- বইয়ের নামঃ যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল
- লেখকের নামঃ হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশনাঃ আগামী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
তোমার খবরের জন্য যে আমি খুব ব্যাকুল,
তা নয়। তবে ঢাকা খুবই ছোট্ট শহর। কারো কষ্টের
কথা এখানে চাপা থাকে না। শুনেছি আমাকে
ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
প্রত্যেক রাতে সেই ঘটনার পর নাকি আমাকে মনে পড়ে
তোমার। পড়বেই তো, পৃথিবীতে সেই ঘটনা
তুমি-আমি মিলেই তো প্রথম সৃষ্টি করেছিলাম।
যে-গাধাটার হাত ধরে তুমি আমাকে ছেড়ে গেলে সে নাকি এখনো
তোমার একটি ভয়ংকর তিলেরই খবর পায় নি।
ওই ভিসুভিয়াস থেকে কতটা লাভা ওঠে তা তো আমিই প্রথম
আবিষ্কার করেছিলাম। তুমি কি জানো না গাধারা কখনো
অগ্নিগিরিতে চড়ে না?
তোমার কানের লতিতে কতটা বিদ্যূৎ আছে, তা কি তুমি জানতে?
আমিই তো প্রথম জানিয়েছিলাম ওই বিদ্যূতে
দপ ক’রে জ্বলে উঠতে পারে মধ্যরাত।
তুমি কি জানো না গাধারা বিদ্যূৎ সম্পর্কে কোনো
খবরই রাখে না?
আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর শুনেছি তুমি খুব কষ্টে আছো।
যে-গাধাটার সাথে তুমি আমাকে ছেড়ে চ’লে গেলে সে নাকি ভাবে
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত শয্যাকক্ষে কোনো শারীরিক তাপের
দরকার পড়ে না। আমি জানি তোমার কতোটা দরকার
শারীরিক তাপ। গাধারা জানে না।
আমিই তো খুঁজে বের করেছিলাম তোমার দুই বাহুমূলে
লুকিয়ে আছে দু’টি ভয়ংকর ত্রিভুজ। সে-খবর
পায় নি গাধাটা। গাধারা চিরকালই শারীরিক ও সব রকম
জ্যামিতিতে খুবই মূর্খ হয়ে থাকে।
তোমার গাধাটা আবার একটু রাবীন্দ্রিক। তুমি যেখানে
নিজের জমিতে চাষার অক্লান্ত নিড়ানো, চাষ, মই পছন্দ করো,
সে নাকি আধ মিনিটের বেশি চষতে পারে না। গাধাটা জানে না
চাষ আর গীতবিতানের মধ্যে দুস্তর পার্থক্য!
তুমি কেনো আমাকে ছেড়ে গিয়েছিলে? ভেবেছিলে গাড়ি, আর
পাঁচতলা ভবন থাকলেই ওষ্ঠ থাকে, আলিঙ্গনের জন্য বাহু থাকে,
আর রাত্রিকে মুখর করার জন্য থাকে সেই
অনবদ্য অর্গান?
শুনেছি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর তুমি খুবই কষ্টে আছো।
আমি কিন্ত কষ্টে নেই; শুধু তোমার মুখের ছায়া
কেঁপে উঠলে বুক জুড়ে রাতটা জেগেই কাটাই, বেশ লাগে,
সম্ভবত বিশটির মতো সিগারেট বেশি খাই।
আমাদের ভালোবাসা
আমাদের ভালোবাসা
একশো মাইল বেগে ঝড় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বয়ে যেতে পারে না কখনো।
আধঘণ্টায় মেঘ ও মানুষ ও গাছপালার হৃৎপিণ্ডে
নতুন জন্মের প্রচণ্ড চিৎকার পুরে দিয়ে মিশে যায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
দিনের পর দিন অবিরাম চলতে পারে না ভূমিকম্প।
মাটি ও মানুষকে কয়েক মুহূর্তে থরথর করে
আলোড়িত এলোমেলো করে থেমে যায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
স্থিরবিদ্যুৎ বলে কিছু নেই নতুন মেঘের আকাশে।
আকাশের এপারওপার একটি তীক্ষ্ণ ছুরিকায় ছিঁড়েফেড়ে
জীবনের মতো অন্ধকার ঝলসে দিয়ে মুহূর্তেই নিভে যায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
পদ্মায় জোয়ার স্থির হয়ে থাকে না কোনো দিন।
তীব্র স্রোতে তার সব রক্তনালি ভরে দিয়ে
গড়িয়ে পড়ে অবধারিত ভাঁটায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
বাঙলার বসন্ত থাকে কয়েক সপ্তাহ।
বনের পর বন উতলা আর হলদে আর চঞ্চল আর লাল
করে চলে যায় অধীর বসন্ত
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
চৈত্রের গোলাপ টকটকে লাল হয়ে জ্বলে তিন চার দিন।
দীর্ঘশ্বাসের মতো এক গোপন বাতাসে
অগোচরে ঝরে যায় অমল পাপড়ি
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
আমাদের দীর্ঘশ্বাসের আয়ু এতো কম।
রক্ত-মাংস আর বুকের ভেতর দিয়ে ঠাণ্ডা নদীর মতো
বয়ে গিয়ে নিঃশেষে মিলায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
তোমার চোখের পাতায় অশ্রুবিন্দু এতো সুন্দর ক্ষণায়ু।
আমাদের অস্তিত্বের মতো টলমল করে উঠে
মুহূর্তেই অনন্তে ঝরে যায়
যে-রকম আমাদের ভালোবাসা।
আমার চোখের সামনে
আমার চোখের সামনে প’চে গ’লে নষ্ট হলো কতো শব্দ,
কিংবদন্তি, আদর্শ, বিশ্বাস। কতো রঙিন গোলাপ
কখনোবা ধীরে ধীরে, কখনো অত্যন্ত দ্রুত, পরিণত হলো
নোংরা আবর্জনায়।
আমার বাল্যে ‘বিপ্লব’ শব্দটি প্রগতির উত্থান বোঝাতো।
যৌবনে পা দিতে-না-দিতেই দেখলাম শব্দটি প’চে যাচ্ছে–
ষড়যন্ত্র, বুটের আওয়াজ, পেছনের দরোজা দিয়ে
প্রতিক্রিয়ার প্রবেশ বোঝাচ্ছে।
‘সংঘ’ শব্দটি গত এক দশকেই কেমন অশ্লীল হয়ে উঠেছে।
এখন সংঘবদ্ধ দেখি নষ্টদের, ঘাতক ডাকাত ভণ্ড আর
প্রতারকেরাই উদ্দীপনাভরে নিচ্ছে সংঘের শরণ। যারা
মানবিক, তারা কেমন নিঃসঙ্গ আর নিঃসংঘ ও
অসহায় হয়ে উঠছে দিনদিন।
আমার চোখের সামনে শহরের সবচেয়ে রূপসী মেয়েটি
প্রথমে অভিনেত্রী, তারপর রক্ষিতা, অবশেষে
বিখ্যাত পতিতা হয়ে উঠলো।
এক দশক যেতে-না-যেতেই আমি দেখলাম
বাঙলার দিকে দিকে একদা আকাশে মাথা-ছোঁয়া মুক্তিযোদ্ধারা
কী চমৎকার হয়ে উঠলো রাজাকার।
আর আমার চোখের সামনেই রক্তের দাগ-লাগা সবুজ রঙের
বাঙলাদেশ দিন দিন হয়ে উঠলো বাঙলাস্তান।
