গরু ও গাধা
আজকাল আমি কোনো প্রতিভাকে ঈর্ষা করি না।
মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ এমন কি সাম্প্রতিক ছোটোখাটো
শামসুর রাহমানকেও ঈর্ষাযোগ্য ব’লে গণ্য
করি না; বরং করুণাই করি। বড় বেশি ঈর্ষা
করি গরু ও গাধাকে;–মানুষের কোনো পর্বে গরু
ও গাধারা এতো বেশি প্রতিষ্ঠিত, আর এতো বেশি
সম্মানিত হয় নি কখনো। অমর ও জীবিত
গরু ও গাধায় ভরে উঠছে বঙ্গদেশ; যশ খ্যাতি
পদ প্রতিপত্তি তাদেরই পদতলে। সিংহ নেই,
হরিণেরা মৃত; এ-সুযোগে বঙ্গদেশ ভ’রে গেছে
শক্তিমান গরু ও গাধায়। এখন রবীন্দ্রনাথ
বিদ্যাসাগর বাঙলায় জন্ম নিলে হয়ে উঠতেন
প্রতিপত্তিশালী গরু আর অতি খ্যাতিমান গাধা।
ডানা
একদা অজস্র ডানা ছিলো, কোনো আকাশ ছিলো না।
আকাশ মানেই ছিলো ঝড়, বজ্র, শাণিত বিদ্যুৎ
আর সীমাহীন অন্ধকার। তবু ওই ঝড়ে, বজ্রে, শাণিত বিদ্যুতে
উড়েছি বারবার। ডানা থাকলে ওড়ার জন্যে কোনো
আকাশ লাগে না–ঝড়ই হয়ে ওঠে আকাশ, বিদ্যুৎ নীলিমা।
বজ্ৰ জ্ঞাপন করে আকাশের স্তরেস্তরে ওড়ার উল্লাস।
জানি নি কখন বজ্রে-বিদ্যুতে খসে গেছে সংখ্যাহীন ডানা
আর মুখ থুবড়ে পড়ে গেছি উদ্ধারহীন নর্দমায়।
বহু দিন পর চোখে মেলে দেখি চারদিকে ছড়ানো আকাশ–
নীল হয়ে, তারকাখচিত হয়ে, শরীরে জ্যোৎস্না পরে
ছড়িয়ে রয়েছে–বজ্র নেই, ঝড় নেই, বিদ্যুতের ছুরিকাও নেই।
দূরস্মৃতির মতোন মনে পড়ে বজ্র, আর বিদ্যুৎকে।
উড়েতে গিয়েই দেখি খসে গেছে আমার সে-সংখ্যাহীন ডানা,
আর আমি ঢুকে গেছি স্বপ্নের প্রধান শত্রু অশ্লীল বাস্তবে।
তুমি, বাতাস ও রক্তপ্রবাহ
বাতাসের নিয়মিত প্রবাহ বোধই করা যায় না।
যখন নিশ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক মতো চলে
তখন কে বোধ করে বাতাসের অস্তিত্ব?
স্বাভাবিক রক্তসঞ্চালন টেরই পাওয়া যায় না।
বোঝাই যায় না হৃৎপিণ্ড
অবিরাম সঞ্চালিত করে চলেছে রক্ত শিরায় শিরায়।
সমগ্র শরীর কেঁপে ওঠে
যখন অভাব ঘটে বাতাসের।
ভূমিকম্প হয় যখন ব্যাঘাত ঘটে রক্তপ্রবাহে।
তুমি ওই রক্ত আর বাতাসের মতো
টেরই পাই না তোমাকে।
কিন্তু প্রচণ্ডভাবে বোধ করি তোমার অস্তিত্ব
যখন তোমার অভাব ঘটে
আমার জীবনে।
তোমার দিকে আসছি
অজস্র জন্ম ধরে
আমি তোমার দিকে আসছি
কিন্তু পৌঁছুতে পারছি না।
তোমার দিকে আসতে আসতে
আমার এক একটা দীর্ঘ জীবন ক্ষয় হয়ে যায়
পাঁচ পঁয়সার মোম বাতির মত।
আমার প্রথম জন্মটা কেটে গিয়েছিলো
শুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দেখে,
এক জন্ম আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখেছি।
আমার দুঃখ,
তোমার স্বপ্ন দেখার জন্যে
আমি মাত্র একটি জন্ম পেয়েছিলাম।
আরেক জন্মে
আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পরেছিলাম তোমার উদ্দেশ্য।
পথে বেরিয়েই আমি পলি মাটির উপর আকাঁ দেখি
তোমার পায়ের দাগ
তার প্রতিটি রেখা
আমাকে পাগল করে তোলে।
ঐ আলতার দাগ,আমার চোখ,আর বুক আর স্বপ্নকে
এতো লাল করে তুলে,
যে আমি তোমাকে সম্পূর্ন ভুলে যাই
ঐ রঙ্গীন পায়ের দাগ প্রদক্ষীন করতে করতে
আমার ঐ জন্মটা কেটে যায়।
আমার দুঃখ !
