আবার গগনে কেন সুধাংশু উদয় রে!
কাঁদাইতে অভাগারে, কেন হেন বারে বারে,
গগন মাঝারে শশী আসি দেখা দেয় রে।
তারে যে পাবার নয়, তবু কেন মনে হয়,
জ্বলিল যে শোকানল, কেমনে নিবাই রে।
আবার গগনে কেন সুধাংশু উদয় রে!
( ২ )
অই শশী অই খানে, এই স্থানে দুই জনে,
কত অাশা মনে মনে কত দিন করেছি!
কত বার প্রমদার মুখচন্দ্র হেরেছি!
পরে সে হইল কার, এখনি কি দশা তার,
আমারি কি দশা এবে কি আশ্বাসে রয়েছি!
(৩)
কৌমার যখন তার, বলিত সে বারম্বার,
সে আমার আমি তার অন্য কারো হবো না।
অরে দুষ্ট দেশাচার, কি করিলি অবলার,
কার ধন করে দিলি, আমার সে হলো না!
(৪)
লোক-লজ্জা মান ভয়ে, মা বাপ নিদয় হয়ে,
আমার হৃদয়-নিধি অন্য কারে সঁপিল,
অভাগার যত আশা জন্ম-শোধ ঘুচিল।
(৫)
হারাইনু প্রমদায়, তৃষিত চাতক প্রায়,
ধাইতে অমৃত আশে বুকে বজ্র বাজিল;—
সুধাপান অভিলাষ অভিলাষি থাকিল ।
চিন্তা হলো প্রাণাধার, প্রাণত্যুল্য প্রতিমার
প্রতিবিম্ব চিত্তপটে চিরাঙ্কিত রহিল,
হায়, কি বিচ্ছেদ-বাণ হৃদয়েতে বিঁধিল ।
(৬)
হায়, সরমের কথা, আমার স্নেহের লতা,
পতিভাবে অন্য জনে প্রাণনাথ বলিল ;
মরমের ব্যথা মম মরমেই রহিল।
(৭)
তদবধি ধরাসনে, এই স্থানে শূন্যমনে
থাকি পড়ে, ভাবি সেই হৃদয়ের ভাবনা;
কি যে ভাবি দিবানিশি তাও কিছু জানি না।
সেই ধ্যান সেই জ্ঞান, সেই মান অপমান—
অরে বিধি, তারে কি রে জন্মান্তরে পাব না ?
(৮)
এ যন্ত্রণা ছিল ভালো, কেন পুনঃ দেখা হলো,
দেখে বুক বিদারিল, কেন তারে দেখিলাম ।
ভাবিতাম আমি দুখে, প্রেয়সী থাকিত সুখে,
সে ভ্রম ঘুচিল, হায়, কেন চখে দেখিলাম !
(৯)
এই রূপে চন্দ্রোদয়, গগন তারকাময়,
নীরব মলিনমুখী অই তরুতলে রে;
এক দৃষ্টে মুখপানে, চেয়ে দেখে চন্দ্রাননে,
অবিরল বারিধারা নয়নেতে ঝরে রে;
কেন সে দিনের কথা পুনঃ মনে পড়ে রে?
(১০)
সে দেখে আমার পানে, আমি দেখি তার পানে,
চিতহারা দুই জনে বাক্য নাহি সরে রে;
কতক্ষণে অকস্মাৎ, “বিধবা হয়েছি নাথ”
বলে প্রিয়তমা ভূমে লুটাইয়ে পড়ে রে।
(১১)
বদন চুম্বন করে, রাখিলাম ক্রোড়ে ধরে,
শুনিলাম মৃদু স্বরে ধীরে ধীরে বলে রে—
“ছিলাম তোমারি আমি, তুমিই আমার স্বামী,
ফিরে জন্মে, প্রাণনাথ, পাই যেন তোমারে।”—
কেন শশী পুনরায় গগনে উঠিলি রে!