আর্টগ্যালারি থেকে প্রস্থান
দুই যুগ আগে সবে শুরু হয়েছে তখন আমার যৌবন।
কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি যেমন বাঁশির অভ্যন্তর আলোড়িত
হয় সুরে সুরে, সুন্দরে সৌন্দর্যে। স্বপ্নে জাগরণে শুধু চাই
সুন্দর ও সৌন্দর্যকে; আর কিছুকেই চাওয়ার যথেষ্ট যোগ্য
বলে ভাবতেও পারি না। ঘৃণা করি সব কিছু, তীব্র ঘৃণা করি
মুদ্রাকে, তোমরা যেমন ঘৃণা করো আবর্জনাকে। ধ্যান করি
শুধু সুন্দরের, সৌন্দর্যের। অথচ আমার চারদিকে শুধু
পরিব্যাপ্ত বাস্তবতা, আর সেই অশ্লীল নোংরা কদর্যতা,
যাকে মানুষেরা পুজো করে ‘জীবন’ অভিধা দিয়ে। ভিখিরিরা
যাকে সযত্নে লালন করে, বিকলাঙ্গ যাকে ধরে রাখে সারা অঙ্গে;
কুষ্ঠরোগী যাকে বোধ করে দেহের প্রতিটি ক্ষতে; রূপসীর
রূপ যার খাদ্য হয়ে পরিণত হয় মলে। আমি প্রাণভ’রে।
ঘেন্না করেছি সেই কুৎসিত, নোংরা, তুচ্ছ জীবনকে।
আমি চেয়েছি সুন্দর, আর সৌন্দর্যকে, আর শিল্পকলাকে,
জীবনের চেয়েও যা শাশ্বত ও মূল্যবান। আমার দয়িতা
ছিলো বিমানবিক সুন্দর, যা নেই নারীতে, রৌদ্রে, মেঘে, জলে,
পাখিতে, পশুতে, পুষ্পে। আছে শুধু শিল্পে, শাশ্বত শিল্পকলায়।
সৌন্দর্যের খোঁজে আমি ঢুকে গিয়েছিলাম কলামন্দিরে; এবং ঢুকেই
সেঁটে দিয়েছিলাম সমস্ত দরোজা; এবং ভুলে গিয়েছিলাম
দরোজা খোলার মন্ত্র, জানালা খোলার সব গোপন কৌশল।
আমি মনে রাখতে চাই নি; আমি জানতাম ওই সৌন্দর্যের
গ্যালারিতে প্রবেশের পর আমার কখনো আর দরকার
পড়বে না জীবনে ঢোকার। ওই মানুষেরা যাকে সুখ বলে,
আমি তার চেয়ে অনেক বিশুদ্ধ কিছু পেয়েছি আমার বুকে,
জীবনপাগল মানুষেরা যা কখনো বুঝতে পারবে না।
দুই যুগ ধরে আমি সৌন্দর্যের গ্যালারিতে সৌন্দর্য যেপেছি।
আমার সম্মুখে ছিলো অনিন্দ্য সুন্দর, আর পশ্চাতে বিশুদ্ধ
সৌন্দর্য। চারপাশে অনশ্বর শিল্পকলা : চোখের মণিতে গাঁথা
থাকতো সবুজ রঙের চাঁদ; মণিমাণিক্যের দ্যুতি নাচতো করতলে
অহর্ণিশ; এমন সুগন্ধ উঠতো বুক জুড়ে যা কোনো ইন্দ্রিয়
দিয়ে উপভোগ্য নয়। অতীন্দ্রিয় স্বাদেগন্ধে ভ’রে ছিলো রক্তমাংস;
এমন নারীরা ছিলো যারা শুধু স্তবযোগ্য, সম্ভোগের জন্যে
যারা নয়। দুই যুগ ধরে আমি আমার অজস্র চোখ
নিবদ্ধ রেখেছি সৌন্দর্যের পদতলে ফোঁটা একটি পুষ্পের
শতদলে; দুই যুগ ধরে আমি আমার ওষ্ঠকে মানবিক
কোনো স্থূল স্বাদ আস্বাদ করতে দিই নি। যা কিছু শিল্প নয়
এমন কিছুর স্বাদ নিতে ভুলে গিয়েছিলো আমার ওষ্ঠ।
সৌন্দর্য ও শিল্পকলা ছাড়া আর সব কিছু দেখতে অনভ্যস্ত
হয়ে ওঠে আমার সমস্ত চোখ। আমার শরীর ভুলে যায়
সৌন্দর্যপ্রবাহ ছাড়া আর কোনো প্রবাহ রয়েছে।
যা কিছু পচনশীল, যা কিছু মাংসে গঠিত আমার তা নয়;
আমি তার নই। পার্থিব পুষ্প দেখেছি; জলাশয়ে প্রাণবন্ত
মাছ, আর বনভূমে পশুপাখি অনেক দেখেছি। পৃথিবী যে
রমণীয়, তার মৌল কারণ যে-রমণীরা, তাদেরও দেখেছি।
কিন্তু সবই পচে যায়, মানবিক সব কিছু প’চে নষ্ট হয়ে
যায়। শুধু থাকে শিল্পকলা, যা কিছু পবিত্র শুদ্ধ অনশ্বর,
যার জন্যে আমার জীবন আমি ভত্যদের বকশিশ দিয়ে দিতে পারি।
দুই যুগ পরে আস্তে আমার চোখের সামনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে
খুলে যায় আর্টগ্যালারির দরোজাজানালা। দরোজার কথা
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম পুরোপুরি, আর যে-কোনো গৃহে যে
জানালা গবাক্ষ থাকে, আমার স্মৃতিতে তা একেবারেই ছিলো না।
আমি কেনো মনে রাখবো প্রবেশ বা প্রস্থানের পথ, বাহ্যজগত?
একটি দরোজাকে শিল্পকলা ভেবে এগোতেই ইট-কাঠ-কাঁচ
চুরমার করে আর্টগ্যালারিতে ঢোকে সদ্যভূমিষ্ঠ এক
শিশুর চিৎকার; আর সমস্ত গ্যালারি কেঁপে ওঠে ভূমিকম্পে।
আমি বাইরে বেরোই : দুটি ছাগশিশু নাচছিলো সমস্ত শিল্পিত
হরিণের চেয়ে সুন্দর ভঙ্গিতে, মুখে কাঁপছিলো সবুজ কাঁঠাল
পাতা, যুবকের রক্তে রূপময় হয়ে উঠছিলো চৌরাস্তার
শুকনো কংক্রিট, যুবতীর অবিনাশী অশ্রুতে ফুটে উঠছিলো
দিকে দিকে গন্ধরাজ রঙিন গোলাপ। দুই যুগ পরে।
আমি জীবনশিল্পের মধ্যে টলতে টলতে হুঁ হুঁ করে উঠি।
একবারে সম্পূর্ণ দেখবো
তোমাকে প্রথম দেখি মুখোমুখি; শুধু মুখটিই চোখে পড়ে।
ওই মুখে চোখ, ঠোঁট, একটা বিস্ময়কর তিল ছিলো
সে-সব পৃথকভাবে লক্ষ্য করি নি। শুধু একটি মুখই দেখেছি।
তারপর একবার দেখি তুমি হেঁটে যাচ্ছো; তোমার গ্রীবার
সৌন্দর্যই শুধু আমার দু-চোখে ঢোকে;–গ্রীবা নয়,
গ্রীবার সৌন্দর্যকেই শুধু সত্য মনে হয়। তারপর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে
তোমাকে দেখেছি; কিন্তু সম্পূর্ণ দেখি নি। করতল দেখার সময়
দেখতে পাই নি হাতের পেছন ভাগ, খোঁপার গঠন
দেখার সময় আমার দু-চোখ থেকে অন্তহীন দূরত্বে থেকেছে
তোমার চিবুক। পরম সত্যের মতো উদঘাটিত স্তনের দিকে
নিবদ্ধ রেখেছি চোখ যুগযুগ; আর ওই সৌন্দর্যমথিত
যুগযুগান্তরব্যাপী আমি দেখতে পাই নি তোমার পিঠের
রূপ, তার ঢেউ রেখা বাক ও অন্যান্য খণ্ড সত্য।
তোমার পায়ের তালুতে একটা উল্লেখযোগ্য জ্যোতিশ্চক্র রয়েছে;
ওই জ্যোতিশ্চক্রে নিবদ্ধ থাকার কালে দেখতে পাই নি
জ্যোতির্ময় আশ্চর্য ত্রিভুজ। আমি শুধু এক সত্য থেকে আরেক সত্যে
পৌঁচেছি তোমাকে প্রথম দেখার আশ্চর্য মুহূর্ত
থেকে। তুমি কি পরম সত্য? তোমাকে কখন
আমি একবারে, এক দৃষ্টিতে, আপাদমস্তকআত্মা সম্পূর্ণ দেখবো?
