( চিতেন )
হ’লো প্রতিধ্বনি,—“পুলোম দুহিতা,
অহে দেবরাজ তোমারি গৃহীতা”—
ঘন ঘন ঘোর সুগভীর স্বরে,
কাননে, বিপিনে, নদী, সরোবরে,
উঠিল নিনাদি যতেক দেবতা।
৫
অতি সুললিত মৃদু মধুস্বরে,
আবার গাহক বীণা নিল করে,
মজাইল সুরললনা।
“দেখ দেখ চেয়ে নাগরের বেশে,
চোক্ ঢুলু ঢুলু আসে হেসে হেসে,
আড়ে অাড়ে কথা নাহি অভিমান,
সদা আশুতোষ খুলে দেয় প্রাণ,
ওরে সুধা তোর নাই তুলনা।
সদা সেবে যারা সোমরস সুধা
ক্ষোভ লোভ শোক থাকে না ক্ষুধা,
রণজয়ী যেই সুধাপায়ী সেই,
শূর বিনে সুধা-স্বাদ জানে না।
(চিতেন)
“সুধার প্রেমেতে বাজ্রে বীণা,
বল্ সুধা বই ধন্ চাহিনা,
অমন মধুর নাই পিপাসা !
সুধা কিবা ধন সুধা সে কেমন,
সাধক বিনে কি জানিবে চাষা।”
(৬)
দৈত্য অরিদল দম্ভে কোলাহল
করে আস্ফালন করিল কত,
মত্ত মধুপানে দিতিসুতগণে
কি রূপে কোথায় করেছে হত।
তখন আবার বীণা-বাদ্যকর
বীণা নিল করে, সকরুণ স্বরে,
অমর দৰ্প করিল চূর ;
আরক্ত লোচন ঘন গরজন;
ক্রমে ক্রমে সব হ’লো অদর্শন,
স্তব্ধ হইল অমরপুর।
সকরুণ স্বরে বীণা করে ধরে,
গাহিল,—“যখন প্রলয় হবে,
যখন ঈশান হর হর বোলে,
বাজাবে বিষাণ ঘন ঘোর রোলে,
জলে জলম্ময় হবে ত্রিভুবন,
না রবে তপন শশীর কিরণ,
জগত মণ্ডল কারণ বারিতে,
ছিঁড়িয়া পড়িবে ত্রিলোক সহিতে,
তখন কোথা এ বিভব রবে ।
এই সুরপুরী এ সব সুন্দরী
এ বিপুল ভোগ কোথায় যাবে!”—
অতি ক্ষুণ্ণমন যত দেবগণ,
ঘন ঘন শ্বাস করে বিসর্জ্জন,
ভাবিয়ে অধীর প্রলয় যবে ;
এই সুরপুরী এসব সুন্দরী
এ বিপুল ভোগ কোথায় রবে !
(চিতেন)
এ বিপুল ভোগ কোথায় রবে,
বলিয়া কিন্নর গাহিল সবে,
জগত মণ্ডল কারণ বারিতে,
ছিঁড়িয়া পড়িবে ত্রিলোক সহিতে,
তখন কোথা এ বিভব রবে!
৭
গুণী বিশ্বাবসু সঙ্গীতের পতি,
বীণা যন্ত্রে পুনঃ মধুর ভারতী,
গাহিতে লাগিল প্রেমের গাথা;
বিলাপ ঘুচিল প্রেম উপজিল
রসে ডগমগ তনু শিহরিল।
একি সুত্রে প্রেম করুণ গাঁথা।
মৃদুল মৃদুল তাজ বে তাজ,[৩]
মৃদুল মৃদুল নও বে নও,
বাজিতে লাগিল মধুর বোলে;
শ্রবণে শীতল যতেক শ্রোতা।
“সংগ্রামে কি সুখ, সকলি অসুখ,
দিন রাত নাই প্রাণ ধুক ধুক্,
মান মর্য্যাদা কথার কথা।
ঘোড়া দড়বড়ি, অসি ঝনঝনি,
কাটাকাটি, গোল, তীর স্বন্স্বনি,
কাণে লাগে তালা করে ঝালাপালা,
দেহ হয় আলা সমর-স্রোতে ;
গতি অবিরাম নাহিক বিরাম,
সমরে কি সুখ নারি বুঝিতে।
চির দিন আর দনুজ সংহার
করে কত ভার সহিবে দেব;
বামে শচীসতী হের সুরপতি,
কর সুখভোগ রাখ বুকেতে।”—
বাখানিল যত কিন্নর কিন্নরী,
বাখানিল যত স্বর্গ-বিদ্যাধরী,
বাখানিল দেবগণ পুলকে।
রতিপতি জয় হলো সুরপুরে
ললিত মধুর বীণার সুরে;
সঙ্গীতের জয় হলো ত্ৰিলোকে।
স্মরে জর জর দেহ থর থর,
হেরে ঘন ঘন দেব পুরন্দর,
হৃদয়ে বামারে রাখিতে চায়;
নিমেষে হেরিছে নিমেষে ফিরিছে
নিমেষে নিশ্বাস বহিছে তায়।
শেষে পরাজিত অচেতন চিত,
শচী বক্ষস্থলে ঘুমায়ে রয়।
( চিতেন)
গাহিল কিন্নর,—“স্মরে জর জর
দেব পুরন্দর হলো পরাজয়,
নিমেষে হেরিছে নিমেষে ফিরিছে,
নিমেষে নিশ্বাস বহিছে তায়।
শেষে পরাজিত অচেতন চিত
শচী বক্ষস্থলে ঘুমায়ে রয়।”
৮
“বাজ্ রে বীণা বাজ্ রে আবার,
ঘন ঘোর রবে বাজ এইবার,
আরো উচ্চতর গভীর সুরে;
যাক্ দূরে যাক্ কামের কুহক
মেঘের ডাকে ডাক্ রে পূরে!
