অত্যাচার উৎপীড়ন, করিবারে সংযমন,
না করিত যেইজন ভেদাভেদ কাহারে।
না মানিত অনুরোধ, না জানিত তোষামোদ,
সে তেজস্বী মহোদয় বাঞ্ছা এবে কোথা রে।
কত যুবা যৌবনেতে, চড়ি আশা বিমানেতে,
ভাবে ছড়াইবে ভবে যশঃপ্রভা আভারে।
তুলিবে কীর্ত্তির মঠ, স্থাপিবে মঙ্গলঘট,
প্রণত ধরণীতল দিবে নিত্য পূজা রে।
কেহ বা জগতে ধন্য, বীরবৃন্দে অগ্রগণ্য,
হয়ে চাহে চরণেতে বাঁধিবারে ধরারে।
স্বদেশ হিতৈষী কেহ, তাবিয়ে অসীম স্নেহ,
ব্রত করে প্রাণ দিতে স্বজাতির উদ্ধারে।
কার চিত্তে অভিলাষ, হবে শারদার দাস,
পীবে সুখে চিরদিন অমরতা সুধারে।
কালের করাল স্রোতে, ভাসে যবে জীবনেতে,
এই সব আশালুদ্ধ প্রাণী থাকে কোথা রে।
কিশোর গাণ্ডীবধারী, যামদগ্ন্য দৈত্যহারী,
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কালিদাস কত ডোবে পাথারে।
কতই যুবতী বালা, গাঁথে মনোমত মালা,
সাজাইতে মনোমত প্রিয়তম সখারে।
হৃদয় মার্জ্জিত করে, আহা কত প্রেমভরে,
প্রিয়মূর্ত্তি চিত্র ক’রে রাখে চিত্ত-আগারে।
নব বিবাহিত কত, পেয়ে পতি মনোমত,
ভাবে জগতের সুখ ভরিয়াছে ভাণ্ডারে।
এই সব অবলার, কিছু দিন পরে আর
দেখ মর্ম্মভেদী শেল দেয় কত ব্যথারে।
দেখ গে কেহ বা তার, হয়েছে পঞ্জরসার,
শুষ্ক হয়ে মাল্যদাম শূন্যে আছে গাঁথা রে।
মনোমত নহে পতি, মরমে মরিয়ে সতী,
উদ্যাপন করিয়াছে পতিসুখ-আশারে।
কৃতান্তের আশীর্ব্বাদে, দিবানিশি কেহ কাঁদে,
বিষম বৈধব্য দশ নিগড়েতে বাঁধা রে।
দারুণ অপত্যতাপে, দেখ গে কেহ বিলাপে,
অন্নাভাবে জননীর কোথা বক্ষঃ বিদারে।
আগে যদি জানিতাম, পৃথিবী এমন ধাম,
তা হলে কি পড়িতাম আনায়ের মাঝারে।
কোথা গেল সে প্রণয়, বাল্যকালে মধুময়,
যে সখ্যতা পাশে মন বাঁধা ছিল সদা রে।
সহপাঠী কেলিচর, অভেদাত্মা হরিহর,
এবে তাহাদের সঙ্গে কতবার দেখা রে।
পতঙ্গপালের মত কর্ম্মক্ষেত্রে অবিরত,
স্বকার্য্য সাধনে রত, কে বা ভাবে কাহারে।
আহা পুনঃ কত জন করিয়াছে পলায়ন,
মর্ত্ত্যভূমি পরিহরি শমনের প্রহারে।
গগন-নক্ষত্রবৎ, তাহারাই অকস্মাৎ,
প্রকাশে ক্বচিৎ কভু মৃদুরশ্মি মাখারে।
আগে ছিল কত সাধ, হেরিতে পূর্ণিমা চাঁদ,
হেরিতে নক্ষত্র-শোভা নীলনভঃ মাঝারে।
দিনদিন কত বার, জাগ্রতে নিদ্রিতাকার,
স্বপ্নে স্বপ্নে ভ্রমিতাম নদহ্রদকান্তারে।
বসন্ত বরষাকালে, পিকরব, মেঘজালে,
হেরিতে দামিনীলতা, কি আনন্দ আহা রে।
সে সাধ তরঙ্গকুল, এবে কোথা লুকাইল,
কে ঘুচালে জীবনের হেন রম্য ধাঁধাঁ রে।
বিশুদ্ধ পবিত্র মন, স্বর্গবাসী সিংহাসন,
পঙ্কিল করিল কে রে দগ্ধচিতা অঙ্গারে।
দৃষ্টি ও সৃষ্টি
দৃষ্টি ও সৃষ্টি
“Those organs which guide an animal are under man’s guidance and control.”
