১০
সেই রূপ তুমি, পাখি,
অদৃশ্য গগনে থাকি,
কর সুখে বরিষণ
সুধাস্বর অনুক্ষণ,
ভাসাইতে ভূমণ্ডল সুধার ধারায়।
১১
কেবা তুমি জানি নাই,
তুলনা কোথায় পাই;
জলধনু চূর্ণ হয়ে
পড়ে যদি শূন্য বয়ে,
তাহাও অপূর্ব্ব হেন নাহিক দেখায়।
১২
যত কিছু ভূমণ্ডলে
সুন্দর মধুর বলে—
নবীন মেঘের জল
মুক্ত মাখা তৃণদল—
তোমার মধুর স্বরে পরাজিত হয়।
১৩
পাখী কিম্বা হও পরি
বল রে প্রকাশ করি
কি সুখ চিন্তায় তোর
আনন্দ হয়েছে ভোর?
এমন আহলাদ আহা স্বপ্নে দেখি নাই।
১৪
সুধা প্রণয়ের গীত
প্রাণ করে পুলকিত—
তারো সুললিত স্বর
নহে এত মনোহর
এত সুধাময় কিছু না হেরি কোথাই।
১৫
বিবাহ উৎসব-রব
বিজয়ীর জয়-স্তব,
তোর স্বর তুলনায়
অসার দেখি রে তায়—
মেটেনা মনের সাধ পূর্ণ নাহি হয়।
১৬
তোর এ আনন্দময়
সুখ-উৎস কোথা রয়,
বন কিম্বা মাঠ গিরি
গগন হিল্লোল হেরি—
কারে ভালবেসে এত ভুল সমুদয়।
১৭
তুমিই থাক রে সুখে
জান না ঔদাস্য দুখে,
বিরক্তি কাহারে বলে
জান না রে কোন কালে
প্রেমের অরুচি ভোগে হলাহল কত।
১৮
আমরা এ মর্ত্ত্যবাসী
কভু কাঁদি কভু হাসি,
আগে পাছে দেখে যাই
যদি কিছু নাহি পাই,
অমনি হতাশ হয়ে ভাবি অবিরত।
১৯
যত হাসি প্রাণ ভরে
যাতনা থাকে ভিতরে,
এ দুঃখের ভূমণ্ডলে
শোকে পরিপূর্ণ হলে
মধুর সঙ্গীত হয় কতই মধুর।
২০
ঘৃণা ভয় অহঙ্কার
দূরে করি পরিহার,
পাখি রে তোমার মত
না যদি কাঁদিতে হত,
না জানি পেতেম কি না আনন্দ প্রচুর।
২১
গগন বিহারী পাখী
জগতে নাহি রে দেখি,
গীত বাদ্য মধুস্বর
হেন কিছু মনোহর
তুলনা তুলিতে পারি তোমার কথায়।
২২
যে আহ্লাদ চিত্তে তোর,
অামারে কিঞ্চিৎ ওর
আনন্দ কর রে দান,
তা হলে উন্মাদ প্রাণ
কবিতা তরঙ্গে ঢেলে প্রকাশি ধরায়।
———-
শেলি বিরচিত স্কাইলার্কের অনুকরণ।
জীবন সঙ্গীত
বলো না কাতর স্বরে বৃথা জন্ম এ সংসারে
এ জীবন নিশার স্বপন;
দারাপুত্র পরিবার তুমি কার কে তোমার
বলে জীব করো না ক্রন্দন।
মানব-জনম সার এমন পাবে না আর
বাহ্য দৃশ্যে ভুলো না রে মন।
কর যত্ন হবে জয় জীবাত্মা অনিত্য নয়
অহে জীব কর আকিঞ্চন।
করোনা সুখের অাশ পরো না দুখের ফাঁস
জীবনের উদ্দেশ তা নয়;
সংসারে সংসারী সাজ করো নিত্য নিজ কাজ
ভবের উন্নতি যাতে হয়।
দিন যায় ক্ষণ যায় সময় কাহারো নয়
বেগে ধায় নাহি রয় স্থির;
হয় সম্পদ বল্ সকলি ঘুচায় কাল
আয়ু যেন শৈবালের নীর।
সংসার সমরাঙ্গনে যুদ্ধ কর দৃঢ় পণে
ভয়ে ভীত হইও না মানব;
কর যুদ্ধ বীর্য্যবান যায় যাবে যাক্ প্রাণ
মহিমাই জগতে দুর্ল্লভ।