এপিটাফ
এখানে ঘুমিয়ে আছে–কবি।
স্ত্রী যাকে ভালোবাসতো
উপস্ত্রী যাকে ভালোবাসতো
প্রেমিকা যাকে ভালোবাসতো।
এখানে ঘুমিয়ে আছে–কবি।
স্ত্রী যাকে ঘৃণা করতো
উপস্ত্রী যাকে ঘৃণা করতো
প্রেমিকা যাকে ঘৃণা করতো।
এসো, হে অশুভ
চারদিকে শুনছি তোমার রোমাঞ্চকর কণ্ঠস্বর।
মেঘে মেঘে ঝিলিক দিচ্ছে তোমার দীর্ঘ শরীরের রূপরেখা।
ঘন কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়ছে পুব থেকে পশ্চিমে,
উত্তর থেকে দক্ষিণে, মেঘ থেকে মাটিতে।
তোমার ঢেউ খেলানো মস্তক থেকে পল্লীর পথপ্রান্তে খ’সে পড়ছে
দু-চারটি ঝলমলে বিস্ময়কর চুল,
তোমার হাত থেকে খসে পড়া অশুভ রুমালে ঢেকে যাচ্ছে
শহরের পর শহর, সমুদ্র আর বিমানবন্দর।
হে অশুভ, হে অশুভ, হে সমকালীন দেবতা, তুমি মহাসমারোহে এসো।
তোমার জন্যে খোলা স্থলপথ, তুমি স্থলপথে এসো।
তোমার জন্যে খোলা জলপথ, তুমি জলপথে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সমস্ত আকাশ, তুমি আকাশপথে এসো।
হে অশুভ, হে অশুভ, হে সমকালীন দেবতা, তুমি মহাসমারোহে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সব গৃহ, তুমি সব গৃহে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সব প্রাঙ্গণ, তুমি সব প্রাঙ্গণে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সব মন্দির, তুমি সব মন্দিরে এসো।
হে অশুভ, তুমি ফাল্গুনের ফুল হয়ে এসো
হে অশুভ, তুমি চৈত্রের কৃষ্ণচুড়া হয়ে এসো
হে অশুভ, ঝড় হয়ে এসো তুমি বোশেখের প্রত্যেক বিকেলে
হে অশুভ, শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে এসো তুমি অঝোর ধারায়।
এখানে কি কেউ জনককে হত্যা করে জননীর সাথে
লিপ্ত অজাচারে? বাঙলা কি পৃথিবীর নতুন করিন্থ?
হে অশুভ, দিন হয়ে এসো তুমি রাত্রি হয়ে এসো
হে অশুভ, সূর্য হয়ে ওঠো পুবে চাঁদ হয়ে ওঠো পশ্চিমে
হে অশুভ, শস্য হয়ে ফুলে ওঠো প্রতিটি পাকা ধান্যবীজে
হে অশুভ, হে সমকালীন বাঙলার দেবতা,
তুমি সমস্ত দিক আর দিগন্ত থেকে এসো।
পাড়ার গুণ্ডা হয়ে এসো তুমি পাড়ায় পাড়ায়
ধর্ষণকারী হয়ে এসো তুমি প্রতিটি রাস্তায়
ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে থাকো বালিকা বিদ্যালয়ের পাশের গলিতে
দশটা হেডলাইট জ্বালিয়ে এসো শহরের প্রধান সড়কে
এসো তুমি সাইলেন্সরহীন মোটর সাইকেলে
এসো তুমি দূরপাল্লার লাকশারি কোচে
হে অশুভ, হে সমকালীন বাঙলার দেবতা, সর্বব্যাপী
হয়ে তুমি এসো।
এসো বুট পায়ে ইউনিফর্ম প’রে
এসো পতাকাখচিত মার্সিডিস চ’ড়ে
এসো বাসে ঝুলে রিকশায় চেপে
এসো ব্যাংকের কাউন্টারে ঝলমলে নোটের বাণ্ডিল হয়ে
এসো গ্রন্থাগারে সারিসারি গ্রন্থ হয়ে
আমার ছাত্র হয়ে এসো তুমি ঘণ্টায় ঘণ্টায়
অধ্যাপক হয়ে এসো শ্রেণীতে শ্রেণীতে
এসো সচিব ও যুগ্ম সচিব হয়ে
এসো মন্ত্রী হয়ে
ব্যবস্থাপক হয়ে এসো সংস্থায় সংস্থায়।
হে অশুভ, তুমি প্রেমিকপ্রেমিকার প্রেমালাপে এসো
হে অশুভ, তুমি প্রত্যেকের চুম্বনে আলিঙ্গনে এসো
হে অশুভ, প্রতিটি শয্যায় তুমি পুলক হয়ে এসো
হে অশুভ, তুমি প্রতিটি কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে
এসো হে অশুভ, তুমি আমাদের প্রত্যকের প্রার্থনায় এসো
হে অশুভ, ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল হয়ে তুমি এসো।
ও ঘুমোয়, আমি জেগে থাকি
আমার দেড় বছরের মেয়ে স্মিতা কিছুতেই ঘুমোতে চায় না।
মায়ের চুমো আর রূপকথা কিছুতেই ওকে ঘুম পাড়াতে পারে না।
মাঝে মাঝে আমার ওপর ওকে ঘুম পাড়ানোর ভার পড়ে–
যেনো আমি যাদু জানি যা দিয়ে ওর মতো চাঞ্চল্যকে
আমি নিমেষেই নিশ্চল করে দিতে পারি।
মাঝে মাঝে আমারও খুব ঘুম পায়। ঘুমে চোখ ভেঙে আসে,
দেহ ভেঙে পড়ে। ওকে ডাকি, ‘এসো আব্বু, আমরা ঘুমোই।’
ও কিছুতেই ঘুমোবে না–মেঝেতে চঞ্চল পায়ে নাচতে থাকে,
আলনা থেকে টেনে নামায় কাপড়চোপড়, দাদুর জুতোর ভেতর পা ঢুকিয়ে
ভ্রমণ করতে থাকে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে। চোখে ঘুম নেই।
কিন্তু আমার চোখ ভ’রে ঘুম, সন্ধ্যায়ই ভেঙে পড়ছি বৃদ্ধের মতোন।
চিৎকার করে ডাকি, ‘এসো আব্বু, আমরা ঘুমোই।’
ও কিছুতে আসে না। আমি জোর করে তুলি ওকে বিছানায়, পাশে শোয়াই
জোর করে। ও চিৎকার করে কাঁদে, কিছুতেই ও ঘুমোবে না।
কিন্তু আমি যে নিদ্রায় কাতর। এক সময় হঠাৎ টের পাই
ও ঘুমিয়ে গেছে মধ্যরাতে দিঘির জলের মতো; আমি জেগে আছি।
দেয়াল ঘড়িটা তখন তিনবার বজ্রের মতো বেজে ওঠে।
কবি ও জনতাস্তাবকতা
সকলেই আজকাল স্তাবকতা করে জনতার।
স্বৈরাচারী, রাজনীতিব্যবসায়ী, ও তাত্ত্বিকেরা তো বটেই,
জনতার কবিসম্প্রদায়ও অক্লান্ত স্তাবকতা করে জনতার।
স্তাবকতা আত্মোন্নতির উপায় মাত্র; এতে জনতার
কোনো লাভ নেই। স্বৈরাচারী স্তাবকতা করে
সিংহাসনে টেকার জন্যে; রাজনীতিব্যবসায়ী স্তাবকতা
করে সিংহাসনে ওঠার আশায়। তাত্ত্বিকেরা
স্তাবকতা করে, কারণ তাদেরও চোখ নিবদ্ধ
সিংহাসনের আশেপাশে।
জনতার কবিসম্প্রদায়ও লাভের আশায়ই
স্তাবকতা করে জনতার।
তবে যে প্রকৃত কবি, যার ভালোবাসা বিশুদ্ধ প্রকৃত,
সে স্তব করতে পারে, কিন্তু স্তাবকতা
করে না কখনো। সে জানে জনতাও দেবতা নয়;
জনতাও বিপথগামী হয় অন্ধকারে;
পদস্খলিত হয় পিচ্ছিল রাস্তায়। তাই সে স্তাবকতার বদলে
নিজেকেই করে তোলে অগ্নিশিখা, জনতা তখন
পথ খুঁজে পায়। জনতা অনুসরণ করে কবিকে।
কবি, অগ্নিশিখা, কখনো অনুসরণ
করে না জনতাকে।
গরীবদের সৌন্দর্য
গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না।
গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।
গরিবদের ঘরবাড়ি খুবই নোংরা, অনেকের আবার ঘরবাড়িই নেই।
গরিবদের কাপড়চোপড় খুবই নোংরা, অনেকের আবার কাপড়চোপড়ই নেই।
