আমি চেয়েছি সুন্দর, আর সৌন্দর্যকে, আর শিল্পকলাকে,
জীবনের চেয়েও যা শাশ্বত ও মূল্যবান। আমার দয়িতা
ছিলো বিমানবিক সুন্দর, যা নেই নারীতে, রৌদ্রে, মেঘে, জলে,
পাখিতে, পশুতে, পুষ্পে। আছে শুধু শিল্পে, শাশ্বত শিল্পকলায়।
সৌন্দর্যের খোঁজে আমি ঢুকে গিয়েছিলাম কলামন্দিরে; এবং ঢুকেই
সেঁটে দিয়েছিলাম সমস্ত দরোজা; এবং ভুলে গিয়েছিলাম
দরোজা খোলার মন্ত্র, জানালা খোলার সব গোপন কৌশল।
আমি মনে রাখতে চাই নি; আমি জানতাম ওই সৌন্দর্যের
গ্যালারিতে প্রবেশের পর আমার কখনো আর দরকার
পড়বে না জীবনে ঢোকার। ওই মানুষেরা যাকে সুখ বলে,
আমি তার চেয়ে অনেক বিশুদ্ধ কিছু পেয়েছি আমার বুকে,
জীবনপাগল মানুষেরা যা কখনো বুঝতে পারবে না।
দুই যুগ ধরে আমি সৌন্দর্যের গ্যালারিতে সৌন্দর্য যেপেছি।
আমার সম্মুখে ছিলো অনিন্দ্য সুন্দর, আর পশ্চাতে বিশুদ্ধ
সৌন্দর্য। চারপাশে অনশ্বর শিল্পকলা : চোখের মণিতে গাঁথা
থাকতো সবুজ রঙের চাঁদ; মণিমাণিক্যের দ্যুতি নাচতো করতলে
অহর্ণিশ; এমন সুগন্ধ উঠতো বুক জুড়ে যা কোনো ইন্দ্রিয়
দিয়ে উপভোগ্য নয়। অতীন্দ্রিয় স্বাদেগন্ধে ভ’রে ছিলো রক্তমাংস;
এমন নারীরা ছিলো যারা শুধু স্তবযোগ্য, সম্ভোগের জন্যে
যারা নয়। দুই যুগ ধরে আমি আমার অজস্র চোখ
নিবদ্ধ রেখেছি সৌন্দর্যের পদতলে ফোঁটা একটি পুষ্পের
শতদলে; দুই যুগ ধরে আমি আমার ওষ্ঠকে মানবিক
কোনো স্থূল স্বাদ আস্বাদ করতে দিই নি। যা কিছু শিল্প নয়
এমন কিছুর স্বাদ নিতে ভুলে গিয়েছিলো আমার ওষ্ঠ।
সৌন্দর্য ও শিল্পকলা ছাড়া আর সব কিছু দেখতে অনভ্যস্ত
হয়ে ওঠে আমার সমস্ত চোখ। আমার শরীর ভুলে যায়
সৌন্দর্যপ্রবাহ ছাড়া আর কোনো প্রবাহ রয়েছে।
যা কিছু পচনশীল, যা কিছু মাংসে গঠিত আমার তা নয়;
আমি তার নই। পার্থিব পুষ্প দেখেছি; জলাশয়ে প্রাণবন্ত
মাছ, আর বনভূমে পশুপাখি অনেক দেখেছি। পৃথিবী যে
রমণীয়, তার মৌল কারণ যে-রমণীরা, তাদেরও দেখেছি।
কিন্তু সবই পচে যায়, মানবিক সব কিছু প’চে নষ্ট হয়ে
যায়। শুধু থাকে শিল্পকলা, যা কিছু পবিত্র শুদ্ধ অনশ্বর,
যার জন্যে আমার জীবন আমি ভত্যদের বকশিশ দিয়ে দিতে পারি।
দুই যুগ পরে আস্তে আমার চোখের সামনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে
খুলে যায় আর্টগ্যালারির দরোজাজানালা। দরোজার কথা
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম পুরোপুরি, আর যে-কোনো গৃহে যে
জানালা গবাক্ষ থাকে, আমার স্মৃতিতে তা একেবারেই ছিলো না।
আমি কেনো মনে রাখবো প্রবেশ বা প্রস্থানের পথ, বাহ্যজগত?
