১৩
বলিতে বলিতে আনন্দ বারিতে
দেবর্ষি হইল রোমাঞ্চ কায়;
ঘনঘনস্বর গভীর, প্রখর
তান্পূরা ধ্বনি বাজিল তায়।
১৪
গাহিল নারদ, ভাবে গদগদ,
“এমন ভজন নাহি রে আর,
ভূধর শিখরে ডাকিয়া ঈশ্বরে
গাহিতে অনন্ত মহিমা তাঁর।
১৫
ইহার সমান ভজনের স্থান
কি আছে মন্দির জগত মাঝে;
জলদ-গর্জ্জন তরঙ্গ-পতন
ত্রিলোক চমকি যেখানে বাজে।
১৬
কিবা সে কৈলাস বৈকুণ্ঠ নিবাস
অলকা আমরা নাহিক চাই;
জয় নারায়ণ বলিয়া যেমন
ভুবনে ভুবনে ভ্রমিতে পাই।”
১৭
নারদের বাণী শুনি অভিমানী
অমর মণ্ডলী বিমর্ষ হয়;
আবার আহ্লাদে গভীর নিনাদে
সঙ্গীত তরঙ্গ বেগেতে বয়!
১৮
“ঋষি কয় জন সন্ধ্যা সমাপন
করি এক দিন বসিলা ধ্যানে;
দেবী বসুন্ধরা মলিনা কাতরা
কহিতে লাগিলা আসি সেখানে;”
১৯
‘রাখ ঋষিগণ—সমূলে নিধন
মানব সংসার হলো এবার;
হলো ছার খার ভুবন আমার
অনাবৃষ্টি তাপ সহে না আর।’
২০
শুনে ঋষিগণ করে দৃঢ় পণ
যোগে দিল মন একান্ত চিতে;
কঠোর সাধন ব্রহ্ম আরাধনা
করিতে লাগিলা মানব-হিতে।
২১
মানব মঙ্গলে ঋষির সকলে
কাতরে ডাকিছে করুণাময়;
মানবে রাখিতে নারায়ণ চিতে
হইল অসীম করুণোদয়।
২২
দেখিতে দেখিতে হলো আচম্বিতে
গগন-মণ্ডল তিমিরময়;
মিহির নক্ষত্র তিমিরে একত্র
অনল বিদ্যুৎ অদৃশ্য হয়।
২৩
ব্রহ্মাণ্ড ভিতর নাহি কোন স্বর,
অবনী অম্বর স্তম্ভিত প্রায়;
নিবিড় আঁধার জলধি হুঙ্কার
বায়ু বজ্রনাদ নাহি শুনায়।
২৪
নাহি করে গতি গ্রহদলপতি
অবনী-মণ্ডল নাহিক ছুটে;
নদ-নদী-জল হইল অচল
নির্ঝর না ঝরে ভূধর ফুটে।
২৫
দেখিতে দেখিতে পুনঃ আচম্বিতে
গগনে হইল কিরণোদয়;
ঝলকে ঝলকে অপূর্ব্ব আলোকে
পূরিল চকিতে ভুবনত্রয়!
২৬
শূন্যে দিল দেখা কিরণের রেখা
তাহাতে আকাশে প্রকাশ পায়—
ব্রহ্ম সনাতন অতুল চরণ
সলিল নির্ঝর বহিছে তায়।
২৭
বিন্দু বিন্দু বারি পড়ে সারি সারি
ধরিয়া সহস্র সহস্র বেণী;
দাঁড়ায়ে অম্বরে কমণ্ডলু করে
আনন্দে ধরিছে কমলযোনি।
২৮
হায় কি অপার আনন্দ আমার
ব্রহ্ম সনাতন চরণ হতে;
ব্রহ্মা কমুণ্ডলে জাহ্নবী উথলে
পড়িছে দেখিনু বিমানপথে।
২৯
গভীর গর্জ্জনে দেখিনু গগনে
ব্রহ্মা কমণ্ডলু হতে আবার
জলস্তম্ভ ধায়, রজতের কায়,
মহাবেগে বায়ু করি বিদার।
৩০
ভীম কোলাহলে নগেন্দ্র অচলে
সেই বারিরাশি পড়িল আসি;
ভূধর শিখর সাজিয়া সুন্দর
মুকুটে ধরিল সলিল রাশি।
৩১
রজত বরণ স্তম্ভের গঠন
অনন্ত গগন ধরেছে শিরে,
হিমানী আবৃত হিমাদ্রি পর্ব্বত
চরণে পড়িয়া রয়েছে ধীরে।
৩২
চারি দিকে তার রাশি স্তূপাকার
ফুটিয়া ছুটিছে ধবল ফেনা;
