- বইয়ের নামঃ হুমায়ুন আজাদের সংকলিত কবিতা
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আত্মহত্যার অস্ত্রাবলি
রয়েছে ধারালো ছোরা স্লিপিং টেবলেট
কালো রিভলবার
মধ্যরাতে ছাদ
ভোরবেলাকার রেলগাড়ি
সারিসারি বৈদ্যুতিক তার।
স্লিপিং টেবলেট খেয়ে অনায়াসে ম’রে যেতে পারি
বক্ষে ঢোকানো যায় ঝকঝকে উজ্জ্বল তরবারি
কপাল লক্ষ্য ক’রে টানা যায় অব্যর্থ ট্রিগার
ছুঁয়ে ফেলা যায় প্রাণবাণ বৈদ্যুতিক তার
ছাদ থেকে লাফ দেয়া যায়
ধরা যায় ভোরবেলাকার রেলগাড়ি
অজস্র অস্ত্র আছে
যে-কোনো একটি দিয়ে আত্মহত্যা ক’রে যেতে পারি
এবং রয়েছো তুমি
সবচেয়ে বিষাক্ত অস্ত্র প্রিয়তমা মৃত্যুর ভগিনী
তোমাকে ছুঁলে
দেখলে এমনকি তোমার নাম শুনলে
আমার ভেতরে লক্ষ লক্ষ আমি আত্মহত্যা করি।
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় ?
তেমন যোগ্য সমাধি কই ?
মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো
অথবা সুনীল-সাগর-জল-
সব কিছু ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই !
তাইতো রাখি না এ লাশ আজ
মাটিতে পাহাড়ে কিম্বা সাগরে,
হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।
গোলাপ ফোটাবো
ওষ্ঠ বাড়িয়ে দাও গোলাপ ফোটাবো,
বঙ্কিম গ্রীবা মেলো ঝরনা ছোটাবো।
যুগল পাহাড়ে পাবো অমৃতের স্বাদ,
জ্ব’লে যাবে দুই ঠোঁটে একজোড়া চাঁদ।
সুন্দরীর নৌকো ঢুকাবো বঙ্গোপসাগরে,
অতলে ডুববো উত্তাল আশ্বিনের ঝড়ে।
শিউলির বোঁটা থেকে চুষে নেবো রস,
এখনো আমার প্রিয় আঠারো বয়স।
তোমার পুষ্পের কলি মধুমদগন্ধময়,
সেখানে বিন্দু বিন্দু জমে আমার হৃদয়।
তোমার ক্ষমতা
তুমি ভাঙতে পারো বুক শুষে নিতে পারো সব রক্ত ও লবণ
বিষাক্ত করতে পারো ঘুম স্বপ্নময় ঘুমের জগত
তছনছ ক’রে দিতে পারো তুমি বন উপবন
উল্টেপাল্টে দিতে পারো সব সিঁড়ি লিফট্ রাজপথ
মিশিয়ে দিতেও পারো সঙ্গীতের সুরেসুরে বিষ
আমাকে প্রগাঢ় কোনো আত্নহত্যায় উৎসাহিত ক’রে দিতে পারো
ম’রে যাবে ধানক্ষেত ঝ’রে যাবে পাখিদের শিস
তোমার ক্ষমতা আছে পারো তুমি আরো
আমাকে মাতাল ক’রে ছেড়ে দিতে পারো তুমি গলির ভেতরে
সমস্ত সড়কে তুমি জ্বালতে পারো লাল সিগনাল
বিদ্যুৎপ্রবাহ বন্ধ ক’রে দিতে পারো জীবনের সবগুলো ঘরে
এর বেশি আর তুমি কি পারো তমাল?
প্রেমিকার মৃত্যুতে
খুব ভালো চমৎকার লাগছে লিলিআন,
মুহুর্মুহু বিস্ফোরণে হবো না চৌচির।
তরঙ্গে তরঙ্গে ভ্রষ্ট অন্ধ জলযান
এখন চলবে জলে খুব ধীরস্থির।
অন্য কেউ ঢেলে নিচ্ছে ঠোঁট থেকে লাল
মাংস খুঁড়ে তুলে নিচ্ছে হীরেসোনামণি;
এই ভয়ে কাঁপবে না আকাশপাতাল,
থামবে অরণ্যে অগ্নি আকাশে অশনি।
আজ থেকে খুব ধীরে পুড়ে যাবে চাঁদ,
খুব সুস্থ হয়ে উঠবে জীবনযাপন।
অন্নে জলে ঘ্রাণে পাবো অবিকল স্বাদ,
চিনবো শত্রুর মুখে কারা-বা আপন।
বুঝবো নিদ্রার জন্যে রাত্রি চিরদিন,
যারা থাকে ঘুমহীন তারা গায় গান।
রঙিন রক্তের লক্ষ্য ঠাণ্ডা কফিন;
খুব ভালো চমৎকার লাগছে লিলিআন।
বাঙলাদেশের কথা (আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম)
যখন আমরা বসি মুখোমুখি, আমাদের দশটি আঙুল হৃৎপিন্ডের মতো কাঁপতে থাকে
দশটি আঙুলে, আমাদের ঠোঁটের গোলাপ ভিজে ওঠে আরক্ত শিশিরে,
যখন আমরা আশ্চর্য আঙুলে জ্বলি, যখন আমরাই পরষ্পরের স্বাধীন স্বদেশ,
তখন ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করো না;
আমি তা মূহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।
তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি,
অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমন্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,
মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না;
আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, – তার অনেক কারণ রয়েছে ।
তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্ট ভ্রষ্ট ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ
মাইলের কথা: তার রাজনীতি
অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যম-লী
জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ
মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন
করে আমাকে পীড়ন কোরো না
তার ধানক্ষেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমনীয়, গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী,
কিন্তু প্রিয়তমা, বাঙলাদেশের কথা তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেয়ো না;
আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না, তার অনেক কারণ রয়েছে।