আনিল আমায় হেথা যে বিষম দিনে,
বসাইল ধরাতলে পবিত্র অজিনে,
পরাইল বৃক্ষছাল দণ্ড দিল হাতে,
ভাব কি সে দিন আমি ভুলেছিনু নাথে?
প্রাণেশ্বর, চারিদিকে ঋষিগণ যত
করে মন্ত্র উচ্চারণ আমি ভাবি তত
তোমার বদন-ইন্দু, তোমার লোচন,
মনে মনে করি তব গুণেরি কীর্ত্তন;
নয়নের কোণে মাত্র বেদী পানে চাই
মনে সুধু কিসে পুনঃ ফিরে কাছে যাই।
যৌবন রূপের ঘটা তখনো অতুল,
হেরে চমৎকৃত হলো যত ঋষিকুল;
সংশয়ে বিস্ময়ে ভাবে এ হেন বয়সে
রমণী ইচ্ছায় কভু আশ্রমে কি আসে?
সত্য ভেবেছিলা তারা মিথ্যা কথা নয়—
যুবতীর যোগ ধর্ম্ম মিথ্যা সমুদয়।
যাই হোক্, নাই হবে গতি মুক্তি মম
বারেক নিকটে এস অহে প্রিয়তম।
সেই রূপে নয়নের বিষাক্ত অমৃত
করি পান মনসাধে হব বিমোহিত,
অধরে অধর দিয়ে হয়ে অচেতন
মূর্চ্ছাভাবে বক্ষঃস্থলে দেখিব স্বপন।
না না না, দুরন্ত আশা হও রে অন্তর,
এসো নাথ ধর্ম্মপথে লও হে সত্বর,
পুণ্যধামে পুণ্যজন যে আনন্দ পায়
শিখাও এ অভাগীরে, স্নিগ্ধ কর কায়।
আহা এই শুদ্ধ শান্ত আশ্রম ভিতরে
কতই পুণ্যাত্মা জীব আনন্দে বিহরে;
তরু লতা আদি হেথা সকলি নির্ম্মল,
সকলেই ভক্তিরসে সদাই বিহ্বল।
পর্ব্বত শিখর গুলি সুন্দর কেমন
উঠিয়াছে চারিধারে মেঘের বরণ;
শাল, তাল, তমালের তরু সারি সারি
শুনাইছে মৃদুস্বর দিবস শর্ব্বরী;
সুর্য্যকরে দীপ্ত হয়ে স্রোতকুল যত
শিখরে শিখরে আহা ভ্রমে অবিরত;
করে কুলুকুলু ধ্বনি গিরিপ্রস্রবণ,
গুহার ভিতরে আহা মধুর শ্রবণ।
সন্ধ্যা সমীরণে এই হ্রদের উপরে
তরঙ্গ খেলায় যবে কিবা শোভা ধরে।
হেন স্নিগ্ধ তপোবন ভিতরে আমার
ঘুচিল না এ জনমে ইন্দ্রিয় বিকার।
হে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডপতি করুণা নিদান,
করুণা কটাক্ষপাতে কর পরিত্রাণ।
দেও, দেব, দেখাইয়ে মুক্তির আলয়,
ভক্তি ভাবে লইলাম তোমারি আশ্রয়।
যমুনাতটে
১
আহা কি সুন্দর নিশি, চন্দ্রমা উদয়,
কৌমুদীরাশিতে যেন ধৌত ধরাতল
সমীরণ মৃদু মৃদু ফুলমধু বয়,
কল কল করে ধীরে তরঙ্গিণী জল!