একটি দরোজাকে শিল্পকলা ভেবে এগোতেই ইট-কাঠ-কাঁচ
চুরমার করে আর্টগ্যালারিতে ঢোকে সদ্যভূমিষ্ঠ এক
শিশুর চিৎকার; আর সমস্ত গ্যালারি কেঁপে ওঠে ভূমিকম্পে।
আমি বাইরে বেরোই : দুটি ছাগশিশু নাচছিলো সমস্ত শিল্পিত
হরিণের চেয়ে সুন্দর ভঙ্গিতে, মুখে কাঁপছিলো সবুজ কাঁঠাল
পাতা, যুবকের রক্তে রূপময় হয়ে উঠছিলো চৌরাস্তার
শুকনো কংক্রিট, যুবতীর অবিনাশী অশ্রুতে ফুটে উঠছিলো
দিকে দিকে গন্ধরাজ রঙিন গোলাপ। দুই যুগ পরে।
আমি জীবনশিল্পের মধ্যে টলতে টলতে হুঁ হুঁ করে উঠি।
একবারে সম্পূর্ণ দেখবো
তোমাকে প্রথম দেখি মুখোমুখি; শুধু মুখটিই চোখে পড়ে।
ওই মুখে চোখ, ঠোঁট, একটা বিস্ময়কর তিল ছিলো
সে-সব পৃথকভাবে লক্ষ্য করি নি। শুধু একটি মুখই দেখেছি।
তারপর একবার দেখি তুমি হেঁটে যাচ্ছো; তোমার গ্রীবার
সৌন্দর্যই শুধু আমার দু-চোখে ঢোকে;–গ্রীবা নয়,
গ্রীবার সৌন্দর্যকেই শুধু সত্য মনে হয়। তারপর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে
তোমাকে দেখেছি; কিন্তু সম্পূর্ণ দেখি নি। করতল দেখার সময়
দেখতে পাই নি হাতের পেছন ভাগ, খোঁপার গঠন
দেখার সময় আমার দু-চোখ থেকে অন্তহীন দূরত্বে থেকেছে
তোমার চিবুক। পরম সত্যের মতো উদঘাটিত স্তনের দিকে
নিবদ্ধ রেখেছি চোখ যুগযুগ; আর ওই সৌন্দর্যমথিত
যুগযুগান্তরব্যাপী আমি দেখতে পাই নি তোমার পিঠের
রূপ, তার ঢেউ রেখা বাক ও অন্যান্য খণ্ড সত্য।
তোমার পায়ের তালুতে একটা উল্লেখযোগ্য জ্যোতিশ্চক্র রয়েছে;
ওই জ্যোতিশ্চক্রে নিবদ্ধ থাকার কালে দেখতে পাই নি
জ্যোতির্ময় আশ্চর্য ত্রিভুজ। আমি শুধু এক সত্য থেকে আরেক সত্যে
পৌঁচেছি তোমাকে প্রথম দেখার আশ্চর্য মুহূর্ত
থেকে। তুমি কি পরম সত্য? তোমাকে কখন
আমি একবারে, এক দৃষ্টিতে, আপাদমস্তকআত্মা সম্পূর্ণ দেখবো?
এপিটাফ
এখানে ঘুমিয়ে আছে–কবি।
স্ত্রী যাকে ভালোবাসতো
উপস্ত্রী যাকে ভালোবাসতো
প্রেমিকা যাকে ভালোবাসতো।
এখানে ঘুমিয়ে আছে–কবি।
স্ত্রী যাকে ঘৃণা করতো
উপস্ত্রী যাকে ঘৃণা করতো
প্রেমিকা যাকে ঘৃণা করতো।
এসো, হে অশুভ
চারদিকে শুনছি তোমার রোমাঞ্চকর কণ্ঠস্বর।
মেঘে মেঘে ঝিলিক দিচ্ছে তোমার দীর্ঘ শরীরের রূপরেখা।
ঘন কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়ছে পুব থেকে পশ্চিমে,
উত্তর থেকে দক্ষিণে, মেঘ থেকে মাটিতে।
তোমার ঢেউ খেলানো মস্তক থেকে পল্লীর পথপ্রান্তে খ’সে পড়ছে
দু-চারটি ঝলমলে বিস্ময়কর চুল,
তোমার হাত থেকে খসে পড়া অশুভ রুমালে ঢেকে যাচ্ছে
শহরের পর শহর, সমুদ্র আর বিমানবন্দর।
হে অশুভ, হে অশুভ, হে সমকালীন দেবতা, তুমি মহাসমারোহে এসো।