ঢাকি গিরি চুড়া হিমানীর গুঁড়া
সদৃশ খসিছে সলিল কণা।
৩৩
ভীষণ অাকার ধরিয়া আবার
তরঙ্গ ধাইছে আচল কায়;
নীলিম গিরিতে হিমানী রাশিতে
ঘুরিয়া ফিরিয়া মিশায়ে যায়।
৩৪
হইল চঞ্চল হিমাদ্রী অচল
বেগেতে বহিল সহস্র ধারা;
পাহাড়ে পাহাড়ে তরঙ্গ আছাড়ে
ত্রিলোক কাঁপিল আতঙ্কে সারা।
৩৫
ছুটিল গর্ব্বেতে গোমুখী পর্ব্বতে
তরঙ্গ সহস্র একত্রে মিলি,
গভীর ডাকিয়া আকাশ ভাঙ্গিয়া
পড়িতে লাগিল পাষাণ ফেলি।
৩৬
পালকের মত ছিঁড়িয়া পর্ব্বত
কুঁদিয়া চলিল ভাঙ্গিয়া বাঁধ,
পৃথিবী কাঁপিল তরঙ্গ ছুটিল
ডাকিয়া অসংখ্য কেশরি-নাদ।
৩৭
বেগে বক্রকায় স্রোতঃস্তম্ভ ধায়
যোজন অন্তরে পড়িছে নীচে;
নক্ষত্রের প্রায় ঘেরিয়া তাহায়
শ্বেত ফেনরাশি পড়িছে পিছে।
৩৮
তরঙ্গনির্গত বারিকণা যত
হিমানী চূর্ণিত আকার ধরে;
ধূমরাশি প্রায় ঢাকিয়া তাহায়
জলধনু শোভা চিত্রিত করে।
৩৯
শত শত ক্রোশ জলের নির্ঘোষ
দিবস রজনী করিছে ধ্বনি;
অধীর হইয়া, প্রতিধ্বনি দিয়া
পাষাণ খসিয়া পড়ে অমনি।
৪০
ছাড়ি হরিদ্বার শেষেতে আবার
ছড়ায়ে পড়িল বিমল ধারা;
শ্বেত সুশীতল স্রোতস্বতীজল
বহিল তরল পারা পারা।
৪১
অবনীমণ্ডলে সে পবিত্র জলে
হইল সকলে আনন্দে ভোর;
‘জয় সনাতনী পতিতপাবনি’
ঘন ঘন ধ্বনি উঠিল ঘোর।”
চাতক পক্ষীর প্রতি
১
কে তুমি রে বল পাখি,
সোণার বরণ মাখি,
গগনে উধাও হয়ে
মেঘেতে মিশায়ে রয়ে,
এত সুখে সুধামাখা সঙ্গীত শুনাও।
২
বিহঙ্গ নহ ত তুমি;
তুচ্ছ করি মর্ত্ত্যভূমি
জ্বলন্ত অনল প্রায়
উঠিয়া মেঘের গায়,
ছুটিয়া অনিল-পথে সুস্বর ছড়াও।
৩
অরুণ উদয় কালে
সন্ধ্যার কিরণ-জালে
দূর গগনেতে উঠি,
গাও সুখে ছুটি ছুটি,
সুখের তরঙ্গ যেন ভাসিয়া বেড়াও।
৪
আকাশের তারাসহ
মধ্যাহ্নে লুকায়ে রহ,
কিন্তু শুনি উচ্চস্বরে
শূন্যেতে সঙ্গীত ঝরে;
আনন্দ প্রবাহ ঢেলে পৃথিবী জুড়াও।
৫
একাকী তোমার স্বরে
জগত প্লাবিত করে,
শরতের পূর্ণশশি
বিমল আকাশে বসি
কৌমুদী ঢালিয়া যথা ব্রহ্মাণ্ড ভাষায়।
৬
কবি যথা লুকাইয়ে,
হৃদয়ে কিরণ লয়ে,
উন্মত্ত হইয়ে গায়,
পৃথিবী মাতিয়ে তায়
আশা মোহ মায়া ভয় অন্তরে জড়ায়।
৭
রাজার কুমারী যথা
পেয়ে প্রণয়ের ব্যথা,
গোপনে প্রাসাদ পরে
বিরহ সান্ত্বনা করে
মধুর প্রেমের মত মধুর গাথায়।
৮
যেমন খদ্যোত জ্বলে
বিরলে বিপিন তলে,
কুসুম তৃণের মাঝে
আতোষী আলোক সাজে
ভিজিয়া শিশির নীরে আঁধার নিশায়।
৯
পাতায় নিকুঞ্জ গাঁথা
গোলাপ অদৃশ্য যথা
সৌরভ লুকায়ে রয়,
যখনি পবন বয়,
সুগন্ধ উথলি উঠি বায়ুরে খেপায়।