ত্যজিয়ে সংসারধর্ম্ম তপস্বিনী হয়েছি,
মায়ামোহ আশাতৃষ্ণা বিসর্জ্জন দিয়েছি!
পরিয়ে বল্কল সাজ কমণ্ডলু করে,
ধরেছি কঠোর ব্রত কানন ভিতরে।
দিবাসন্ধ্যা পূজা ধ্যান দেব-আরাধনা
করি, তবু মনে কেন হয় সে ভাবনা?
যার জন্যে দেশত্যাগী কেন পুনরায়
অশান্ত হৃদয় হেন তারি দিকে ধায়?
কেন রে উন্মাদমন কেন দিলি তুলে
যে বাসনা এত দিন আছিলাম ভুলে?
জ্বালাতে নির্ব্বাণ বহ্নি কেন দিলি দেখা
অরে সুধাময় লিপি দয়িতের লেখা?
আয় তোরে বুকে রাখি বহু দিন পরে
পেয়েছি নাথের লেখা অমৃত অক্ষরে!
এজগতে ভালবাসা ভুলিবার নয়,
মদনের পারিজাত ব্রহ্মাণ্ড ঘোষয়!
ক্ষমা কর যোগী ঋষি জিতেন্দ্রিয় জন,
ক্ষমা কর সতী সাধ্বী তপস্বিনীগণ!
অয়ি শান্ত সুপবিত্র আশ্রমমণ্ডল,
তরু, বারি, লতা, পত্র যথায় নির্ম্মল,
নিষ্পাপ নিষ্কাম চিন্তা যথায় নিয়ত
পরমার্থ ধ্যানে মুগ্ধ আনন্দে জাগ্রত,
ক্ষমা কর এ দাসীরে, কলুষচিন্তায়
কলুষিত করিলাম তোমা সবাকায়।
আসিলাম যবে হেথা করে মহাব্রত
ভাবিলাম হব শীঘ্র তোমাদেরি মত;
ধবল শিলার সম স্বেদক্লেদহীন,
ধবল শিলার সম মমতাবিহীন।
কই হলো? অসাধ্য সে পবিত্র কামনা;
জীবিত থাকিতে, নাথ, যাবে না বাসনা।
অর্দ্ধেক দিয়াছি প্রাণ ঈশ্বর সেবিতে,
অর্দ্ধেক রেখেছি, হায়, নাথেরে পূজিতে।
অনাহার জাগরণে হলো দেহ ক্ষয়,
তবু দেখ স্বভাবের গতিরোধ নয়।
কাটালাম এতকাল সন্তাপে সস্তাপে,
সে নাম দেখিবামাত্র তবু চিত্ত কাঁপে।
কাঁপিতে কাঁপিতে নাথ খুলি এ লিখন;
প্রতি ছত্রে করিতেছি অশ্রু বিসর্জ্জন।
যেখানে তোমার নাম দেখি, প্রাণেশ্বর,
সেইখানে কেঁদে উঠে আমার অন্তর!
কতই আনন্দ আর কতই বিষাদ
আছে ও মধুর নামে কে জানে আস্বাদ।
কত বার ধীরে ধীরে করি উচ্চারণ,
কত বার ফিরে ফিরে করি নিরীক্ষণ।
ফেলি কত দীর্ঘশ্বাস সে সব স্মরিয়ে
আছি হেথা একাকিনী সে সব ত্যজিয়ে।
যেখানে আমার নাম দেখিবারে পাই,
সেইখানে, প্রাণনাথ, আতঙ্কে ডরাই।
পাছে কোন অমঙ্গল সঙ্গে থাকে তার,
অমঙ্গল হেতু, নাথ, আমি হে তোমার।
না পারি পড়িতে আর, সহে না হৃদয়;
শোকের সমুদ্র হেরি চতুর্দ্দিকময়।
অদৃষ্টে কি এই ছিল সেই ভালবাসা
এইরূপে হলো শেষ, শেষে এই দশা!