গরিবেরা যখন হাঁটে তখন তাদের খুব কিম্ভুত দেখায়।
যখন গরিবেরা মাটি কাটে ইট ভাঙে খড় ঘাঁটে গাড়ি ঠেলে পিচ ঢালে তখন তাদের
সারা দেহে ঘাম জবজব করে, তখন তাদের খুব নোংরা আর কুৎসিত দেখায়।
গরিবদের খাওয়ার ভঙ্গি শিম্পাঞ্জির ভঙ্গির চেয়েও খারাপ।
অশ্লীল হাঁ ক’রে পাঁচ আঙ্গুলে মুঠো ভ’রে সব কিছু গিলে ফেলে তারা।
থুতু ফেলার সময় গরিবেরা এমনভাবে মুখ বিকৃত করে
যেনো মুখে সাতদিন ধ’রে পচছিলো একটা নোংরা ইঁদুর।
গরিবদের ঘুমোনোর ভঙ্গি খুবই বিশ্রী।
গরিবেরা হাসতে গিয়ে হাসিটাকেই মাটি ক’রে ফেলে।
গান গাওয়ার সময়ও গরিবদের একটুও সুন্দর দেখায় না।
গরিবেরা চুমো খেতেই জানে না, এমনকি শিশুদের চুমো খাওয়ার সময়ও
থকথকে থুতুতে তারা নোংরা করে দেয় ঠোঁট নাক গাল।
গরিবদের আলিঙ্গন খুবই বেঢপ।
গরিবদের সঙ্গমও অত্যন্ত নোংরা, মনে হয় নোংরা মেঝের ওপর
সাংঘাতিকভাবে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে দু’টি উলঙ্গ অশ্লীল জন্তু।
গরিবদের চুলে উকুন আর জট ছাড়া কোনো সৌন্দর্য নেই।
গরিবদের বগলের তলে থকথকে ময়লা আর বিচ্ছিরি লোম সব জড়াজড়ি করে।
গরিবদের চোখের চাউনিতে কোনো সৌন্দর্য নেই,
চোখ ঢ্যাবঢ্যাব ক’রে তারা চারদিকে তাকায়।
মেয়েদের স্তন খুব বিখ্যাত, কিন্তু গরিব মেয়েদের স্তন শুকিয়ে শুকিয়ে
বুকের দু-পাশে দুটি ফোড়ার মতো দেখায়।
অর্থাৎ জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।
শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়
গরু ও গাধা
আজকাল আমি কোনো প্রতিভাকে ঈর্ষা করি না।
মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ এমন কি সাম্প্রতিক ছোটোখাটো
শামসুর রাহমানকেও ঈর্ষাযোগ্য ব’লে গণ্য
করি না; বরং করুণাই করি। বড় বেশি ঈর্ষা
করি গরু ও গাধাকে;–মানুষের কোনো পর্বে গরু
ও গাধারা এতো বেশি প্রতিষ্ঠিত, আর এতো বেশি
সম্মানিত হয় নি কখনো। অমর ও জীবিত
গরু ও গাধায় ভরে উঠছে বঙ্গদেশ; যশ খ্যাতি
পদ প্রতিপত্তি তাদেরই পদতলে। সিংহ নেই,
হরিণেরা মৃত; এ-সুযোগে বঙ্গদেশ ভ’রে গেছে
শক্তিমান গরু ও গাধায়। এখন রবীন্দ্রনাথ
বিদ্যাসাগর বাঙলায় জন্ম নিলে হয়ে উঠতেন
প্রতিপত্তিশালী গরু আর অতি খ্যাতিমান গাধা।
ডানা
একদা অজস্র ডানা ছিলো, কোনো আকাশ ছিলো না।
আকাশ মানেই ছিলো ঝড়, বজ্র, শাণিত বিদ্যুৎ
আর সীমাহীন অন্ধকার। তবু ওই ঝড়ে, বজ্রে, শাণিত বিদ্যুতে
উড়েছি বারবার। ডানা থাকলে ওড়ার জন্যে কোনো
আকাশ লাগে না–ঝড়ই হয়ে ওঠে আকাশ, বিদ্যুৎ নীলিমা।
বজ্ৰ জ্ঞাপন করে আকাশের স্তরেস্তরে ওড়ার উল্লাস।
জানি নি কখন বজ্রে-বিদ্যুতে খসে গেছে সংখ্যাহীন ডানা
আর মুখ থুবড়ে পড়ে গেছি উদ্ধারহীন নর্দমায়।
বহু দিন পর চোখে মেলে দেখি চারদিকে ছড়ানো আকাশ–
নীল হয়ে, তারকাখচিত হয়ে, শরীরে জ্যোৎস্না পরে
ছড়িয়ে রয়েছে–বজ্র নেই, ঝড় নেই, বিদ্যুতের ছুরিকাও নেই।
দূরস্মৃতির মতোন মনে পড়ে বজ্র, আর বিদ্যুৎকে।
উড়েতে গিয়েই দেখি খসে গেছে আমার সে-সংখ্যাহীন ডানা,
আর আমি ঢুকে গেছি স্বপ্নের প্রধান শত্রু অশ্লীল বাস্তবে।
তুমি, বাতাস ও রক্তপ্রবাহ
বাতাসের নিয়মিত প্রবাহ বোধই করা যায় না।
যখন নিশ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক মতো চলে
তখন কে বোধ করে বাতাসের অস্তিত্ব?
স্বাভাবিক রক্তসঞ্চালন টেরই পাওয়া যায় না।
বোঝাই যায় না হৃৎপিণ্ড
অবিরাম সঞ্চালিত করে চলেছে রক্ত শিরায় শিরায়।
সমগ্র শরীর কেঁপে ওঠে
যখন অভাব ঘটে বাতাসের।
ভূমিকম্প হয় যখন ব্যাঘাত ঘটে রক্তপ্রবাহে।
তুমি ওই রক্ত আর বাতাসের মতো
টেরই পাই না তোমাকে।
কিন্তু প্রচণ্ডভাবে বোধ করি তোমার অস্তিত্ব
যখন তোমার অভাব ঘটে
আমার জীবনে।
তোমার দিকে আসছি
অজস্র জন্ম ধরে
আমি তোমার দিকে আসছি
কিন্তু পৌঁছুতে পারছি না।
তোমার দিকে আসতে আসতে
আমার এক একটা দীর্ঘ জীবন ক্ষয় হয়ে যায়
পাঁচ পঁয়সার মোম বাতির মত।
আমার প্রথম জন্মটা কেটে গিয়েছিলো
শুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দেখে,
এক জন্ম আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখেছি।
আমার দুঃখ,
তোমার স্বপ্ন দেখার জন্যে
আমি মাত্র একটি জন্ম পেয়েছিলাম।
আরেক জন্মে
আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পরেছিলাম তোমার উদ্দেশ্য।
পথে বেরিয়েই আমি পলি মাটির উপর আকাঁ দেখি
তোমার পায়ের দাগ
তার প্রতিটি রেখা
আমাকে পাগল করে তোলে।
ঐ আলতার দাগ,আমার চোখ,আর বুক আর স্বপ্নকে
এতো লাল করে তুলে,
যে আমি তোমাকে সম্পূর্ন ভুলে যাই
ঐ রঙ্গীন পায়ের দাগ প্রদক্ষীন করতে করতে
আমার ঐ জন্মটা কেটে যায়।
আমার দুঃখ !
মাত্র একটি জন্ম
আমি পেয়েছিলাম
সুন্দর কে প্রদক্ষীন করার।
আরেক জন্মে
তোমার কথা ভাবতেই-
আমার বুকের ভিতর থেকে সবচে দীর্ঘ
আর কোমল,আর ঠাণ্ডা নদীর মত
কি যেন প্রবাহিত হতে শুরু করে।
সেই দীর্ঘশ্বাসে তুমি কেঁপে উঠতে পারো ভেবে
আমি একটা মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে
কাটিয়ে দেই সম্পুর্ন জন্মটা।
আমার দুঃখ ,আমার কোমলতম দীর্ঘশ্বাসটি ছিল
মাত্র এক জন্মের সমান দীর্ঘ
আমার ষোঁড়শ জন্মে
একটি গোলাপ আমার পথ রোধ করে,
আমি গোলাপের সিঁড়ি বেয়ে তোমার দিকে উঠতে থাকি-
উঁচুতে ! উঁচুতে !! আরো উঁচুতে !!!
আর এক সময় ঝড়ে যাই চৈত্রের বাতাসে।
আমার দু:খ মাত্র একটি জন্ম
আমি গোলাপের পাপঁড়ি হয়ে
তোমার উদ্দেশ্য ছড়িয়ে পরতে পেরেছিলাম।
এখন আমার সমস্ত পথ জুড়ে
টলমল করছে একটি অশ্রু বিন্দু।
ঐ অশ্রু বিন্দু পেরিয়ে এ জন্মে হয়তো
আমি তোমার কাছে পৌঁছুতে পারবনা;
তাহলে ,আগামী জন্ম গুলো আমি কার দিকে আসবো ?