অহে সুররাজ ছিছি একি লাজ,
দেখ দেখ অই দনুজ সমাজ,
রণসাজ করে আসিছে ফিরে;
শিরে ফণীবাঁধা করে উল্কাপাত,
কর সুরনাথ দনুজ নিপাত,
দেখ চরাচর কাঁপিছে ডরে।
জলদ নিনাদে করে হুহুঙ্কার,
এ অমরপুরী করে ছারখার,
পূরণ আহুতি করিবে এবে।
কর দম্ভ চূর, বজ্র ধর শূর,
রাখ হে ব্রহ্মাণ্ড, বাঁচাও দেবে।”
শুনে বজ্রধর বেগে বজ্র ধরে,
কড় কড় ধ্বনি গরজে অম্বরে,
ভয়ে হিমগিরি টলিল।
তখন উল্লাসে, বিদ্যারথী হেসে,
বীণাযন্ত্র পাশে রাখিল।
(চিতেন)
“বেগে বজ্রধর,” গাহিল কিন্নর,
“কড় কড় নদে গরজে অম্বর,
ভয়ে হেমগিরি টলিল।
তখন উল্লাসে বিদ্যারথী হেসে
বীণাযন্ত্র পাশে রাখিল।”
————–
১. ইংরাজিতে এইরূপ স্থলে কোরস্ বলে। ঐ শব্দের অনুরূপ ঠিক অন্য কোন শব্দ না পাওয়ায় চিতেন লেখা হইয়াছে।
২. এই অমর গায়কের আর একটী নাম বিশ্বাবসু।
৩. দেবতারই সঙ্গীতের সৃষ্টিকর্ত্তা, সুতরাং এই লক্ষ্ণৌই সুরও দেবতাদিগের মধ্যে প্রচলিত থাকা সম্ভব।
উন্মাদিনী
অঙ্গে মাখ ছাই বলিহারি যাই,
কে রমণী আই পথে পথে গাই
চলেছে মধুর কাকলী করে।
কিবা উষাকাল, কিবা দ্বিপ্রহর,
বীণা ধরে করে ফিরে ঘরে ঘর,
পরাণে বাঁধিয়া মিলায়ে সুতান,
গায় উচ্চস্বরে সুললিত গান,
উতলা করিয়া কামিনী নরে।
অঙ্গে মাখ ছাই বলিহারি যাই,
কে রমণী আই পথে পথে গাই,
চলেছে মধুর কাকলী করে।
নয়নের কোণে চপলা খেলিছে,
নিতম্বের নীচে চিকুর দুলিছে,
করুণা মাখান বদনের ছাঁদ,
যেন অভিনব অবনীর চাদ,
কটি কর পদে ছড়ান মাধুরী,
গেরুয়া বসনে তনুয়া আবরি,
চলেছে সুন্দরী ভাবনা ভরে।
বলিহারি যাই অঙ্গে মাখা ছাই,
কে রমণী অই পথে পথে গাই,
চলেছে মধুর কাকলী করে।
২
অই শুন গায়, প্রাণের জ্বালায়—
“পাবনা পাবনা পাবনা কি তায়?
নাহি কি বিশাল ধরণী ভিতরে,
যেখানে বসিয়া স্নেহের নির্ঝরে,
মিটাই পিপাসা জুড়াই পরাণ,
দেখাই কিরূপ নারীর পরাণ,
প্রণয়ের দাম হৃদয়ে পর্যে।
যেখানে বহে না কলঙ্কের শ্বাস
কাঁদাতে প্রণয়ী, ঘুচাতে উল্লাস,
বায়ুতে, তরুতে, মাটীতে, আকাশে,
যেখানে মনের সৌরভ প্রকাশে,
ঘরের, পরের, মনের ভাবনা,
লোকের গঞ্জনা, প্রাণের যাতনা,
যেখানে থাকে না সখীর তরে।