণকায় দালানের কাছে
এসে থামতেই অকস্মাৎ বড় বেশি
কুচকুচে কালো রুমে দরজার বুক খুলে গেল।
শূন্য, অতিশয় ছমছমে ঘরে অকস্মাৎ চার
দেয়ালের বুক চিরে রক্তধারা বইতে থাকার
সঙ্গে সঙ্গে ক’জন অদেখা যুবতীর
কান্নায় চৌদিক বুকফাটা মাতমের ডেরা হয়!
শোণিতের ধারাময় অন্ধকার ঘর থেকে যত
তাড়াতাড়ি বেরুবার স্পৃহা
জেগে ওঠে মনে, যত পা বাড়াই দরজার দিকে,
তত পদদ্বয় যেন শীতল পাথরে বেশি গেঁথে যেতে চায়।
তবে কি আমার মুক্তি নেই কিছুতেই? তবে কি আখেরে
মরণপ্রতিম চার দেয়ালের ভেতরেই এক
অজানা কঙ্কাল হয়ে থেকে যাব চিরকাল? আখেরে সহসা
বুক-ফাটা শব্দ করে মুক্তি পেতে চাই। পড়ে থাকি যেন পথে!
২৯.০৭.২০০৫