নষ্ট হৃৎপিণ্ডের মতো বাঙলাদেশ
তোমার দুই চির-অপ্রতিষ্ঠিত পুত্র কবি ও কৃষক (নিষাদেরাই
প্রতিষ্ঠিত চিরকাল) তোমার রূপের কথা
রটায় দিনরাত। একজন ধানখেতে তোমার দেহের
স্তব করে যেই গান গেয়ে ওঠে অন্যজন অমনি পুথির ধূসর
পাতা ভরে তোলে সমিল পয়ারে।
একজনকে তুমি এক বিঘে ধান দিলে সে তোমার দশ বিঘে
ভ’রে তোলে গানে। অন্যজনকে যখন তুমি
একটি পংক্তি দাও সে তখন দশশ্লোক স্তব রচে তোমার রূপের।
এ ছাড়া তোমার স্তব কোনো কালে বেশি কেউ
করে নি কখনো, বরং কুৎসাই রটিয়েছে শতকে শতকে।
এখন তো তুমি অপরিহার্য নও তোমার অধিকাংশ পুত্রের জন্যেই।
অনেকের চোখেই এখন মরুভূমি তোমার চেয়েও বেশি
সবুজ ও রূপসী, আর শীতপ্রধান অঞ্চলের উষ্ণতা রক্তেমাংসে
উপভোগে উৎসাহী সবাই, তাই তোমাকে ‘বিদায়’ না ব’লেই তারা
ছেড়ে যাচ্ছে তোমার উঠোন। আর চিরকালই
ঝোপঝাড়ে পাটখেতে ওৎ পেতে আছে অজস্র ধর্ষণকারী।
কতোবার যে দশকে দশকে ধর্ষিতা হয়েছো তুমি, তোমার আর্ত চিৎকার
মিশে গেছে মাঠে ঘাটে তুমি তার হিশেবও রাখো নি।
তুমি সেই কৃষক-কন্যা, যে ধর্ষিতা হলে প্রতিবাদে কোনো দিন
সরব হয় না গ্রাম। আমিও যে খুব ভক্তি করি ভালোবাসি
তোমাকে, তা নয়; ভাগ্যগুণে অন্য গোলার্ধে আমিও বিস্তর রূপসী
দেখেছি। তাদের ওষ্ঠ গ্রীবা বাহু এখনো রক্তে
তোলে ঢেউ, অর্থাৎ তোমার রূপে আমার দু-চোখ অন্ধ হয় নি কখনো।
অপরিহার্য ভাবি না তোমাকে, তবু যেই রক্তে চাপ পড়ে
টের পাই পাঁজরের তলে নষ্ট হৃৎপিণ্ডের মতো বাঙলাদেশ
সেঁটে আছো অবিচ্ছেদ্যভাবে।
পুত্রকন্যাদের প্রতি, মনে মনে
মাতৃগর্ভে অন্ধকারে ছিলে; এখন তথাকথিত
আলোতে এসেছো। ভাবছো চারদিক আলোকখচিত।
অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যা, শিশু পুত্র আমি বারেবারে
স্মরণ করিয়ে দিতে চাই এক কূট অন্ধকারে
আসলে পৌঁচেছো। এ-সূর্য, বিদ্যুৎ, নিঅন টিউব
বড়ো বড়ো বেশি প্রবঞ্চক : পৃথিবীতে অন্ধকার খুব।
পথ দেখানোর ছলে এরা কোনো ভয়াবহ খাদে
পৌঁছে দেবে তোমাদের; বিপজ্জনক সব ফাঁদে
আটকে যাবে। চারদিকে ধ্বনিত হবে আর্ত চিৎকার,
নিজেদের ঘিরে দেখবে থাবা-মেলা ক্রূর অন্ধকার।
তথাকথিত এ-আলো ঠাণ্ডা, দুষ্ট, কদর্য, কুটিল,
চক্রান্তপরায়ণ, অন্ধকারের চেয়েও অশ্লীল।
আর ওই সমাজরাক্ষস, তোমরা যে-দিকেই যাবে
সে-দিকেই মেলে দেবে হিংস্র হাত ধরে গিলে খাবে
সুযোগ পেলেই। তাই সাবধান, একটু ফসকালে
পৌঁছে যাবে উদ্ধাররহিত কোনো নিস্তল পাতালে।
আমি শুধু জন্মদাতা, পিতা নই; জনক যদিও–
এ-বাস্তবে, অন্ধকারে আমি নই অনুসরণীয়।
আমি গেছি যেই পথে সেটা ভুল পথ; গেছে যারা
সরল সঠিক পুণ্য পথে পথপ্রদর্শক তারা
তোমাদের। সামাজিক পিতাদের পদাংক মুখস্থ
কোরো দিনরাত; অক্ষয় ধৈর্যে জেনে নিয়ে সমস্ত
পবিত্র গন্তব্য। কারণ তারাই এই অন্ধকারে
মোক্ষধামে পৌঁছোনোর ঠিক পথ বলে দিতে পারে।
হে পুত্র, তুমি কিছুতেই বিশ্বাস রেখো না। ইস্কুলে
শেখাবে যে-সব মস্ত মিথ্যা, তাতে কখনোও ভুলে
বিশ্বাস কোরো না। তোমার সামনে খোলা যে-পুস্তক
জেনো তা প্রচণ্ড ভণ্ড, মিথ্যাভাষী, আর প্রতারক।
মনে রেখো যারা গলে ওই সব মুদ্রিত মিথ্যায়,
পরাজয় নিয়তি তাদের, তারা ধ্বংস হয়ে যায়।
ঘৃণা কোরো সতোকে সামাজিক পিতাদের মতো
প্রত্যেক মুহূর্তে, অসত্যকে জপ কোরো অবিরত।
সুনীতি বর্জন কোরো, মহত্ত্বের মুখে ছুঁড়ো থুতু,
মনুষ্যত্বকে মাড়াতে দ্বিধাহীন হয় যেনো জুতো
তোমার পায়ের। দুর্বলকে নিশ্চিন্তে পদাঘাত কোরো
পায়ের আভাস পেলে সবলের নত হয়ে পোড়ো
তার দিকে, চিরকাল সবলের থেকো পদানত,
তার পদযুগলের চকচকে পাদুকার মতো।
শত্রু হোয়ো মানুষের, দানবের পক্ষে চিরদিন
দিয়ো জয়ধ্বনি; প্রতিক্রিয়াশীলতার নিশান উড্ডীন
রেখো গৃহে ও গাড়িতে; নিয়ো তুমি প্রত্যহ উদ্যোগ
যাতে পৃথিবীতে পুনরায় ফিরে আসে মধ্যযুগ।
যা কিছুই মানবিক তার শিরে, হে আমার পুত্র,
সকালে দুপুরে রাত্রে ঢেলো তুমি মল আর মূত্র।
তুমি তো জানো না কন্যা, শ্যামলাঙ্গী, অমৃত হৃদয়া,
চলছে আজ উজ্জ্বল পতিতাবৃত্তি, এবং মৃগয়া
এ-গ্রহে, পৃথিবীতে পতিতারাই প্রসিদ্ধ এখন।
জেনো প্রতিভা-সৌন্দর্য নয় শুধু যৌন আবেদন
তোমার সম্পদ। শিখে নিয়ে তুমি তার নিপুণ প্রয়োগ,
চিত্ত নয়, দেহ দিয়ে পৃথিবীকে কোরো উপভোগ।
তোমাকে সম্ভোগ করতে দিয়ো না কাউকে; প্রীতি-স্নেহ
থেকে দূরে থেকো; যাকে ইচ্ছে হয় তাকে দিয়ে দেহ,
কিন্তু কক্ষণো কাউকে হৃদয় দিয়ো না। তুমি তবে
পরিণত হবে লাশে; আমন্ত্রিত হবে না উৎসবে।
পুত্র তুমি জপ কোরো দিনরাত–টাকা, টাকা, টাকা,
টাকা, টাকা। একমাত্র ওই বস্তু ইন্দ্রজাল মাখা
পৃথিবীতে; সব কিছু নষ্ট হয়, সবই নশ্বর;
টিকে থাকে শুধু টাকা–শক্তিমান, মেধাবী, অমর।
জেনো পুত্র মহত্ত্বে গৌরব নেই, কালোবাজারিতে
নিহিত গৌরব; অমর্ত্য গীতাঞ্জলির থেকে পৃথিবীতে
জুতোও অনেক দামি, অমরত্বের চেয়ে শোনো প্রিয়,
বহুগুণে মনোরম শীততাপনিয়ন্ত্রিত গৃহ।
ভুল পথে, আমার মতোন, যেয়ো নাকো; অবিকল
হয়ো তুমি সামাজিক পিতাদের মতোই গাড়ল।
মাতৃগর্ভে অন্ধকারে ছিলে; এখন তথাকথিত
আলোতে এসেছো। ভাবছো চারদিক আলোকখচিত।
অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যা, শিশু পুত্র আমি বারেবারে
স্মরণ করিয়ে দিতে চাই এক কূট অন্ধকারে
আসলে পৌঁচেছে। এ-সূর্য, বিদ্যুৎ, নিঅন টিউব
বড়ো বেশি প্রবঞ্চক : পৃথিবীতে অন্ধকার খুব।
বিজ্ঞাপন : বাঙলাদেশ ১৯৮৬
হ্যাঁ, আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাকে আমরা খুঁজছি।
যদি আপনার কোনো মগজ না থাকে, শুধু পেশি থাকে
যদি আপনার কোনো হৃৎপিণ্ড না থাকে, শুধু লিঙ্গ থাকে
যদি আপনার কোনো ওষ্ঠ না থাকে, শুধু দাঁত থাকে
তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাকে আমরা খুঁজছি
যদি আপনি অবলীলায়, একটুও না কেঁপে, শিশুপার্কে
একঝাঁক কবুতরের মতো ক্রীড়ারত শিশুদের মধ্যে একের পর এক
ছুঁড়ে দিতে পারেন হাতবোমা
যদি আপনি কল্লোলমুখর একটা কিন্ডারগার্টেনে পেট্রল ছড়িয়ে
হাসতে হাসতে আগুন লাগিয়ে দিতে পারেন প্রাতরাশের আগেই
এবং পকেটে হাত রেখে সেই দাউদাউ অগ্নিশিখার দিকে
তাকিয়ে খুব স্থিরভাবে টানতে পারেন ফাইভ ফিফটি ফাইভ
হ্যাঁ, তাহলে আপনিই সে-প্রতিভাবান পুরুষ, যাকে আমরা খুঁজছি
যদি আপনি প্রেমিকাকে বেড়াতে নিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণের পর
খুন করে ঝোপে ছুঁড়ে ফেলে একশো মাইল বেগে সাইলেন্সারহীন হোন্ডা
