৩
হায় রে নিষ্ঠুর জাতি পাষাণ-হৃদয়,
দেখে শুনে এ যন্ত্রণা তবু অন্ধ হয়;
বালিকা যুবতী ভেদ করে না বিচার,
নারী বধ করে তুষ্ট করে দেশাচার।
এই যদি এ দেশের শাস্ত্রের লিখন,
এ দেশে রমণী তবে জন্মে কি কারণ?
পুরুষ দুদিন পরে, আবার বিবাহ করে,
অবল রমণী বলে এতই কি সয় রে?
৪
কেঁদেছি অনেক দিন কাঁদিব না অার;
পূরাইব হৃদয়ের কামনা এবার।—
ঈশ্বর থাকেন যদি করেন বিচার
করিবেন এ দৌরাত্ম্য সমুলে সংহার;
অবিলম্বে হিন্দুধর্ম্ম ছারখার হবে
হিন্দুকুলে বাতি দিতে কেহ নাহি রবে!
দেখ্ রে দুর্ম্মতি যত চিরম্লেচ্ছপদানত—
বিধবার শাপে হায় এ দুর্গতি হয় রে।
৫
হায় রে আমার যদি থাকিত সম্পদ,
মিটাতাম চিরদিন মনের যে সাধ;
সোণার প্রতিমা গড়ে বিধবা নারীর
রাখিতাম স্থানে স্থানে ভারতভূমির;
বিদেশের স্ত্রী পুরুষ এদেশে আসিত,
পতিব্রতা বলে কারে নয়নে হেরিত।
লিখিতাম নিম্নদেশে, “কি স্বদেশে কি বিদেশে,
রমণী এমন আর ধরাতলে নাই রে”
৬
সে ধন সম্পদ নাই দরিদ্র কাঙ্গাল,
অনাথ-বিধবা-দুঃখ রবে চিরকাল
আমার অন্তরে গাঁথা; যখনি দেখিব
সুগন্ধ কুসুমে কীট তখনি কাঁদিব;
রাহুগ্রাসে শশধর, নক্ষত্র পতন
যখনি দেখিব, হায়, করিব স্মরণ
বিধবা নারীর মুখ! হায় রে বিদরে বুক,
ইচ্ছা করে জন্মশোধ দেশত্যাগী হই রে।
ভারতের পতিহীনা নারী বুঝি আই রে॥
ভারত কামিনী
আরে কুলাঙ্গার হিন্দু দুরাচার—
এই কি তোদের দয়া, সদাচার?
হয়ে আর্য্যবংশ—অবনীর সার
রমণী বধিছ পিশাচ হয়ে!
এখনও ফিরিয়া দেখনা চাহিয়া
জগতের গতি ভ্রমেতে ডুবিয়া—
চরণে দলিয়া মাতা, সুতা, জায়া,
এখনো রয়েছ উন্মত্ত হয়ে?
বাঁধিয়া রেখেছ বামা রাশি রাশি
অনাথ করিয়া—গলে দিয়া ফাঁসি,
কাড়িয়া লয়েছ কবরী, কঙ্কণ,
হার, বাজু, বালা, দেহের ভূষণ—
অনন্ত দুখিনী বিধবা নারী।
দেখ রে নিষ্ঠুর, হাতে লয়ে মালা
কুলীন সধবা অনূঢ়া অবলা
অাছে পথ চেয়ে পতির উদ্দেশে,
অসংখ্য রমণী পাগলিনী বেশে—
কেহ বা করিছে বরমাল্য দান
মুমূর্ষুর গলে হয়ে ম্রিয়মাণ
নয়নে মুছিয়া গলিত বারি!
চারিদিকে হেথা ভারত যুড়িয়া,
সরলীকমল যেন রে ছিঁড়িয়া—
কামিনীমণ্ডলী রেখেছ তুলিয়া—
কোমল হৃদয় করেছ হতাশ,
না দেখিতে দেও অবনী আকাশ—
করে কারাবাস জগতে রয়ে।
আরে কুলাঙ্গার, হিন্দু দুরাচার—
এই কি তোদের দয়া, সদাচার?
