যদি আপনার ভেতরে কোনো কবিতা থাকে, শুধু হাতুড়ি থাকে
যদি আপনার ভেতরে কোনো গান না থাকে, শুধু কুঠার থাকে
যদি আপনার ভেতরে কোনো নাচ না থাকে, শুধু রিভলবার থাকে
যদি আপনার ভেতরে কোনো স্বপ্ন না থাকে, শুধু নরক থাকে
তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাকে আমরা খুঁজছি
যদি আপনি পিতার শয্যার নিচে একটা টাইমবোম্ব ফিট করে
যাত্রা করতে পারেন পানশালার দিকে,
যদি আপনি জননীকে ঠেলে ফেলে দিতে পারেন টাওয়ারের
আঠারো তলার ব্যালকনি
থেকে যদি আপনি আপনার এলাকার ফুলের চেয়েও রূপসী মেয়েটির মুখে
এসিড ছুঁড়ে তাকে রূপান্তরিত করতে পারেন
পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত দুঃস্বপ্নে
তাহলে আপনিই সেই প্রতিভাবান পুরুষ, যাকে আমরা খুঁজছি
হ্যাঁ, আপনাকেই নিয়োগ করা হবে আমাদের মহাব্যবস্থাপক
আপনার ওপর ভার দেয়া হবে সমাজের
আপনার ওপর ভার দেয়া হবে রাষ্ট্রের
আপনার ওপর ভার দেয়া হবে সভ্যতার
আপনার খাদ্য হিশেবে বরাদ্দ করা হবে গুদামের পর গুদাম ভর্তি বারুদ
আপনার চিত্তবিনোদনের জন্যে সরবরাহ করা হবে লাখ লাখ স্টেনগান
আপনিই যদি হন আমাদের আকাঙ্খিত প্রতিভাবান পুরুষ
তাহলে ‘পোস্টবক্স : বাঙলাদেশ ১৯৮৬’তে
আজই আবেদন করুন।
বিশ্বাস
জানো, তুমি, সফল ও মহৎ হওয়ার জন্যে চমৎকার ভণ্ড হতে হয়?
বলতে হয়, এই অন্ধকার কেটে যাবে,
চাঁদ উঠবে, পুব দিগন্ত জুড়ে ঘটবে বিরাট ব্যাপক
সূর্যোদয়। বলতে হয়, প্রেমেই মানুষ বাঁচে,
বলতে হয়, অমৃতই সত্য বিষ সত্য নয়।
জানো, তুমি, মহৎ ও সফল হওয়ার জন্যে ভীষণ বিশ্বাসী হতে হয়?
বিশ্বাস রাখতে হয় সব কিছুতেই।
বলতে হয়, আমি বিশ্বাসী, আমি বিশ্বাস করি সভ্যতায়,
বলতে হয়, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
তাই তো এখন সবাই খুব বিশ্বাস করে,
চারদিকে এখন ছড়াছড়ি বিভিন্ন শ্রেণীর বিশ্বাসীর।
একদল বিশ্বাস পোষে ধর্মতন্ত্রে,
চিৎকার মিছিল করে আরেক দল বিশ্বাস জ্ঞাপন করে প্রভুতন্ত্রে।
পুঁজিবাদে বিশ্বাসীরা ছড়িয়ে রয়েছে
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, ও সম্ভাব্য চতুর্থ বিশ্ব ভরে।
এখন গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে এমনকি একনায়কেরা,
কী সুন্দর স্তব করে তারা জনতার।
আমার শহরের প্রতিটি মস্তান এখন বিশ্বাস করে সমাজতন্ত্রে,
বিশ্বাস ছাড়া সাফল্য ও মহত্ত্বের কোনো পথ নেই।
আমি জানি সবচে বিশ্বাসযোগ্য তোমার ওই চোখ
আমি জানি সবচে বিশ্বাসযোগ্য তোমার ওই ওষ্ঠ
সবচে নির্ভরযোগ্য তোমার বিস্তীর্ণ দেহতন্ত্র।
তবুও আমি যে কিছুতেই বিশ্বাস রাখতে পারি না
অবিরাম ভূমিকম্পেধসে পড়ে বিশ্বাসের মোটা মোটা স্তম্ভ।
এমন কি মিলনের পর আমাকে জড়িয়ে ধরে