চালিয়ে ফিরে আসতে পারেন ন্যাশনাল পার্ক থেকে
কলাভবনের বারান্দায় যদি আপনি অকস্মাৎ বেল্ট থেকে ছোরা টেনে নিয়ে
আমূল ঢুকিয়ে দিতে পারেন সহপাঠীর বক্ষদেশে,
যদি আপনি জেব্রাক্রসিংয়ে পারাপাররত পথচারীদের ওপর দিয়ে
উল্লাসে চালিয়ে দিতে পারেন হাইজ্যাক করা ল্যান্ডরোভার
তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাকে আমরা খুঁজছি
যদি আপনার ভেতরে কোনো কবিতা থাকে, শুধু হাতুড়ি থাকে
যদি আপনার ভেতরে কোনো গান না থাকে, শুধু কুঠার থাকে
যদি আপনার ভেতরে কোনো নাচ না থাকে, শুধু রিভলবার থাকে
যদি আপনার ভেতরে কোনো স্বপ্ন না থাকে, শুধু নরক থাকে
তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাকে আমরা খুঁজছি
যদি আপনি পিতার শয্যার নিচে একটা টাইমবোম্ব ফিট করে
যাত্রা করতে পারেন পানশালার দিকে,
যদি আপনি জননীকে ঠেলে ফেলে দিতে পারেন টাওয়ারের
আঠারো তলার ব্যালকনি
থেকে যদি আপনি আপনার এলাকার ফুলের চেয়েও রূপসী মেয়েটির মুখে
এসিড ছুঁড়ে তাকে রূপান্তরিত করতে পারেন
পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত দুঃস্বপ্নে
তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাকে আমরা খুঁজছি
হ্যাঁ, আপনাকেই নিয়োগ করা হবে আমাদের মহাব্যবস্থাপক
আপনার ওপর ভার দেয়া হবে সমাজের
আপনার ওপর ভার দেয়া হবে রাষ্ট্রের
আপনার ওপর ভার দেয়া হবে সভ্যতার
আপনার খাদ্য হিশেবে বরাদ্দ করা হবে গুদামের পর গুদাম ভর্তি বারুদ
আপনার চিত্তবিনোদনের জন্যে সরবরাহ করা হবে লাখ লাখ স্টেনগান
আপনিই যদি হন আমাদের আকাঙ্খিত প্রতিভাবান পুরুষ
তাহলে ‘পোস্টবক্স : বাঙলাদেশ ১৯৮৬’তে
আজই আবেদন করুন।
বিশ্বাস
জানো, তুমি, সফল ও মহৎ হওয়ার জন্যে চমৎকার ভণ্ড হতে হয়?
বলতে হয়, এই অন্ধকার কেটে যাবে,
চাঁদ উঠবে, পুব দিগন্ত জুড়ে ঘটবে বিরাট ব্যাপক
সূর্যোদয়। বলতে হয়, প্রেমেই মানুষ বাঁচে,
বলতে হয়, অমৃতই সত্য বিষ সত্য নয়।
জানো, তুমি, মহৎ ও সফল হওয়ার জন্যে ভীষণ বিশ্বাসী হতে হয়?
বিশ্বাস রাখতে হয় সব কিছুতেই।
বলতে হয়, আমি বিশ্বাসী, আমি বিশ্বাস করি সভ্যতায়,
বলতে হয়, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
তাই তো এখন সবাই খুব বিশ্বাস করে,
চারদিকে এখন ছড়াছড়ি বিভিন্ন শ্রেণীর বিশ্বাসীর।
একদল বিশ্বাস পোষে ধর্মতন্ত্রে,
চিৎকার মিছিল করে আরেক দল বিশ্বাস জ্ঞাপন করে প্রভুতন্ত্রে।
পুঁজিবাদে বিশ্বাসীরা ছড়িয়ে রয়েছে
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ও সম্ভাব্য চতুর্থ বিশ্ব ভরে।
এখন গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে এমনকি একনায়কেরা,
কী সুন্দর স্তব করে তারা জনতার।
আমার শহরের প্রতিটি মস্তান এখন বিশ্বাস করে সমাজতন্ত্রে,
বিশ্বাস ছাড়া সাফল্য ও মহত্ত্বের কোনো পথ নেই।
আমি জানি সবচে বিশ্বাসযোগ্য তোমার ওই চোখ
আমি জানি সবচে বিশ্বাসযোগ্য তোমার ওই ওষ্ঠ
সবচে নির্ভরযোগ্য তোমার বিস্তীর্ণ দেহতন্ত্র।
তবুও আমি যে কিছুতেই বিশ্বাস রাখতে পারি না
অবিরাম ভূমিকম্পেধসে পড়ে বিশ্বাসের মোটা মোটা স্তম্ভ।
এমন কি মিলনের পর আমাকে জড়িয়ে ধরে
অন্যমনস্কভাবে যখন তুমি দূর নক্ষত্রের দিকে চেয়ে থাকো
তখন যে আমি তোমাতেও বিশ্বাস রাখতে পারি না।
ভিখারি
আমি বাঙালি, বড়োই গরিব। পূর্বপুরুষেরা–পিতা, পিতামহ
ভিক্ষাই করেছে; শতাব্দী, বর্ষ, মাস, সপ্তাহ, প্রত্যহ।
এমন সৌন্দর্য নেই তুমি সব কিছু ফেলে
ছুটে আসবে আমার উদ্দেশে দুই বাহু মেলে।
এত শৌর্যবীর্য নেই যে সদম্ভে ফেলবো চরণ
আর দিনদুপুরে সকলের চোখের সামনে তোমাকে করবো হরণ।
হে সৌন্দর্য হে স্বপ্ন হে ক্ষুধা হে তৃষ্ণার বারি,
আমি শুধু দুই হাত মেলে দিয়ে ভিক্ষা চাইতে পারি।
তুমি শুধু দেখবে দিনরাত,
সব কিছু পেরিয়ে তোমার সামনে মেলে আছি এক জোড়া ভিক্ষুকের হাত।
বই খুলতে গেলে
দেখবে তুমি বই হয়ে আছি আমি দুই হাত মেলে।
প্লেয়ারে রেকর্ড চাপিয়ে যদি তুমি গান শুনতে চাও,
চমকে উঠে শুনবে তুমি সব রেকর্ডে বাজে একই গান—’আমাকে ভিক্ষা দাও।‘
ফুল তুলতে গিয়ে বাগানের গাছে
দেখবে আমার ভিক্ষুক হাত গোলাপ চামেলি হয়ে চার দিকে ফুটে আছে।
অন্ধকার নেমে এলে ঘুমে গাঢ় হলে রাত
স্বপ্নে দেখবে তুমি দশদিগন্ত ঢেকে দিয়ে মেলে আছি ভিখারির হাত।
হে স্বপ্ন হে সৌন্দর্য হে ক্ষুধা হে আমার নারী,
তোমাকেই ঘিরে আছি আমি–বাঙালি, বড়োই গরিব, আর একান্ত ভিখারি।
মুক্তিবাহিনীর জন্যে
তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে গোলাপ
তোমার মেশিনগানের ম্যাগাজিনে ৪৫টি গোলাপের কুঁড়ি
তুমি ক্যামোফ্লেজ করলেই মরা ঝোপে ফোটে লাল ফুল
আসলে দস্যুরা অস্ত্রকে নয় গোলাপকেই ভয় পায় বেশি
তুমি পা রাখলেই অকস্মাৎ ধ্বংস হয় শত্রুর কংক্রিট বাংকার
তুমি ট্রিগারে আঙুল রাখতেই মায়াবীর মতো যাদুবলে
পতন ঘটে শত্রুর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ঢাকা নগরীর
তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে ভালোবাসা
সর্বাঙ্গে তোমার প্রেম দাউদাউ জ্বলে
তুমি পা রাখতেই প্রেমিকার ব্যাকুল দেহের মতো যশোর কুমিল্লা ঢাকা
অত্যন্ত সহজে আসে তোমার বলিষ্ঠ বাহুপাশে
আর তোমাকে দেখলেই উঁচু দালানের শির থেকে
ছিঁড়ে পড়ে চানতারামার্কা বেইমান পতাকা
তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে জীবন
তুমি দাও থরোথরো দীপ্ত প্রাণ বেয়নেটে নিহত লাশকে
তোমার আগমনে প্রাণ পায় মরা গাছ পোড়া প্রজাপতি
তোমার পায়ের শব্দে বাঙলাদেশে ঘনায় ফাল্গুন
আর ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বিধ্বস্ত বাগানে
এক সুরে গান গেয়ে ওঠে সাত কোটি বিপন্ন কোকিল
১৯৭২
যদি ওর মতো আমারও সব কিছু ভালো লাগতো
আমার আট বছরের মেয়ে মৌলির সব কিছুই ভালো লাগে।
ওকে একটি গোলাপ এনে দিলে তো কথাই নেই,
গোলাপের দিকে ও এমনভাবে তাকায় যে ওর ভালো লাগার রঙ
গোলাপের পাপড়ির চেয়েও রঙিন হয়ে চারদিকে
ছড়িয়ে পড়ে।
ওকে একটা শস্তা ফ্রক কিনে দিলাম একবার।
ফ্রকটি পেয়ে ও আনন্দে এতোটা লাফিয়ে উঠলো যে আমি খুব
বিব্রত বোধ করলাম।
চিড়িয়াখানায় হরিণ আর খরগোশ দেখে ও যখন ঝলমল করছে।
আমি তখন গাধা দেখানোর জন্যে নিয়ে গেলাম ওকে।
ভেবেছিলাম গাধা ওর ভালো লাগবে না, কিন্তু দেখেই ও
চিৎকার করতে থাকে, গাধাটা কী সুন্দর, গাধাটা কী সুন্দর!
