ধিক্ হিন্দুজাতি হয়ে আর্য্যবংশ,
নরকণ্ঠহার নারী কর ধংস!
ভুলে সদাচার, দয়া, সদাশয়,
কর আর্যভূমি পূতিগন্ধময়,
ছড়ায়ে কলঙ্ক পৃথিবী মাঝে!—
দেখ না কি চেয়ে জগত উজ্জ্বল
এই সে ভারত, হিমানী অচল,
এই সে গোমুখী, যমুনার জল,
সিন্ধু, গোদাবরী, সরযূ সাজে?
জান না কি সেই অযোধ্যা, কোশল
এই খানে ছিল কলিঙ্গ পঞ্চাল?
মগধ, কনৌজ,—সুপবিত্র ধাম
সেই উজ্জয়িনী—নিলে যার নাম
ঘুচে মনস্তাপ, কলুষ হরে?
এই রঙ্গভূমে করেছিল লীলা
আত্রেয়ী, জানকী, দ্রৌপদী সুশীলা,
খনা, লীলাবতী প্রাচীন মহিলা—
সাবিত্রী, ভারত পবিত্র করে?—
অরে কুলাঙ্গার হিন্দু দুরাচার—
এই কি তোদের দয়া, সদাচার?
হয়ে আর্য্যবংশ, অবনীর সার
রমণী বধিছ পিশাচ হয়ে?
এখনও ফিরিয়া দেখ না চাহিয়া
জগতের গতি ভ্রমেতে ডুবিয়া—
চরণে দলিয়া মাতা, সুতা, জায়া
এখনও রয়েছ উন্মত্ত হয়ে?
————–
১. অর্থাৎ ইউরোপীয়
ভারত বিলাপ
ভানু অস্ত গেল, গোধুলি আইল;—
রবি-কর-জাল আকাশে উঠিল,
মেঘ হ’তে মেঘে খেলিতে লাগিল,
গগন শোভিল কিরণজালে;—
কোথা বা সুন্দর ঘন কলেবর
সিন্দূরে লেপিয়া রাখে থরেথর,
কোথা ঝিকি ঝিকি হীরার ঝালর
যেন বা ঝুলায় গগন ভালে।
সোণার বরণ মাখিয়া কোথায়
জলধর জ্বলে—নয়ন জুড়ায়,
আবার কোথায় তুলারাশি প্রায়
শোভে রাশি রাশি মেঘের মালা।
হেনকালে একা গিয়া গঙ্গাতীরে
হেরি মোনহর সে তট উপরে
রাজধানী এক, নব শোভা ধরে,
রয়েছে কিরণে হয়ে উজলা।
দ্বিতালা ত্রিতালা চৌতালা ভবন,
সুন্দর সুন্দর বিচিত্র গঠন,
রাজবর্ত্ম পাশে আছে সুশোভন—
গোধূলি রাগেতে রঞ্জিত কায়।
অদূরে দুর্জ্জয় দুর্গ গড়খাই,
প্রকাণ্ড মুরতি, জাগিছে সদাই,
বিপক্ষ পশিবে হেন স্থান নাই—
চরণ প্রক্ষালি জাহ্নবী ধায়।
গড়ের সমীপে আনন্দউদ্যান,
যতনে রক্ষিত অতি রম্যস্থান,
প্রদোষে প্রত্যহ হয় বাদ্যগান,
নয়ন, শ্রবণ, তনু জুড়ায়।
জাহ্ণবী সলিলে এদিকে আবার
দেখ জলযান কাতারে কাতার
ভাসে দিবানিশি—গুণবৃক্ষ যার
শালবৃক্ষ ছাপি ধ্বজা উড়ায়।
অহে বঙ্গবাসি জান কি তোমরা?
অলকা জিনিয়া হেন মনোহরা
কার রাজধানী? কি জাতি ইহারা?—
এ সুখ সৌভাগ্য ভোগে ধরায়।
নাহি যদি জান, এসো এই খানে,
চলেছে দেখিবে বিচিত্র বিমানে
রাজপুরুষের বিবিধ বিধানে—
গরবে মেদিনী ঠেকে না পায়।
অদূরে বাজিছে। “রুল বৃট্যানিয়া,”
শকটে শকটে মেদিনী ছাইয়া
চলেছে দাপটে বৃটনবাসীয়া—
ইন্দ্রের ইন্দ্রত্ব আছে কোথায়!
হায় রে কপাল, ওদেরি মতন
আমরাই কেন করিতে গমন
না পারি সতেজে—বলিতে আপন
যে দেশে জনম, যে দেশে বাস?
ভয়ে ভয়ে যাই, ভয়ে ভয়ে চাই,
গৌরাঙ্গ দেখিলে ভূতলে লুটাই,
ফুটিয়ে ফুকারি বলিতে না পাই—
এমনি সদাই হৃদয়ে ত্রাস।
কি হবে বিলাপ করিলে এখন,
ভারত ঐশ্বর্য্য গিয়াছে যখন,
মনের মাহাত্ম্য হয়েছে নিধন—
তখনি সে সাধ ঘুচে গিয়াছে।
সাজে না এখন অভিলাষ করা—
আমাদের কাজ সুধু পায়ে ধরা—
শিরেতে ধরিয়া কলঙ্কের ভরা
ছুটিতে হইবে ওদেরি পাছে!