মনোহর মূর্ত্তি হেরে অহে জীব অন্ধকারে
ভবিষ্যতে করো না নির্ভর;
অতীত সুখের দিনে পুনঃ আর ডেকে এনে
চিন্তা করে হইও না কাতর।
সাধিতে আপন ব্রত স্বীয় কার্য্যে হও রত
এক মনে ডাক ভগবান;
সঙ্কল্প সাধন হবে ধরাতলে কীর্ত্তি রবে
সময়ের সার বর্ত্তমান।
মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন
হয়েছেন প্রাতঃ স্মরণীয়,
সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্ত্তি ধ্বজা ধরে
আমরাও হবো বরণীয়।
সময়-সাগর তীরে পদাঙ্ক অঙ্কিত করে
আমরাও হব হে অমর;
সেই চিহ্ন লক্ষ্য করে অন্য কোন জন পরে
যশোদ্বারে আসিবে সত্বর।
করো না মানবগণ বৃথা ক্ষয় এ জীবন
সংসার-সমরাঙ্গন মাঝে;
সংকল্প করেছ যাহা, সাধন করহ তাহা
রত হয়ে নিজ নিজ কাজে।
জীবন-মরীচিকা
জীবন এমন ভ্রম আগে কে জানিত রে।
হয়ে এত লালায়িত কে ইহা যাচিত রে।
প্রভাতে অরুণোদয়, প্রফুল্ল যেমন হয়,
মনোহরা বসুন্ধরা কুহেলিকা আঁধারে।
বারিদ, ভূধর, দেশ, ধরিয়ে অপূর্ব্ব বেশ,
বিতরে বিচিত্র শোভা ছায়াবাজী আকারে।
কুসুমিত তরুচয়, ব্রহ্মাণ্ড ভরিয়ে রয়,
ঘ্রাণে মুগ্ধ সমীরণ মৃদু মৃদু সঞ্চারে।
কুলায়ে বিহঙ্গদল, প্রেমানন্দে অনর্গল,
মধুময় কলনাদ করে কত প্রকারে।
সেইরূপ বাল্যকালে, মন মুগ্ধ মায়াজালে,
কত লুদ্ধ অাশা আসি স্নিগ্ধ করে আত্মারে।
পৃথিবী ললামভূত, নিত্য সুখে পরিপ্লুত,
হয় নিত্য এই গীত পঞ্চভূত মাঝারে।
ব্রহ্মাণ্ড সৌরভময় মঞ্জু কুঞ্জ মনে হয়,
মনে হয় সমুদয় সুধাময় সংসারে।
মধ্যাহ্ণে তাহার পর, প্রচণ্ড রবির কর,
যেমন সে মনোহর মধুরতা সংহারে।
না থাকে কুহেলি অন্ধ, না থাকে কুসুমগন্ধ,
না ডাকে বিহগকুল সমীরণ ঝঙ্কারে।
সেই রূপ ক্রমে যত, শৈশব যৌবন গত,
মনোমত সাধ তত ভাঙে চিত্তবিকারে।
সুবর্ণ মেঘের মালা, লয়ে সৌদামিনী ডালা,
আশার আকাশে আর নিত্য নাহি বিহারে।
ছিন্ন তুষারের ন্যায়, বাল্য বাঞ্ছা দূরে যায়,
তাপদগ্ধ জীবনের ঝঞ্ঝাবায়ু প্রহারে।
পড়ে থাকে দূরগত জীর্ণ অভিলাষ যত,
ছিন্ন পতাকার মত ভগ্ন দুর্গ প্রাকারে।
জীবনেতে পরিণত এই রূপে হয় কত
মর্ত্ত্যবাসিমনোরথ, হা দগ্ধ বিধাতা রে!
ধর্ম্মনিষ্ঠাপরায়ণ, সুচারু পবিত্র মন,
বিমলস্বভাব সেই যুবা এবে কোথা রে।
অসত্য কলুষলেশ, বিঁধিলে শ্রবণদেশ,
কলঙ্কিত ভাবিত যে আপনার আত্মারে।
বামাশক্তি বামাচার, শুনিলে শত ধিক্কার,
জ্বলিত অন্তরে যার সে তপস্বী কোথারে?
কোথা সে দয়াদ্রচিত্ত, সঙ্কল্প যাহার নিত্য,
পরদুঃখ বিমোচন এ দুরন্ত সংসারে।