আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাহার কাছে দুঃখের রোদন;
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
বিমুখ বান্ধব ধাতা, বিমুখ জনক ভ্রাতা,
বিমুখ নিষ্ঠুর তিনি পতি নাম যাঁর—
রাজ্যেশ্বরী বিনে ভবে কোথা যাব আর?
আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাঁহার কাছে দুঃখের রোদন—
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
“ডেকেছি মা বিধাতারে কত শত বার,
পূজেছি কতই দেব সংখ্যা নাহি তার,
তবুও মা খণ্ডিল না কপালের মূল,
অমরাবতীতে বুঝি নাহি দেবকুল!
বারেক বৃটনেশ্বরি অায় মা দেখাই
প্রাণের ভিতরে দাহ কি করে সদাই;
কাজ নাই দেখায়ে মা, তুমি রাজ্যেশ্বরী,
হৃদয়ে বাজিবে তব ব্যথা ভয়ঙ্করী।
ছিল ভাল বিধি যদি বিধবা করিত,
কাঁদিতে হতো না পতি থাকিতে জীবিত!
পতি, পিতা, ভ্রাতা, বন্ধু ঠেলিয়াছে পায়,
ঠেলো না মা, রাজমাতা, দুঃখী অনাথায়।”
আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাঁহার কাছে দুঃখের রোদন;
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
বিমুখ বান্ধব ধাতা, বিমুখ জনক ভ্রাতা,
বিমুখ নিষ্ঠুর তিনি পতি নাম যাঁর—
রাজ্যেশ্বরী বিনে ভবে কোথা যাব আর?
“কি জানাব জননী গো হৃদয়ের ব্যথা—
কিঙ্করীরো হেন ভাগ্য না হয় সর্ব্বথা?
কি ষোড়শী বালা, আর প্রবীণারমণী,
প্রতিদিন কাঁদিছে মা দিন দণ্ড গণি।
কেহ কাঁদে অন্নাভাবে আপনার তরে,
শিশু কোলে কারো চক্ষে বারিধারা ঝরে।
কত পাপস্রোত মাতা প্রবাহিত হয়,
ভাবিতে রোমাঞ্চ দেহ, বিদরে হৃদয়।
হা নৃশংস অভিমান কৌলীন্য-আশ্রিত!
হা নৃশংস দেশাচার রাক্ষসপালিত!
আমাদের যা হবার হয়েছে, জননি—
কর রক্ষা এই ভিক্ষা এ সব নন্দিনী।”
আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাঁহার কাছে দুঃখের রোদন—
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
বিমুখ বান্ধব ধাতা, বিমুখ জনক ভ্রাতা
বিমুখ নিষ্ঠুর তিনি পতি নাম যাঁর—
রাজ্যেশ্বরী বিনে ভবে কোথা যাব আর?
আয় আয় সহচরী, ধরি গে বৃটনেশ্বরী,
করি গে তাঁহার কাছে দুঃখের রোদন—
এ জগতে আমাদের কে আছে আপন?
কোন একটি পাখীর প্রতি
১
ডাক্ রে আবার, পাখি, ডাক্ রে মধুর!
শুনিয়ে জুড়াক প্রাণ, তোর সুললিত গান
অমৃতের ধারা সম পড়িছে প্রচুর।
আবার ডাক্ রে পাখি, ডাক্ রে মধুর!
বলিয়ে বদন তুলে, বসিয়ে রসালমূলে,
দেখিনু উপরে চেয়ে আশায় আতুর।
ডাক্ রে আবার ডাক্ সুমধুর সুর।
২
কোথায় লুকায়ে ছিল নিবিড় পাতায়;
চকিত চঞ্চল আঁখি, না পাই দেখিতে পাখী,
আবার শুনিতে পাই সঙ্গীত শুনায়,
মনের আনন্দে বসে তরুর শাখায়।
কে তোরে শিখালে বল, এ সঙ্গীত নিরমল?
আমার মনের কথা জানিলি কোথায়?
ডাক্ রে আবার ডাক্ পরাণ জুড়ায়।
৩
অমনি কোমল স্বরে সেও রে ডাকিত,
কখন আদর করেকভু অভিমান ভরে
অমনি ঝঙ্কার করে লুকায়ে থাকিত।
কি জানিবি পাখী তুই, কত সে জানিত!
