তোমার জন্যে খোলা স্থলপথ, তুমি স্থলপথে এসো।
তোমার জন্যে খোলা জলপথ, তুমি জলপথে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সমস্ত আকাশ, তুমি আকাশপথে এসো।
হে অশুভ, হে অশুভ, হে সমকালীন দেবতা, তুমি মহাসমারোহে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সব গৃহ, তুমি সব গৃহে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সব প্রাঙ্গণ, তুমি সব প্রাঙ্গণে এসো।
তোমার জন্যে খোলা সব মন্দির, তুমি সব মন্দিরে এসো।
হে অশুভ, তুমি ফাল্গুনের ফুল হয়ে এসো
হে অশুভ, তুমি চৈত্রের কৃষ্ণচুড়া হয়ে এসো
হে অশুভ, ঝড় হয়ে এসো তুমি বোশেখের প্রত্যেক বিকেলে
হে অশুভ, শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে এসো তুমি অঝোর ধারায়।
এখানে কি কেউ জনককে হত্যা করে জননীর সাথে
লিপ্ত অজাচারে? বাঙলা কি পৃথিবীর নতুন করিন্থ?
হে অশুভ, দিন হয়ে এসো তুমি রাত্রি হয়ে এসো
হে অশুভ, সূর্য হয়ে ওঠো পুবে চাঁদ হয়ে ওঠো পশ্চিমে
হে অশুভ, শস্য হয়ে ফুলে ওঠো প্রতিটি পাকা ধান্যবীজে
হে অশুভ, হে সমকালীন বাঙলার দেবতা,
তুমি সমস্ত দিক আর দিগন্ত থেকে এসো।
পাড়ার গুণ্ডা হয়ে এসো তুমি পাড়ায় পাড়ায়
ধর্ষণকারী হয়ে এসো তুমি প্রতিটি রাস্তায়
ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে থাকো বালিকা বিদ্যালয়ের পাশের গলিতে
দশটা হেডলাইট জ্বালিয়ে এসো শহরের প্রধান সড়কে
এসো তুমি সাইলেন্সরহীন মোটর সাইকেলে
এসো তুমি দূরপাল্লার লাকশারি কোচে
হে অশুভ, হে সমকালীন বাঙলার দেবতা, সর্বব্যাপী
হয়ে তুমি এসো।
এসো বুট পায়ে ইউনিফর্ম প’রে
এসো পতাকাখচিত মার্সিডিস চ’ড়ে
এসো বাসে ঝুলে রিকশায় চেপে
এসো ব্যাংকের কাউন্টারে ঝলমলে নোটের বাণ্ডিল হয়ে
এসো গ্রন্থাগারে সারিসারি গ্রন্থ হয়ে
আমার ছাত্র হয়ে এসো তুমি ঘণ্টায় ঘণ্টায়
অধ্যাপক হয়ে এসো শ্রেণীতে শ্রেণীতে
এসো সচিব ও যুগ্ম সচিব হয়ে
এসো মন্ত্রী হয়ে
ব্যবস্থাপক হয়ে এসো সংস্থায় সংস্থায়।
হে অশুভ, তুমি প্রেমিকপ্রেমিকার প্রেমালাপে এসো
হে অশুভ, তুমি প্রত্যেকের চুম্বনে আলিঙ্গনে এসো
হে অশুভ, প্রতিটি শয্যায় তুমি পুলক হয়ে এসো
হে অশুভ, তুমি প্রতিটি কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে
এসো হে অশুভ, তুমি আমাদের প্রত্যকের প্রার্থনায় এসো
হে অশুভ, ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল হয়ে তুমি এসো।
ও ঘুমোয়, আমি জেগে থাকি
আমার দেড় বছরের মেয়ে স্মিতা কিছুতেই ঘুমোতে চায় না।
মায়ের চুমো আর রূপকথা কিছুতেই ওকে ঘুম পাড়াতে পারে না।
মাঝে মাঝে আমার ওপর ওকে ঘুম পাড়ানোর ভার পড়ে–
যেনো আমি যাদু জানি যা দিয়ে ওর মতো চাঞ্চল্যকে
আমি নিমেষেই নিশ্চল করে দিতে পারি।
মাঝে মাঝে আমারও খুব ঘুম পায়। ঘুমে চোখ ভেঙে আসে,
দেহ ভেঙে পড়ে। ওকে ডাকি, ‘এসো আব্বু, আমরা ঘুমোই।’
ও কিছুতেই ঘুমোবে না–মেঝেতে চঞ্চল পায়ে নাচতে থাকে,
আলনা থেকে টেনে নামায় কাপড়চোপড়, দাদুর জুতোর ভেতর পা ঢুকিয়ে
ভ্রমণ করতে থাকে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে। চোখে ঘুম নেই।