১.০৪ ছেলেধরা
ছেলেধরা
আমরা ভূমিষ্ঠ হয়েই শুলেম, সহরে ছেলেধরার বড় প্রাদুর্ভাব! কাবুলি মেওয়াওয়ালারা ঘুরে ঘুরে ছেলে ধরে কাবুলে নিয়ে যায়। সেথায় নানাবিধ মেওয়া ফলের বিস্তর বাগান আছে, ছেলেটাকে তারি একটা বাগানের ভিতর ছেড়ে দেয়, সে অনবরত পেটপুরে মেওয়া খেয়ে খেয়ে যখন একেবারে ফুলে উঠে রং দুধে আলতার মত হয়, এমন কি টুস্কি মাল্লে রক্ত বেরোয়, তখন এক কড়া ঘি চড়িয়ে ছেলেটাকে ঐ কড়ার উপর, উপরপানে পা করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়; ক্রমে কড়ার ঘি টগবগিয়ে ফুটে উঠলে ছেলের মুখ দিয়ে রক্ত বেরুতে আরম্ভ হয় ও সেই রক্ত টোসা টোসা ঘিয়ের কড়ার উপর পড়ে; ক্রমে ছেলের সমুদায় রক্ত বেরিয়ে এলে নানাবিধ মেওয়া ও মিছরির ফোড়ন দিয়ে কড়াখানি নাবান হয়। নবাব ও বড় বড় মোসলমানরা তাই খান। আমরা এই ভয়ানক কথা শুনে অবধি একলা বাড়ার বাহিরে প্রাণান্তেও যেতাম না, ও সেই অবধি কাবুলীদিগের উপর বিজাতীয় ঘৃণা জন্মে গেল।
বিলাতের কথা
উনি আমাদের জ্ঞাতি শ্ৰীযুক্ত জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরকে আমার বিলেত যাবার কথা লিখেছিলেন। তাঁরা আমাদের নাবিয়ে নিতে জাহাজে লোক পাঠিয়েছিলেন। তিনি খ্ৰীস্টান হয়ে খ্রীস্টান কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে বিয়ে করেছিলেন বলে তার বাপ প্রসন্নকুমার ঠাকুর তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। সেই অবধি তিনি সপরিবারে বিলেতে বাস করছিলেন। তাঁর দুই মেয়ে ছিল—বলেন্দ্রবালা ও সত্যেন্দ্রবালা, তাঁদের ডাকনাম ছিল বালা ও সতু। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের রং খুব সাফ ছিল। তিনি আদরের ছেলে ছিলেন বলে বাপ অল্প বয়সে যশোরের এক সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। সেই স্ত্রীর তিনি খুব অতুগত হয়ে পড়েছিলেন, এমন কি পাখার বাতাস দিয়ে ঘুম পাড়াতেন ও দিনরাত কাছে কাছে থাকতেন। সেই স্ত্রী মারা যেতে তিনি খুব অস্থির হয়ে পড়েন, সেই সময় কৃষ্ণ বন্দ্যোঃ নামে এক পাদ্রী তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে খ্ৰীস্টান করে ফেল্লেন। বাপের মৃত্যুর সময় নাকি তিনি একবার দেখা করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল বলে ঢুকতে পারেন নি।
প্রসন্নকুমার ঠাকুর অত্যন্ত বেঁটে ছিলেন বলে’ তাঁর গুষ্টিসুদ্ধ তিন চার পুরুষ পর্যন্ত বেঁটে রয়ে গেছে। বালা ও সতু খুব বেঁটে ছিলেন, চেহারাও তেমন ভাল ছিল না, কেবল খুব চুল ও বড় বড় চোখ ছিল। তখনকার ধরণের ইংরিজী পোশাক পরতেন। তাদের ওখানে যে-সব ইংরাজ ভদ্রলোকের নিমন্ত্রণ হত—হয়ত বিয়ের সম্বন্ধ করবার উদ্দেশ্যে—তাঁদের মধ্যে একজন আমাকে চুপি চুপি বলেছিলেন যে, এদের বিয়ে করব কি, শরীরে যে কিছু নেই, শুধু কাঠি। বালা ও সতুর শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়নি। আর সকলে মারা গেলে অনেকদিন পর সতু বিষয়-কর্মের পরামর্শের জন্য মহারাজা যতীন্দ্রমোহনের কাছে কলকাতায় এসেছিল। যদিও জ্ঞানেন্দ্রমোহন বাপের বিষয় থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, তবু কিছু বিষয় তাঁর ছিল, তার থেকে তাঁর চলত। শেষে তাঁর এক বন্ধু উকীল Ramsdenকে বলেছিলেন যে সে যদি Tagore নাম নেয় ত তাঁর বিষয়ের উত্তরাধিকারী হতে পারবে।