–Goethe
লক্ষ্য করবার জন্যেই হল চোখ, শব্দ ধরবার জন্যেই হল কান, হাত পা রসনা সব কটাই হল রূপ রস শব্দ স্পর্শ গন্ধ ধরে’ বিশ্বের চারিদিককে বুঝে নেবার জন্যে। সজীব সব মানুষেরই বুদ্ধির চারিদিকে ইন্দ্রিয় সকল নানা শক্তিশেল নিয়ে খবরদারি কাযে দিনরাত ব্যস্ত রইলো, এই হল স্বাভাবিক ব্যাপার; অথচ অর্জুনের লক্ষ্যভেদ, কিম্বা দশরথের শব্দভেদ এমনি নানা রকম ভেদবিদ্যার কৌশল শিক্রে পাখী থেকে আরম্ভ করে শিকারী মানুষে যখন লাভ করলো, দেখলাম তখন সেই জীব অথবা মানুষ নিজের চোখ কান হাত পা ইত্যাদিকে অস্বাভাবিক রকমে অসাধারণ শক্তিমান করে তুল্লে;—এই কথাই বলতে হয় আমাদের। ছেলেকে অক্ষর চিনতে শেখালে, বই পড়তে শেখালে তবে সে আস্তে আস্তে চোখে দেখতে পায় কি লেখা আছে, বুঝতে পারে পড়াগুলো, এবং ক্রমে নিজেই রচনা করার শক্তি পায় একদিন হয়তো-বা। যে মানুষ কেবল অক্ষর পরিচয় করে চল্লো, আর যে অক্ষরগুলোর মধ্যে মানে দেখতে লাগল, আবার যে রচনার নির্মাণ-কৌশল ও রস পর্যন্ত ধরতে লাগলো এদের তিন জনের দেখা শোনার মধ্যে অনেকখানি করে পার্থক্য যে আছে তা কে না বলবে! কাযেই দেখি—শিল্পই বল আর যাই বল কোন কিছুতে কুশল হয় না চোক হাত কান ইত্যাদি, যতক্ষণ এদের স্বাভাবিক কার্যকরী চেষ্টাকে নতুন করে সুশিক্ষিত করে তোলা না যায় বিশেষ বিশেষ দিকে—বিশেষ বিশেষ উপায় আর শিক্ষার রাস্তা ধরে। এই শিক্ষার তারতম্য নিয়ে আমাদের সচরাচর মোটামুটি দর্শন স্পর্শন শ্রবণ ইত্যাদির সঙ্গে শিল্পীর ও গুণীর দেখাশোনার পার্থক্য ঘটে। ছবি কবিতা সুর-সার প্রভৃতি অনেক সময়ে যে আমাদের কাছে হেঁয়ালীর মতো ঠেকে তা দুই দলের মধ্যে এই পরখ ও পরশের পার্থক্য বশতঃই হয়। কথাই আছে—‘কবিতারসমাধুর্য্যম্ কবির্বেত্তি’; ঠিক সুরে সুর মেলা চাই, না হলে যন্ত্র বল্লে ‘গা’, কণ্ঠ বলে উঠলো ‘ধা’।
জেগে দেখার দৃষ্টি ধ্যানে দেখার দৃষ্টির সঙ্গে মিলতে তো পারে না, যতক্ষণ না ধ্যানশক্তি লাভ করাই নিজেকে। এই জন্যেই কবিতা সঙ্গীত ছবি এ সবকে বুঝতে হলে আমাদের চোখ কানের সাধারণ দেখাশোনার চালচলনের বিপর্যয় কতকটা অভ্যাস ও শিক্ষার দ্বারায় ঘটাতে হয়, না হলে উপায় নেই। মানুষের সৃষ্টি বুঝতে যদি এই নিয়ম হল তবে সৃষ্টিকর্তার রচনাকে পুরো রকম বুঝে-সুঝে উপভোগ করার ক্ষমতা অনেকখানি সাধনার যে অপেক্ষা রাখে তা বলাই বাহুল্য।