মাত্র একটি জন্ম
আমি পেয়েছিলাম
সুন্দর কে প্রদক্ষীন করার।
আরেক জন্মে
তোমার কথা ভাবতেই-
আমার বুকের ভিতর থেকে সবচে দীর্ঘ
আর কোমল,আর ঠাণ্ডা নদীর মত
কি যেন প্রবাহিত হতে শুরু করে।
সেই দীর্ঘশ্বাসে তুমি কেঁপে উঠতে পারো ভেবে
আমি একটা মর্মান্তিক দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে
কাটিয়ে দেই সম্পুর্ন জন্মটা।
আমার দুঃখ ,আমার কোমলতম দীর্ঘশ্বাসটি ছিল
মাত্র এক জন্মের সমান দীর্ঘ
আমার ষোঁড়শ জন্মে
একটি গোলাপ আমার পথ রোধ করে,
আমি গোলাপের সিঁড়ি বেয়ে তোমার দিকে উঠতে থাকি-
উঁচুতে ! উঁচুতে !! আরো উঁচুতে !!!
আর এক সময় ঝড়ে যাই চৈত্রের বাতাসে।
আমার দু:খ মাত্র একটি জন্ম
আমি গোলাপের পাপঁড়ি হয়ে
তোমার উদ্দেশ্য ছড়িয়ে পরতে পেরেছিলাম।
এখন আমার সমস্ত পথ জুড়ে
টলমল করছে একটি অশ্রু বিন্দু।
ঐ অশ্রু বিন্দু পেরিয়ে এ জন্মে হয়তো
আমি তোমার কাছে পৌঁছুতে পারবনা;
তাহলে ,আগামী জন্ম গুলো আমি কার দিকে আসবো ?
নষ্ট হৃৎপিণ্ডের মতো বাঙলাদেশ
তোমার দুই চির-অপ্রতিষ্ঠিত পুত্র কবি ও কৃষক (নিষাদেরাই
প্রতিষ্ঠিত চিরকাল) তোমার রূপের কথা
রটায় দিনরাত। একজন ধানখেতে তোমার দেহের
স্তব করে যেই গান গেয়ে ওঠে অন্যজন অমনি পুথির ধূসর
পাতা ভরে তোলে সমিল পয়ারে।
একজনকে তুমি এক বিঘে ধান দিলে সে তোমার দশ বিঘে
ভ’রে তোলে গানে। অন্যজনকে যখন তুমি
একটি পংক্তি দাও সে তখন দশশ্লোক স্তব রচে তোমার রূপের।
এ ছাড়া তোমার স্তব কোনো কালে বেশি কেউ
করে নি কখনো, বরং কুৎসাই রটিয়েছে শতকে শতকে।
এখন তো তুমি অপরিহার্য নও তোমার অধিকাংশ পুত্রের জন্যেই।
অনেকের চোখেই এখন মরুভূমি তোমার চেয়েও বেশি
সবুজ ও রূপসী, আর শীতপ্রধান অঞ্চলের উষ্ণতা রক্তেমাংসে
উপভোগে উৎসাহী সবাই, তাই তোমাকে ‘বিদায়’ না ব’লেই তারা
ছেড়ে যাচ্ছে তোমার উঠোন। আর চিরকালই
ঝোপঝাড়ে পাটখেতে ওৎ পেতে আছে অজস্র ধর্ষণকারী।
কতোবার যে দশকে দশকে ধর্ষিতা হয়েছো তুমি, তোমার আর্ত চিৎকার
মিশে গেছে মাঠে ঘাটে তুমি তার হিশেবও রাখো নি।
তুমি সেই কৃষক-কন্যা, যে ধর্ষিতা হলে প্রতিবাদে কোনো দিন
সরব হয় না গ্রাম। আমিও যে খুব ভক্তি করি ভালোবাসি
তোমাকে, তা নয়; ভাগ্যগুণে অন্য গোলার্ধে আমিও বিস্তর রূপসী
দেখেছি। তাদের ওষ্ঠ গ্রীবা বাহু এখনো রক্তে
তোলে ঢেউ, অর্থাৎ তোমার রূপে আমার দু-চোখ অন্ধ হয় নি কখনো।
অপরিহার্য ভাবি না তোমাকে, তবু যেই রক্তে চাপ পড়ে
টের পাই পাঁজরের তলে নষ্ট হৃৎপিণ্ডের মতো বাঙলাদেশ
সেঁটে আছো অবিচ্ছেদ্যভাবে।