রাস্তায় একবার একটা নোংরা বেড়ালকে
‘কী মিষ্টি’ বলে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলো ও।
খুব শস্তা, চার আনা দামের, লজেন্স ওকে এনে দিলাম একবার।
ভাবলাম ও নিশ্চয়ই ঠোঁট বেঁকোবে; কিন্তু হাতে পেয়েই
মৌলি কী ‘মজার, কী মজার’ বলে ঝলমলে করে তুললো বাড়িঘর।
একজন বাজে ছড়াকার আমাকে উপহার দিয়েছিলো
তার একটি ছড়ার বই। একটা ছড়া পড়েই আমি বাজে কাগজের
ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেললাম সেটা। দুপুরে ঘরে ফিরে দেখি
ও সেটি পড়ছে দুলে দুলে; আর আমাকে দেখেই লাফিয়ে উঠে
একটা ছড়া মুখস্থ শুনিয়ে বললো, ‘আব্বু, ছড়াগুলো কী যে মিষ্টি!’
আমি স্তম্ভিত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।
চাঁদ ওর ভালো লাগে, ছাইঅলীকেও ওর ভালো লাগে।
হরিণ ওর ভালো লাগে, গাধাও ওর ভালো লাগে।
ওকে যাই দিই, তাই ওর ভালো লাগে।
ওকে যা দিই না, তাও ওর ভালো লাগে।
ওকে যা দেখাই, তাই ওর ভালো লাগে।
ওকে যা দেখাই না, তাও ওর ভালো লাগে।
ও যখন একটা গণ্ডারের ছবি বা দেয়ালের টিকটিকির দিকে
মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, তখন ভেতরে আমি তীব্র বিষের ক্রিয়া
বোধ করি; আর বারবার ভাবি যদি
ওর মতো আমারও সব কিছু ভালো লাগতো।
যা কিছু আমি ভালোবাসি
কী অদ্ভুত সময়ে বাস করি।
যা কিছু আমি ভালোবাসি তাদের কথাও বলতে পারি না।
বলতে গেলেই মনে হয় আমি যেনো চারপাশের
সমস্ত শোষণ, পীড়ন, অন্যায়, ও প্রতিক্রিয়াশীলতাকে
সমর্থন করি।
রজনীগন্ধার নাম উচ্চারণ করতে গেলেই মনে হয়
আমি যেনো চাই রাস্তায় উলঙ্গ যে-শিশুটি অনাহারে চিৎকার করছে
সে চিরকাল এভাবেই চিৎকার করুক।
কৃষ্ণচূড়ার লাল মেঘের দিকে মুগ্ধচোখে তাকাতে গেলেই
মনে হয় আমি যেনো পৃথিবীব্যাপী সামরিক শাসন ও সমরবাদকে
সমর্থন করি।
আমার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেতে গেলেই মনে হয়
আমি যেনো ভুলে গেছি পৃথিবীর কোনো চুল্লিতে
এ-মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে পৃথিবীধ্বংসী একটা পারমাণবিক বোমা।
কবিতার কোনো পংক্তি অন্যমনস্কভাবে আবৃত্তি করার সাথে সাথে
মনে হয় আমি যেনো সাম্রাজ্যবাদকে দৃঢ়ভাবে
সমর্থন করছি।
ওই মেঘের দিকে তাকানোর সময় মনে হয়
আমি যেনো রাষ্ট্রযন্ত্রের সমস্ত
বদমাশিকে সমর্থন করি।
যখন আত্মার ভেতরে গুঞ্জরণ করে গীতবিতানের কোনো পংক্তি
তখন মনে হয় আমি যেনো ইস্কুলে যাওয়ার পথে
অপমৃত শিশুদের কথা ভুলে গেছি।
একটি ইন্দ্রিয়কাঁপানো চিত্রকল্প সৃষ্টির মুহূর্তে মনে হয়
আমি যেনো কৃষ্ণ বিদ্রোহী কবির মৃত্যুদণ্ডকে
সমর্থন করি।
আর ‘তোমাকে ভালোবাসি’
বলার সময় মনে হয় আমি যেনো ত্রিশ লক্ষ মানুষের
মৃত্যু আর বাঙলার স্বাধীনতার সঙ্গে
বিশ্বাসঘাতকতা করছি।
শ্রেষ্ঠ শিল্প
শিল্পের লক্ষ্য সুখ, বলেছে শিলার।
আমাদের মিলনই শ্রেষ্ঠ শিল্প—
এর বেশি সুখ আছে আর!
সামরিক আইন ভাঙার পাঁচ রকম পদ্ধতি
তুমি তো জানোই ভালো করে আমাদের অশ্লীল সমাজে
এক রকম সামরিক আইন চিরকালই আছে।
দ্বাদশ শতকে ছিলো, আছে আজো, হয়তো থাকবে আগামী শতকে।
এতে কিন্তু আসলে সুবিধা সকলেরই–অর্থাৎ দালাল ও সুবিধাবাদীরা
অর্থাৎ সমস্ত বাঙালি এতে খুবই সুবিধা বোধ করে। শুধু অসুবিধা
তোমার আমার, প্রিয়তমা। আমরা কি তিলে তিলে বুঝতে পারছি না
সামরিক শাসনে সিদ্ধ সব কিছু; নিষিদ্ধ শুধু আমাদের প্রেম?