নব অনুরাগে যবে, ডাকিত প্রাণবল্লভে,
কেড়ে নিত প্রাণ মন পাগল করিত;
কি জানিবি পাখী তুই কত সে জানিত।
৪
ধিক্ মোরে ভাবি তারে আবার এখন!
ভুলিয়ে সে নব রাগ, ভুলে গিয়ে প্রেমযাগ,
আমারে ফকীর করে আছে সে যখন;
ধিক্ মোরে ভাবি তারে আবার এখন।
ভুলিব ভুলিব করি, তবু কি ভুলিতে পারি,
না জানি নারীর প্রেম মধুর কেমন,
তবে কেন সে আমারে ভাবে না এখন?
৫
ডাক্ রে বিহগ তুই ডাক্ রে চতুর;
ত্যজে সুধু সেই নাম, পূরা তোর মনস্কাম,
শিখেছিস্ আর যত বল সুমধুর।
ডাক্ রে আবার ডাক্ মনোহর সুর!
না শুনে আমার কথা, ত্যজে কুসুমিত লতা,
উড়িল গগন-পথে বিহগ চতুর;—
কে আর শুনবে মোরে সে নাম মধুর।
গঙ্গার উৎপত্তি
১
হরিনামামৃত পানে বিমোহিত
সদা আনন্দিত নারদঋষি,
গাহিতে গাহিতে অমরাবতীতে
আইল একদা উজলি দিশি।
২
হরষ অন্তরে মহা সমাদরে
স্বগণ সংহতি অমর পতি,
করি গাত্রোত্থান, করিয়া সম্মান
সাদর সম্ভাষে তোষে অতিথি।
৩
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া মুনিরে পূজিয়া
চন্দ্রাগ্নি প্রভৃতি অমরগণ ;
করিয়া মিনতি কহে ঋষিপতি
“কহ কৃপা করি করি শ্রবণ,
8
কি রূপে উৎপতি হলো ভাগীরথী
গাও তপোধন প্রাচীন কথা।
বেদের উকতি, তোমার ভারতী,
অমৃত লহরী সদৃশ গাথা।”
৫
গুণী বিশারদ মুনি সে নারদ,
ললিত পঞ্চমে মিলায়ে তান,
আনন্দে ডুবিয়া নয়ন মুদিয়া।
তুম্ব বাজাইয়া ধরিল গান।
৬
“হিমাদ্রি অচল দেবলীলাস্থল
যোগীন্দ্রবাঞ্ছিত পবিত্র স্থান;
অমর কিন্নর যাহার উপর
নিসর্গ নিরখি জুড়ায় প্রাণ।
৭
যাহার শিখরে সদা শোভ করে
অসীম অনন্ত তুষার রাশি;
যাহার কটিতে ছুটিতে ছুটিতে
জলদকদম্ব জুড়ায় আসি।
৮
যেখানে উন্নত মহীরুহ যত
প্রণত উন্নত শিখর কায়;
সহস্র বৎসর অজর অমর
অনাদি ঈশ্বর মহিমা গায়।
৯
সেই হিমগিরি শিখর উপরি
অঙ্গিরাদি যত মহর্ষিগণ
আসিত প্রত্যহ, ভকতির সহ
ভজিতে ব্রহ্মাণ্ড আদিকারণ।
১০
হেরিত উপরে নীলকান্তি ধরে
শূন্য ধূ ধূ করে ছড়ায়ে কায়;
হেরিত অযুত অযুত অদ্ভুত
নক্ষত্র ফুটিয়া ছুটিছে তায়।
১১
মণ্ডলে মণ্ডলে শনি শুক্র চলে
ঘুরিয়া ঘেরিয়া আকাশময়;
হেরিত চন্দ্রমা অতুল উপমা
অতুল উপমা ভানু উদয়।
১২
চারি দিকে স্থিত দিগন্ত বিস্তৃত
হেরিত উল্লাসে তুষার রাশি;
বিস্ময়ে প্লাবিত বিস্ময়ে ভাবিত
অনাদি পুরুষে আনন্দে ভাসি।”