অন্যমনস্কভাবে যখন তুমি দূর নক্ষত্রের দিকে চেয়ে থাকো
তখন যে আমি তোমাতেও বিশ্বাস রাখতে পারি না।
ভিখারি
আমি বাঙালি, বড়োই গরিব। পূর্বপুরুষেরা–পিতা, পিতামহ
ভিক্ষাই করেছে; শতাব্দী, বর্ষ, মাস, সপ্তাহ, প্রত্যহ।
এমন সৌন্দর্য নেই তুমি সব কিছু ফেলে
ছুটে আসবে আমার উদ্দেশে দুই বাহু মেলে।
এত শৌর্যবীর্য নেই যে সদম্ভে ফেলবো চরণ
আর দিনদুপুরে সকলের চোখের সামনে তোমাকে করবো হরণ।
হে সৌন্দর্য হে স্বপ্ন হে ক্ষুধা হে তৃষ্ণার বারি,
আমি শুধু দুই হাত মেলে দিয়ে ভিক্ষা চাইতে পারি।
তুমি শুধু দেখবে দিনরাত,
সব কিছু পেরিয়ে তোমার সামনে মেলে আছি এক জোড়া ভিক্ষুকের হাত।
বই খুলতে গেলে
দেখবে তুমি বই হয়ে আছি আমি দুই হাত মেলে।
প্লেয়ারে রেকর্ড চাপিয়ে যদি তুমি গান শুনতে চাও,
চমকে উঠে শুনবে তুমি সব রেকর্ডে বাজে একই গান—’আমাকে ভিক্ষা দাও।‘
ফুল তুলতে গিয়ে বাগানের গাছে
দেখবে আমার ভিক্ষুক হাত গোলাপ চামেলি হয়ে চার দিকে ফুটে আছে।
অন্ধকার নেমে এলে ঘুমে গাঢ় হলে রাত
স্বপ্নে দেখবে তুমি দশদিগন্ত ঢেকে দিয়ে মেলে আছি ভিখারির হাত।
হে স্বপ্ন হে সৌন্দর্য হে ক্ষুধা হে আমার নারী,
তোমাকেই ঘিরে আছি আমি–বাঙালি, বড়োই গরিব, আর একান্ত ভিখারি।
মুক্তিবাহিনীর জন্যে
তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে গোলাপ
তোমার মেশিনগানের ম্যাগাজিনে ৪৫টি গোলাপের কুঁড়ি
তুমি ক্যামোফ্লেজ করলেই মরা ঝোপে ফোটে লাল ফুল
আসলে দস্যুরা অস্ত্রকে নয় গোলাপকেই ভয় পায় বেশি
তুমি পা রাখলেই অকস্মাৎ ধ্বংস হয় শত্রুর কংক্রিট বাংকার
তুমি ট্রিগারে আঙুল রাখতেই মায়াবীর মতো যাদুবলে
পতন ঘটে শত্রুর দুর্ভেদ্য ঘাঁটি ঢাকা নগরীর
তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে ভালোবাসা
সর্বাঙ্গে তোমার প্রেম দাউদাউ জ্বলে
তুমি পা রাখতেই প্রেমিকার ব্যাকুল দেহের মতো যশোর কুমিল্লা ঢাকা
অত্যন্ত সহজে আসে তোমার বলিষ্ঠ বাহুপাশে
আর তোমাকে দেখলেই উঁচু দালানের শির থেকে
ছিঁড়ে পড়ে চানতারামার্কা বেইমান পতাকা
তোমার রাইফেল থেকে বেরিয়ে আসছে জীবন
তুমি দাও থরোথরো দীপ্ত প্রাণ বেয়নেটে নিহত লাশকে
তোমার আগমনে প্রাণ পায় মরা গাছ পোড়া প্রজাপতি
তোমার পায়ের শব্দে বাঙলাদেশে ঘনায় ফাল্গুন
আর ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বিধ্বস্ত বাগানে
এক সুরে গান গেয়ে ওঠে সাত কোটি বিপন্ন কোকিল
১৯৭২
যদি ওর মতো আমারও সব কিছু ভালো লাগতো
আমার আট বছরের মেয়ে মৌলির সব কিছুই ভালো লাগে।
ওকে একটি গোলাপ এনে দিলে তো কথাই নেই,
গোলাপের দিকে ও এমনভাবে তাকায় যে ওর ভালো লাগার রঙ
গোলাপের পাপড়ির চেয়েও রঙিন হয়ে চারদিকে
ছড়িয়ে পড়ে।