সে যশ-পিপাসা আর সে হেন প্রণয়
পত্রের কুটীরে হলো এইরূপে লয়।
যত পার হেন লিপি লিখ তবু নাথ,
করিব তোমার সঙ্গে শোক-অশ্রুপাত,
মিশাইব দীর্ঘশ্বাস তোমার নিশ্বাসে,
কাঁদিব তোমার সঙ্গে চিত্তের উন্নাসে;
ঘুচাইতে এ যন্ত্রণা সাধ্য নাই কার,
তাই নিবেদন করি লিখ যত পার।
অনাথা দুঃখীর দুঃখ করিতে সাত্ত্বনা
হয়েছে লিপির সৃষ্টি বিধির বাসনা।
বুঝি কোন নির্ব্বাসিত পুরুষপ্রেমিক,
অথবা রমণী কোন প্রেমের পথিক,
ঘুচাতে বিচ্ছেদজ্বালা আরাধনা করে
শিখেছিল এ কৌশল বিধাতার বরে।
প্রাণভোরে অন্তরের কথা প্রকাশিতে
এমন উপায় আর নাই এ মহীতে।
নাসা, কণ্ঠ, চক্ষু কিম্বা ওষ্ঠে যাহা নয়,
লিপির অক্ষরে ব্যক্ত হয় সমুদয়।
খুলে দেয় একেবারে প্রাণের কপাট,
ধারে না লজ্জার ধার, থাকে না ঝঞ্ঝাট।
উদয়-ভূধর হতে অস্তাচলে যায়,
প্রণয়ী জনের কথা গোপনে জানায়।
জান ত হে প্রিয়তম! প্রথমে কেমন
সখাভাবে কত ভক্তি করেছি যতন।
জানি নাই প্রথম সে প্রেমের সঞ্চার
ভাবিতাম যেন কোন দেবের কুমার;
ঈশ্বর আপনি যেন স্বহস্তে করিয়া
নির্ম্মাণ করিলা তোমা নিজ রশ্মি দিয়া;
সুধাংশুর অংশু যেন করে একত্রিত,
সহাস্য নয়নে তব করিলা স্থাপিত।
নেত্রে নেত্রে মিলাইয়া স্থিরদৃষ্টি হয়ে
দেখিয়াছি কতবার পবিত্র হৃদয়ে।
গাহিতে যখন তুমি অমর শুনিত
কি মধুর শাস্ত্রালাপ বদনে ক্ষরিত!
সে সুস্বরে কার মনে না হয় প্রত্যয়—
প্রেমেতে নাহিক পাপ ভাবিনু নিশ্চয়।
ভক্তি ছিঁড়ে পড়িলাম ইন্দ্রিয়কুহকে
ভজিনু নাগর ভাবে প্রাণের পুলকে।
দেবপুত্র ভাবিতাম, তা হোতে অধিক
প্রিয়তম হলে নাথ হইয়ে প্রেমিক।
তোমা হেন কান্ত যদি মর্ত্তভূমে পাই,
ঋষি হয়ে স্বর্গসুখ ভুঞ্জিতে না চাই।
যে ভাবে অধিক সুখ সে যাক সেখানে,
আমি যেন তোমা লয়ে থাকি এ ভুবনে।
অয়ি নাথ! কত জন, আছে ত স্মরণ,
বলেছিল পতিভাবে করিতে বরণ;
তখনি দিয়াছি শাপ হোক্ বজ্রাঘাত,
পরিণয় সংস্কার যাক্ রে নিপাত।
হাতে সুতো বেঁধে কভু প্রেমে বাধা যায়?
বন্ধন দেখিলে প্রেম তখনি পলায়।
স্বাধীন মকরকেতু, স্বাধীন প্রণয়,
না বুঝে অবোধ লোক চাহে পরিণয়।
পরিণয়ে ধন হয়, নাম হয়, যশ,
প্রণয় নহেক ধন বিভবের বশ।
ভূমণ্ডলপতি যদি চরণে আমার
ধরে দেয় ভূমণ্ডল, সিংহাসন তার,
তুচ্ছ করে দূরে ফেলি; মনে যদি ধরে
ভিকারীর দাসী হয়ে থাকি তার ঘরে।
যে রমণী সে সৌভাগ্য ভুঞ্জে চিরকাল
কত ভাগ্যবতী সেই, হায় রে কপাল!
কিবা সুধাময় সেই সুখের সময়,
সুখের সাগর যেন উচ্ছসিত হয়।
পরাণে পরাণ বাঁধা প্রণয়ের ভরে,
পরিপূর্ণ পরিতোষ প্রেমীর অন্তরে।
অাশার থাকে না ক্ষোভ, ভাষার যোজনা
হৃদয়ে হৃদয়ে কথা প্রকাশে আপনা।
সেই সুখ—সুখ যদি থাকে মহীতলে—
পারিজাত মদনের ছিল কোন কালে।
সে সুখের দিন এবে কোথায় গিয়েছে,
কোথা পারিজাত কোথা মদন রয়েছে!
কি হলো কি হলো হয় একি সর্ব্বনাশ,
নাথের দুর্দ্দশা এত, কোরে নগ্নবাস
কে করিল অস্ত্রাঘাত! কোথায় তখন
ছিল দাসী পারিজাত অভাগী দুর্জন?
সেই দণ্ডে, প্রাণনাথ, তীক্ষ্ণ অস্ত্র ধরে
নিবারণ করিতাম পাষণ্ড বর্ব্বরে।
দুজনে করেছি পাপ দুজনে সহিব
লজ্জা করে, প্রাণনাথ, কি আর বলিব।
অশ্রু বিসর্জ্জনে এবে মিটাই সে সাধ;
দগ্ধ বিধি ঘটাইলি ঘোর পরমাদ!