কিন্তু আমার চোখ ভ’রে ঘুম, সন্ধ্যায়ই ভেঙে পড়ছি বৃদ্ধের মতোন।
চিৎকার করে ডাকি, ‘এসো আব্বু, আমরা ঘুমোই।’
ও কিছুতে আসে না। আমি জোর করে তুলি ওকে বিছানায়, পাশে শোয়াই
জোর করে। ও চিৎকার করে কাঁদে, কিছুতেই ও ঘুমোবে না।
কিন্তু আমি যে নিদ্রায় কাতর। এক সময় হঠাৎ টের পাই
ও ঘুমিয়ে গেছে মধ্যরাতে দিঘির জলের মতো; আমি জেগে আছি।
দেয়াল ঘড়িটা তখন তিনবার বজ্রের মতো বেজে ওঠে।
কবি ও জনতাস্তাবকতা
সকলেই আজকাল স্তাবকতা করে জনতার।
স্বৈরাচারী, রাজনীতিব্যবসায়ী, ও তাত্ত্বিকেরা তো বটেই,
জনতার কবিসম্প্রদায়ও অক্লান্ত স্তাবকতা করে জনতার।
স্তাবকতা আত্মোন্নতির উপায় মাত্র; এতে জনতার
কোনো লাভ নেই। স্বৈরাচারী স্তাবকতা করে
সিংহাসনে টেকার জন্যে; রাজনীতিব্যবসায়ী স্তাবকতা
করে সিংহাসনে ওঠার আশায়। তাত্ত্বিকেরা
স্তাবকতা করে, কারণ তাদেরও চোখ নিবদ্ধ
সিংহাসনের আশেপাশে।
জনতার কবিসম্প্রদায়ও লাভের আশায়ই
স্তাবকতা করে জনতার।
তবে যে প্রকৃত কবি, যার ভালোবাসা বিশুদ্ধ প্রকৃত,
সে স্তব করতে পারে, কিন্তু স্তাবকতা
করে না কখনো। সে জানে জনতাও দেবতা নয়;
জনতাও বিপথগামী হয় অন্ধকারে;
পদস্খলিত হয় পিচ্ছিল রাস্তায়। তাই সে স্তাবকতার বদলে
নিজেকেই করে তোলে অগ্নিশিখা, জনতা তখন
পথ খুঁজে পায়। জনতা অনুসরণ করে কবিকে।
কবি, অগ্নিশিখা, কখনো অনুসরণ
করে না জনতাকে।
গরীবদের সৌন্দর্য
গরিবেরা সাধারণত সুন্দর হয় না।
গরিবদের কথা মনে হ’লে সৌন্দর্যের কথা মনে পড়ে না কখনো।
গরিবদের ঘরবাড়ি খুবই নোংরা, অনেকের আবার ঘরবাড়িই নেই।
গরিবদের কাপড়চোপড় খুবই নোংরা, অনেকের আবার কাপড়চোপড়ই নেই।
গরিবেরা যখন হাঁটে তখন তাদের খুব কিম্ভুত দেখায়।
যখন গরিবেরা মাটি কাটে ইট ভাঙে খড় ঘাঁটে গাড়ি ঠেলে পিচ ঢালে তখন তাদের
সারা দেহে ঘাম জবজব করে, তখন তাদের খুব নোংরা আর কুৎসিত দেখায়।
গরিবদের খাওয়ার ভঙ্গি শিম্পাঞ্জির ভঙ্গির চেয়েও খারাপ।
অশ্লীল হাঁ ক’রে পাঁচ আঙ্গুলে মুঠো ভ’রে সব কিছু গিলে ফেলে তারা।
থুতু ফেলার সময় গরিবেরা এমনভাবে মুখ বিকৃত করে
যেনো মুখে সাতদিন ধ’রে পচছিলো একটা নোংরা ইঁদুর।
গরিবদের ঘুমোনোর ভঙ্গি খুবই বিশ্রী।
গরিবেরা হাসতে গিয়ে হাসিটাকেই মাটি ক’রে ফেলে।
গান গাওয়ার সময়ও গরিবদের একটুও সুন্দর দেখায় না।
গরিবেরা চুমো খেতেই জানে না, এমনকি শিশুদের চুমো খাওয়ার সময়ও
থকথকে থুতুতে তারা নোংরা করে দেয় ঠোঁট নাক গাল।
গরিবদের আলিঙ্গন খুবই বেঢপ।
গরিবদের সঙ্গমও অত্যন্ত নোংরা, মনে হয় নোংরা মেঝের ওপর
সাংঘাতিকভাবে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে দু’টি উলঙ্গ অশ্লীল জন্তু।
গরিবদের চুলে উকুন আর জট ছাড়া কোনো সৌন্দর্য নেই।
গরিবদের বগলের তলে থকথকে ময়লা আর বিচ্ছিরি লোম সব জড়াজড়ি করে।
গরিবদের চোখের চাউনিতে কোনো সৌন্দর্য নেই,
চোখ ঢ্যাবঢ্যাব ক’রে তারা চারদিকে তাকায়।
মেয়েদের স্তন খুব বিখ্যাত, কিন্তু গরিব মেয়েদের স্তন শুকিয়ে শুকিয়ে
বুকের দু-পাশে দুটি ফোড়ার মতো দেখায়।
অর্থাৎ জীবনযাপনের কোনো মুহূর্তেই গরিবদের সুন্দর দেখায় না।
শুধু যখন তারা রুখে ওঠে কেবল তখনি তাদের সুন্দর দেখায়