ওকে একটা শস্তা ফ্রক কিনে দিলাম একবার।
ফ্রকটি পেয়ে ও আনন্দে এতোটা লাফিয়ে উঠলো যে আমি খুব
বিব্রত বোধ করলাম।
চিড়িয়াখানায় হরিণ আর খরগোশ দেখে ও যখন ঝলমল করছে।
আমি তখন গাধা দেখানোর জন্যে নিয়ে গেলাম ওকে।
ভেবেছিলাম গাধা ওর ভালো লাগবে না, কিন্তু দেখেই ও
চিৎকার করতে থাকে, গাধাটা কী সুন্দর, গাধাটা কী সুন্দর!
রাস্তায় একবার একটা নোংরা বেড়ালকে
‘কী মিষ্টি’ বলে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলো ও।
খুব শস্তা, চার আনা দামের, লজেন্স ওকে এনে দিলাম একবার।
ভাবলাম ও নিশ্চয়ই ঠোঁট বেঁকোবে; কিন্তু হাতে পেয়েই
মৌলি কী ‘মজার, কী মজার’ বলে ঝলমলে করে তুললো বাড়িঘর।
একজন বাজে ছড়াকার আমাকে উপহার দিয়েছিলো
তার একটি ছড়ার বই। একটা ছড়া পড়েই আমি বাজে কাগজের
ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেললাম সেটা। দুপুরে ঘরে ফিরে দেখি
ও সেটি পড়ছে দুলে দুলে; আর আমাকে দেখেই লাফিয়ে উঠে
একটা ছড়া মুখস্থ শুনিয়ে বললো, ‘আব্বু, ছড়াগুলো কী যে মিষ্টি!’
আমি স্তম্ভিত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
চাঁদ ওর ভালো লাগে, ছাইঅলীকেও ওর ভালো লাগে।
হরিণ ওর ভালো লাগে, গাধাও ওর ভালো লাগে।
ওকে যাই দিই, তাই ওর ভালো লাগে।
ওকে যা দিই না, তাও ওর ভালো লাগে।
ওকে যা দেখাই, তাই ওর ভালো লাগে।
ওকে যা দেখাই না, তাও ওর ভালো লাগে।
ও যখন একটা গণ্ডারের ছবি বা দেয়ালের টিকটিকির দিকে
মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, তখন ভেতরে আমি তীব্র বিষের ক্রিয়া
বোধ করি; আর বারবার ভাবি যদি
ওর মতো আমারও সব কিছু ভালো লাগতো।
যা কিছু আমি ভালোবাসি
কী অদ্ভুত সময়ে বাস করি।
যা কিছু আমি ভালোবাসি তাদের কথাও বলতে পারি না।
বলতে গেলেই মনে হয় আমি যেনো চারপাশের
সমস্ত শোষণ, পীড়ন, অন্যায়, ও প্রতিক্রিয়াশীলতাকে
সমর্থন করি।
রজনীগন্ধার নাম উচ্চারণ করতে গেলেই মনে হয়
আমি যেনো চাই রাস্তায় উলঙ্গ যে-শিশুটি অনাহারে চিৎকার করছে
সে চিরকাল এভাবেই চিৎকার করুক।
কৃষ্ণচূড়ার লাল মেঘের দিকে মুগ্ধচোখে তাকাতে গেলেই
মনে হয় আমি যেনো পৃথিবীব্যাপী সামরিক শাসন ও সমরবাদকে
সমর্থন করি।
আমার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে গেলেই মনে হয়
আমি যেনো ভুলে গেছি পৃথিবীর কোনো চুল্লিতে
এ-মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে পৃথিবীধ্বংসী একটা পারমাণবিক বোমা।
কবিতার কোনো পংক্তি অন্যমনস্কভাবে আবৃত্তি করার সাথে সাথে
মনে হয় আমি যেনো সাম্রাজ্যবাদকে দৃঢ়ভাবে
সমর্থন করছি।
ওই মেঘের দিকে তাকানোর সময় মনে হয়
আমি যেনো রাষ্ট্রযন্ত্রের সমস্ত
বদমাশিকে সমর্থন করি।
যখন আত্মার ভেতরে গুঞ্জরণ করে গীতবিতানের কোনো পংক্তি
তখন মনে হয় আমি যেনো ইস্কুলে যাওয়ার পথে
অপমৃত শিশুদের কথা ভুলে গেছি।
একটি ইন্দ্রিয়কাঁপানো চিত্রকল্প সৃষ্টির মুহূর্তে মনে হয়
আমি যেনো কৃষ্ণ বিদ্রোহী কবির মৃত্যুদণ্ডকে
সমর্থন করি।
আর ‘তোমাকে ভালোবাসি’
বলার সময় মনে হয় আমি যেনো ত্রিশ লক্ষ মানুষের
মৃত্যু আর বাঙলার স্বাধীনতার সঙ্গে
বিশ্বাসঘাতকতা করছি।
শ্রেষ্ঠ শিল্প
শিল্পের লক্ষ্য সুখ, বলেছে শিলার।
আমাদের মিলনই শ্রেষ্ঠ শিল্প—
এর বেশি সুখ আছে আর!