হায় বসুন্ধরা তোমার কপালে
এই কি ছিল মা, উদয়ের কালে
জগত কাঁদায়ে কিরণ ডুবালে—
পূরাতে নারিলে মনের আশা।
রূপে অনুপম নিখিল ধরায়
করিয়া বিধাতা সৃজালা তোমায়—
দিলা সাজাইয়া অতুল ভূষায়—
তোর কি না আজি এ হেন দশা!
হায় রে বিধাতা, কেন দিয়াছিলি
হেন অলঙ্কার? কেন না গঠিলি
মরুভূমি করে—অরণ্যে রাখিলি,
এ হেন যাতনা হতো না তায়!
পারস্য পাঠান মোগল প্রভৃতি
হরিতে ভারত কিরীটের জ্যোতিঃ
আসিত না হেথা, করিয়া দুর্গতি—
অভাগা হিন্দুরে দলিতে পায়!
এই যে দেখিছ পুরী মনোহর
শতগুণ আরো শোভিত সুন্দর,
এই ভাগীরথী করে থরে থর
ধাইত তখন কতই সাধে!
গাইত তখন কতই সুস্বরে
এই সব পাখী তরু শোভা করে,
কতই কুসুম পরিমল ভরে
ফুটিয়া থাকিত কত আহ্লাদে।
আগেকার মত উঠিত তপন,—
আগেকার মত চাঁদের কিরণ
ভাসিত গগনে—গ্রহ তারাগণ
ঘুরিত আনন্দে ঘেরিয়া ধরা;—
যখন ভারতে অমৃতের কণা
হতো বরিষণ, বাজাইত বীণা
ব্যাস বাল্মীকি—বিপুল বাসনা
ভারত হৃদয়ে আছিল ভরা।
যখন ক্ষত্রিয় অতীব সাহসে
ধাইত সমরে মাতি বীর-রসে,
হিমালয়চুড়া গগন পরশে
গাইত যখন ভারত নাম।
ভারতবাসীরা প্রতি ঘরে ঘরে
গাইত যখন স্বাধীন অন্তরে
স্বদেশ মহিমা পুলকিত স্বরে,—
জগতে ভারত অতুল ধাম।
ধন্য বৃট্যানিয়া ধন্য তোর বল,
এ হেন ভূভাগ করে করতল,
রাজত্ব করিছ ইঙ্গিতে কেবল—
তোমার তেজের নাহি উপমা।
এখন কিঙ্কর হয়েছি তোমার
মনের বাসনা কি কহিব আর,
এই ভিক্ষা চাই করো গো বিচার—
অথর্ব্ব দাসীরে করে গো ক্ষমা।
দেখ্ চেয়ে দেখ্ প্রাচীন বয়েসে
তোর পদতলে পড়িয়ে কি বেশে
কঁদিছে সে ভূমি, পূজিত যে দেশে
কত জনপদ গাহি মহিমা।
আগে ছিল রাণী—ধরা রাজধানী,
স্মরণে যেন গো থাকে সে কাহিনী,
এবে সে কিঙ্করী হয়েছে দুখিনী
বলিয়ে দম্ভ করো না গরিমা।
তোমারো ত বুকে কত কত বার
রিপু পদাঘাত করেছে প্রহার
কালেতে না জানি কি হবে আবার
এই কথা সদা করো গো মনে।
পেয়েছ অমূল্য রতন ধরার
করো না ইহারে চরণে প্রহার—
দিও না যাতনা ভারত প্রাণে।
মদনপারিজাত
[একাদশ খৃষ্টাব্দে ফরাসীদেশে আবেলার্ড নামক একজন প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি তর্কশাস্ত্র অধ্যাপনা করাইয়া প্রভূত যশস্বী হন। অন্যান্য শিষ্যের ন্যায় ইলইজা নাম্নী এক সম্ভ্রান্ত কন্যা তাহার নিকট অধ্যয়ন করিতেন। এই কামিনী অত্যন্ত রূপবতী এবং বুদ্ধিমতী ছিলেন। ক্রমে গুরুশিষ্যের ভাবান্তর হইয়া উভয়ের প্রতি উভয়ের আসক্তি জন্মে, এবং সেই কলঙ্ক দেশমধ্যে প্রচারিত হয়। তাহাতে ইলইজার পিতৃব্য অসহ্য রোষপরতন্ত্র হইয়া ইলইজাকে একটী কনভেন্টে আবদ্ধ করিয়া রাখেন, এবং আবেলার্ডকে ক্ষতদেহ করিয়া অবমানিত করেন। রোমান কাথলিকদিগের মধ্যে সংসারবিরাগী-ধর্ম্মাকাঙ্ক্ষী স্ত্রীপুরুষগণ যে আশ্রমে বাস করে, তাহার নাম কনভেন্ট। ইলইজা সেই আশ্রমে অবরুদ্ধ হইয়া বহু কষ্টে দিনপাত করিত। এবং আবেলার্ডও প্রাগুক্ত রূপে অবমানিত হইবার পর সংসারে বিরাগী হইয়া অন্য এক আশ্রমে প্রস্থান করেন। ইহাদিগের পরস্পরের প্রণয়ঘটিত উপাখ্যান ইউরোপীয় নানা ভাষায় আছে। আলেকজন্দর পোপ নামক একজন ইংরাজী কবি এই উপাখ্যান অবলম্বনে একটী কবিতা লেখেন; তদ্দৃষ্টে “মদনপারিজাত” নাম দিয়া নিম্নোক্ত কবিতা লিখিত হইয়াছে।]