তাই প্রেমের নামেই বিভিন্ন পদ্ধতিতে আমাদেরই ভাঙতে হবে
সামরিক সমস্ত বিধান।
সামরিক আইন ভাঙার প্রথম পদ্ধতিটি এতোই নির্দোষ
যে কারোই মনেও হবে না আমরা দুজনে মিলে একটা হিংস্র আইন
অমান্য করেছি। তুমি চৌরাস্তায় বর্বর সব মানুষের সামনে
সভ্যতার প্রথম দীপের মতো তুলে ধরতে পারো তোমার অমল মুখ
আমার সামনে। আমি তার দুর্লভ আলোতে আলোকিত হয়ে
উঠতে পারি সমসাময়িক প্রচণ্ড আঁধারে। এভাবেই
আমরা দুজনে প্রকাশ্যে ভাঙতে পারি সামরিক কয়েকটি বিধান।
সামরিক আইন ভাঙার দ্বিতীয় পদ্ধতিটি আরেকটু স্পষ্ট আর
দৃষ্টিগ্রাহ্য। তুমি আর আমি এইসব প্রেমহীন প্রাণীর জঙ্গলে সব কিছু
অবহেলা করে হাতে রাখতে পারি হাত। প্রকাশ্য রাস্তায় হাতে হাত ধরে
আমরা দুজনে ভাঙতে পারি সামরিক সমস্ত বিধি ও বিধান।
সামরিক আইন ভাঙার তৃতীয় পদ্ধতিটি একটু তীব্র, কিছুটা মারাত্মক।
আমার উদ্দেশে তুমি দৌড়ে আসতে পারো মালিবাগ থেকে আর
তোমার উদ্দেশে আমি ছুটে আসতে পারি সমস্ত বস্তি আর
কলোনি পেরিয়ে। পিজি হাসপাতালের চৌরাস্তায় কোটি কোটি
চোখের সামনে আমরা তীব্র আলিঙ্গনে বাঁধতে পারি পরস্পরকে।
আলিঙ্গনে জ্বলে উঠে অত্যন্ত প্রকাশ্যে আমরা ভাঙতে পারি ১৭৪
নম্বর সামরিক নির্দেশ।
সামরিক আইন ভাঙার চতুর্থ পদ্ধতিটি ওইসব মিছিল, শ্লোগান, পোস্টার,
বক্তৃতার চেয়ে বহুগুণে কার্যকর। আমরা দুজনে সমস্ত কামানবন্দুক
অবহেলা করে ময়লার মতো বয়ে যাওয়া মানুষ আর যানবাহনের
মধ্যে দাঁড়িয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে সুদীর্ঘ চুম্বনে রঙিন করে
তুলতে পারি সমগ্র বাঙলাকে। একটি প্রকাশ্য চুম্বনে আমরা খান খান
করে ভেঙে দিতে পারি হাজার বছর বয়স্ক বাঙলার
সামরিক আইন ও বিধান।
সামরিক আইন ভাঙার পঞ্চম পদ্ধতিটি বিপ্লবের চেয়েও তীব্র, ও অত্যন্ত গোপন।
তোমাকে তো শেখাতে পারি নিভৃতে গোপনে। প্রকাশ্যে কী করে শেখাই,
তাতে শুধু সামরিক আইন নয়, অসামরিক আইনও ক্ষেপে উঠবে
ভয়ঙ্করভাবে। দুপুরে আমার ঘরে এসো তুমি–আমরা দুজনে সমস্ত দুপুর ভরে
অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে চর্চা করবো গণতন্ত্র। আমাদের রক্তমাংস জপবে।
এমন মন্ত্র, যাতে বাঙলার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে খসে পড়বে সামরিক শৃঙ্খল।
সবাই বিস্মিত হয়ে দেখতে পাবে বাঙলায় একটিও শিরস্ত্রাণ নেই।
আমরা দুজনে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে এক দুপুরেই এমনভাবে ভাঙতে পারি
সামরিক বিধি ও বিধান যে বাঙলায় আর কখনো সামরিক
অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা থাকবে না।
সাহস
এখন, বিশশতকের দ্বিতীয়াংশে, সব কিছুই সাহসের পরিচায়ক।
কথা বলা সাহস, চুপ করে থাকাও সাহস।
দলে থাকা সাহস, দলে না থাকাও সাহস।
এখন, এ-দুর্দশাগ্রস্ত গ্রহে, সব কিছুই সাহসের পরিচায়ক।
তোমাকে ভালোবাসি বলা সাহস।
তোমাকে ভালোবাসি না বলাও সাহস।
এখন, বিশশতকের দ্বিতীয়াংশে, সব কিছুই সাহসের পরিচায়ক।
ঘরে একলা থাকাটা সাহস।
আবার রাস্তায় অনেকের সঙ্গে বেরিয়ে পড়াও সাহস।
এখন, এ-দুর্দশাগ্রস্ত গ্রহে, সব কিছুই সাহসের পরিচায়ক।
ঝলমলে গোলাপের দিকে তাকানোটা সাহস।
তার থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়াও সাহস।
এখন, বিশশতকের দ্বিতীয়াংশে, সব কিছুই সাহসের পরিচায়ক।
আমি কিছু চাই বলাটা সাহস।
আবার আমি কিছুই চাই না বলাও সাহস।
এখন, এ-দুর্দশাগ্রস্ত গ্রহে, বেঁচে থাকাটাই এক প্রকাণ্ড দুঃসাহস।
সিংহ ও গাধা ও অন্যান্য
১.
মানুষ সিংহের প্রশংসা করে,
তবে গাধাকেই আসলে পছন্দ করে।
আমার প্রতিভাকে প্রশংসা করলেও
ওই পুঁজিপতি গাধাটাকেই
আসলে পছন্দ করো তুমি।
.
২.
তোমাকে নিয়ে এতোগুলো কবিতা লিখেছি।
তার গোটাচারি শিল্পোত্তীর্ণ
আর অন্তত একটি কালোত্তীর্ণ।
এতেই সবাই বুঝবে তোমাকে আমি পাই নি কখনো।
.
৩.
প্রাক্তন দ্রোহীরা যখন অর্ঘ্য পায়
তাদের কবরে যখন স্মৃতিস্তম্ভ মাথা তোলে
নতুন বিদ্রোহীরা কারাগারে ঢোকে
আর ফাঁসিকাঠে ঝোলে।
.
৪.
মেয়ে, তোমার সুন্দর মনের থেকে
অনেক আকর্ষণীয়
তোমার সুন্দর শরীর।
.
৫.
যখন তোমার রিকশা উড়ে আসে
সামনের দিক থেকে প্রজাপতির মতো
তখন পেছন দিক থেকে দানবের মতো ছুটে আসে
একটা লকলকে জিভের ট্রাক
প্রজাপতি আর দানবের মধ্যে আমি পিষ্ট চিরকাল।
সৌন্দর্যের সৌন্দর্য
সৌন্দর্য, যেভাবেই তাকায়, সেভাবেই সুন্দর।
সৌন্দর্য, যখন সরাসরি তাকায়, তখন সুন্দর।
সৌন্দর্য, যখন চোখ নত করে থাকে, তখনো সুন্দর।
সৌন্দর্যের গ্রীবায় যখন তিল থাকে সৌন্দর্য তখন সুন্দর।
সৌন্দর্যের গ্রীবায় যখন তিল থাকে না সৌন্দর্য তখনো সুন্দর।
সৌন্দর্যের গালে যখন টোল পড়ে সৌন্দর্য তখন সুন্দর।
সৌন্দর্যের গালে যখন টোল পড়ে না সৌন্দর্য তখনো সুন্দর।
সৌন্দর্যের চুল যখন মেঘের মতো ওড়ে সৌন্দর্য তখন সুন্দর।
সৌন্দর্যের চুল যখন কালো গোলাপের মতো খোঁপা বাঁধা থাকে
সৌন্দর্য তখনো সুন্দর।
সৌন্দর্য, যেভাবেই থাকে, সেভাবেই সুন্দর।
সৌন্দর্য যখন কাতান প’রে আগুনের মতো জ্বলে
সৌন্দর্য তখন সুন্দর।
সৌন্দর্য যখন নগ্ন ধবধবে বরফের মতো গলে
সৌন্দর্য তখনো সুন্দর।
স্নানাগারে সৌন্দর্য সুন্দর।
সরোবরে সৌন্দর্য সুন্দর।
সৌন্দর্যের জংঘা সুন্দর।
সৌন্দর্যের বক্ষ সুন্দর।
সৌন্দর্য যখন ধান ভানে সৌন্দর্য তখন সুন্দর।
সৌন্দর্য যখন গান গায় সৌন্দর্য তখনো সুন্দর।
সৌন্দর্য যখন শিল্প সৌন্দর্য তখন সুন্দর।
সৌন্দর্য যখন অশিল্প সৌন্দর্য তখনো সুন্দর।
সৌন্দর্য যখন চুমো খায় সৌন্দর্য তখন সুন্দর।
সৌন্দর্য যখন শোকে ভেঙে পড়ে সৌন্দর্য তখনো সুন্দর।
সৌন্দর্য যখন প্রেমিকের আলিঙ্গনে কেঁপে ওঠে
সৌন্দর্য তখন সুন্দর।
সৌন্দর্য যখন অথর্ব বৃদ্ধের দেহতলে পিষ্ট হয়
সৌন্দর্য তখনো সুন্দর।
সৌন্দর্য যখন ট্রাকের চাকার নিচে থেলে প’ড়ে থাকে
সৌন্দর্য তখন সুন্দর।
বেয়নেটের খোঁচায় খোঁচায় যখন সৌন্দর্যের হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত ঝরে
সৌন্দর্য তখনো সুন্দর।
সৌন্দর্য, যেভাবেই থাকে, সেভাবেই সুন্দর।
সৌন্দর্য, যেভাবেই তাকায়, সেভাবেই সুন্দর।