সামরিক আইন ভাঙার পাঁচ রকম পদ্ধতি
তুমি তো জানোই ভালো করে আমাদের অশ্লীল সমাজে
এক রকম সামরিক আইন চিরকালই আছে।
দ্বাদশ শতকে ছিলো, আছে আজো, হয়তো থাকবে আগামী শতকে।
এতে কিন্তু আসলে সুবিধা সকলেরই–অর্থাৎ দালাল ও সুবিধাবাদীরা
অর্থাৎ সমস্ত বাঙালি এতে খুবই সুবিধা বোধ করে। শুধু অসুবিধা
তোমার আমার, প্রিয়তমা। আমরা কি তিলে তিলে বুঝতে পারছি না
সামরিক শাসনে সিদ্ধ সব কিছু; নিষিদ্ধ শুধু আমাদের প্রেম?
তাই প্রেমের নামেই বিভিন্ন পদ্ধতিতে আমাদেরই ভাঙতে হবে
সামরিক সমস্ত বিধান।
সামরিক আইন ভাঙার প্রথম পদ্ধতিটি এতোই নির্দোষ
যে কারোই মনেও হবে না আমরা দুজনে মিলে একটা হিংস্র আইন
অমান্য করেছি। তুমি চৌরাস্তায় বর্বর সব মানুষের সামনে
সভ্যতার প্রথম দীপের মতো তুলে ধরতে পারো তোমার অমল মুখ
আমার সামনে। আমি তার দুর্লভ আলোতে আলোকিত হয়ে
উঠতে পারি সমসাময়িক প্রচণ্ড আঁধারে। এভাবেই
আমরা দুজনে প্রকাশ্যে ভাঙতে পারি সামরিক কয়েকটি বিধান।
সামরিক আইন ভাঙার দ্বিতীয় পদ্ধতিটি আরেকটু স্পষ্ট আর
দৃষ্টিগ্রাহ্য। তুমি আর আমি এইসব প্রেমহীন প্রাণীর জঙ্গলে সব কিছু
অবহেলা করে হাতে রাখতে পারি হাত। প্রকাশ্য রাস্তায় হাতে হাত ধরে
আমরা দুজনে ভাঙতে পারি সামরিক সমস্ত বিধি ও বিধান।
সামরিক আইন ভাঙার তৃতীয় পদ্ধতিটি একটু তীব্র, কিছুটা মারাত্মক।
আমার উদ্দেশে তুমি দৌড়ে আসতে পারো মালিবাগ থেকে আর
তোমার উদ্দেশে আমি ছুটে আসতে পারি সমস্ত বস্তি আর
কলোনি পেরিয়ে। পিজি হাসপাতালের চৌরাস্তায় কোটি কোটি
চোখের সামনে আমরা তীব্র আলিঙ্গনে বাঁধতে পারি পরস্পরকে।
আলিঙ্গনে জ্বলে উঠে অত্যন্ত প্রকাশ্যে আমরা ভাঙতে পারি ১৭৪
নম্বর সামরিক নির্দেশ।
সামরিক আইন ভাঙার চতুর্থ পদ্ধতিটি ওইসব মিছিল, শ্লোগান, পোস্টার,
বক্তৃতার চেয়ে বহুগুণে কার্যকর। আমরা দুজনে সমস্ত কামানবন্দুক
অবহেলা করে ময়লার মতো বয়ে যাওয়া মানুষ আর যানবাহনের
মধ্যে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে সুদীর্ঘ চুম্বনে রঙিন করে
তুলতে পারি সমগ্র বাঙলাকে। একটি প্রকাশ্য চুম্বনে আমরা খান খান
করে ভেঙে দিতে পারি হাজার বছর বয়স্ক বাঙলার
সামরিক আইন ও বিধান।