কুসুম, পল্লব, লতা নিশার তুষারে
শীতল করিয়া প্রাণ শরীর জুড়ায়,
জোনাকির পাঁতি শোভে তরু শাখাপরে,
নিরবিলি ঝিঁ ঝিঁ ডাকে, জগত ঘুমায়;—
হেন নিশি একা আসি, যমুনার তটে বসি,
হেরি শশী ভুলে ভুলে জলে ভাসি যায়।
২
কে আছে এ ভূমগুলে, যখন পরাণ
জীবন-পিঞ্জরে কাঁদে যমের তাড়নে,
যখন পাগল মন ত্যজে এ শ্মশান
ধায় শূন্যে দিবানিশি প্রাণ অন্বেষণে,
তখন বিজন বন, শান্ত বিভাবরী,
শান্ত নিশানাথজ্যোতি বিমল আকাশে,
প্রশস্ত নদীর তট, পর্ব্বত উপরি,
কার না তাপিত মন জুড়ায় বাতাসে।
কি সুখ যে হেনকালে, গৃহ ছাড়ি বনে গেলে,
সেই জানে প্রাণ যার পুড়েছে হুতাশে।
৩
ভাসায়ে অকুল নীয়ে ভবের সাগরে
জীবনের ধ্রুবতারা ডুবেছে যাহার,
নিবেছে সুখের দীপ ঘোর অন্ধকারে,
হু হু করে দিবা নিশি প্রাণ কাঁদে যার,
সেই জানে প্রকৃতির প্রাঞ্জল মূরতি,
হেরিলে বিরলে বসি গভীর নিশিতে,
শুনিলে গভীর ধ্বনি পবনের গতি,
কি সাত্ত্বনা হয় মনে মধুর ভাবেতে।
না জানি মানব মন, হয় হেন কি কারণ,
অনন্ত চিন্তার গামী বিজন ভূমিতে।
৪
হায় রে প্রকৃতি সনে মানবের মন,
বাঁধা আছে কি বন্ধনে বুঝিতে না পারি,
নতুবা যামিনী দিবা প্রভেদে এমন,
কেন হেন উঠে মনে চিন্তার লহরী?
কেন দিবসেতে ভুলি থাকি সে সকলে
শমন করিয়া চুরি নিয়াছে যাহায়?
কেন রজনীতে পুনঃ প্রাণ উঠে জ্বলে,
প্রাণের দোসর ভাই প্রিয়ার ব্যথায়?
কেন বা উৎসবে মাতি, থাকি কভু দিব রাতি,
আবার নির্জনে কেন কাঁদি পুনরায়?
৫
বসিয়া যমুনাতটে হেরিয়া গগন,
ক্ষণে ক্ষণে হলো মনে কত যে ভাবনা,
দাসত্ব, রাজত্ব, ধর্ম্ম, আত্ম্যবন্ধুজন,
জরা, মৃত্যু, পরকাল, যমের তাড়না!
কত আশা, কত ভয়, কতই আহ্লাদ,
কতই বিষাদ আসি হৃদয় পূরিল,
কত ভাঙি, কত গড়ি, কত করি সাধ,
কত হাসি, কত কাঁদি, প্রাণ জুড়াইল।
রজনীতে কি আহ্লাদ, কি মধুর রসাস্বাদ,
বৃন্তভাঙা মন যার সেই সে বুঝিল!
লজ্জাবতীলতা
১
ছুঁইও না ছুঁইও না উটি লজ্জাবতীলতা।
একান্ত সঙ্কোচ করে, এক ধারে অাছে সরে,
ছুঁইও না উহার দেহ, রাখ মোর কথা।
তরু লতা যত আর, চেয়ে দেখ চারি ধার,
ঘেরে আছে অহঙ্কারে—উটি আছে কোথা!
আহা অই খানে থাক, দিও না ক ব্যথা ।
ছুঁইলে নখের কোণে, বিষম বাজিবে প্রাণে,
যেইও না উহার কাছে খাও মোর মাথা;
ছুঁইও না ছুঁইও না উটি লজ্জাবতীলতা।
২
লজ্জাবতীলতা উটি অতি মনোহর ।
যদিও সুন্দর শোভা নাহি তত মনোলোভা,
তবুও মলিন বেশ মরি কি সুন্দর।
যায় না কাহার পাশেমান মর্যাদার আশে,
থাকে কাঙ্গালির বেশে এক নিরন্তর—
লজ্জাবতী লতা উটি মরি কি সুন্দর!
নিশ্বাস লাগিলে গায়, অমনি শুকায়ে যায়,
না জানি কতই ওর কোমল অন্তর।
এ হেন লতার হয়, কে জানে আদর!
৩
হায় এই ভূমণ্ডলে, কত শত জন,
দণ্ডে দণ্ডে ফুটে উঠে, অবনী মণ্ডল লুঠে,
শুনায় কতই রূপ যশের কীর্ত্তন!
কিন্তু হেন ম্রিয়মাণ, সদা সঙ্কুচিত প্রাণ,
পুরুষ রমণী হেরে কে করে যতন?
স্বভাব মৃদুল ধীর, প্রকৃতিটী সুগম্ভীর,
বিরলে মধুরভাষী মানসরঞ্জন;
কে জিজ্ঞাসি তাহাদের করে সম্ভাষণ?
সমাজের প্রান্ত ভাগে তাপিত অন্তরে জাগে,
মেঘে ঢাকা আভাহীন নক্ষত্র যেমন।
ছুঁইও না উহার দেহ করি নিবারণ;
লজ্জাবতী লতা উটি মানসরঞ্জন।
হতাশের আক্ষেপ
(১)