হয়ে আর্য্যবংশ, অবনীর সার
রমণী বধিছ পিশাচ হয়ে?
এখনও ফিরিয়া দেখনা চাহিয়া
জগতের গতি ভ্রমেতে ডুবিয়া—
চরণে দলিছ মাতা, সুতা, জায়া,
ছড়ায়ে কলঙ্ক পৃথিবী মাঝে।—
দেখ না কি চেয়ে জগত উজ্জ্বল
এই সে ভারত, হিমানী অচল,
এই সে গোমুখী, যমুনার জল,
সিন্ধু, গোদাবরী সরযূ সাজে?
জান না কি সেই অযোধ্যা, কোশল,
এই খানে ছিল, কলিঙ্গ পঞ্চাল,
মগধ, কনৌজ,—সুপবিত্র ধাম
সেই উজ্জয়িনী, নিলে যার নাম
ঘুচে মনস্তাপ কলুষ হরে?
এই রঙ্গভূমে করেছিল লীলা
আত্রেয়ী, জানকী, দ্রৌপদী সুশীলা,
খনা, লীলাবতী প্রাচীন মহিলা—
সাবিত্রী ভারত পবিত্র করে।
এই আর্য্যভূমে বাঁধিয়া কুন্তল
ধরিয়া কৃপাণ কামিনী সকল,
প্রফুল্ল স্বাধীন পবিত্র অন্তরে
নিঃশঙ্ক হৃদয়ে ছুটিত সমরে—
খুলে কেশপাশ দিত পরাইয়া
ধনুদণ্ডে ছিলা আনন্দে ভাসিয়া—
সমর-উল্লাসে অধৈর্য্য হয়ে—
কোথা সে এখন অসিভল্লধার
মহারাষ্ট্র বামা, রাজোয়ার নারী?
অরাতি বিক্রমে পরাজিত হলে
চিতানলে যারা তনু দিত ঢেলে
পতি, পিতা, সুত, সংহতি লয়ে।
বীরমাতা যার বীরাঙ্গনা ছিল,
মহিমা কিরণে জগত ভাতিল—
কোথা এবে তারা—কোথা সে কিরণ?
আনন্দ কানন ছিল যে ভুবন
নিবিড় অটবী হয়েছে এবে!
আর কি বাজে সে বীণা সপ্তস্বরা
বিজয় নিনাদে বসুন্ধরা ভরা?
আর কি আছে সে মনের উল্লাস,
জ্ঞানের মর্য্যাদা, সাহসবিভাস
সে সব রমণী কোথা রে এবে?
সে দিন গিয়াছে—পশুর অধম
হয়েছে ভারতে নারীর জনম;
নৃশংস আচার, নীচ দুরাচার
ভারত ভিতরে যত কুলাঙ্গার
পিশাচের হেয় হয়েছে সবে।
তবে কেন আজও আছে ঐ গিরি
নাম হিমালয়, শৃঙ্গ উচ্চে ধরি?
তবে কেন আজও করিছে হুঙ্কার
ভারত বেষ্টিয়া জলধি দুর্ব্বার?
কেন তবে আজও ভারত ভিতরে
হিন্দুবংশাবলী শুনে সমাদরে
ব্যাস বালমীকি, বারিধারা ঝরে
সীতা, দময়ন্তী, সাবিত্রী রবে?—
গভীর নিনাদে করিয়ে ঝঙ্কার,
বাজ্ রে বীণা বাজ্ একবার,
ভারতবাসীরে শুনায়ে সবে।
দেখ্ চেয়ে দেখ্ হোথা একবার—
প্রফুল্ল কোমল কুসুম আকার
য়ুনানী[১] মহিলা হয় পারাপার
অকূল জলধি অকুতোভয়ে।
ধায় অশ্বপৃষ্ঠে অশঙ্কিত চিতে
কানন, কন্দর, উন্নত গিরিতে—
অপ্সরা আকৃতি পুরুষ সেবিতা
সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীতে ভূষিতা—
স্বাধীন প্রভাতে পবিত্র হয়ে।
আর কি ভারতে ওরূপে আবার
হবে রে অঙ্গনা-মহিমা প্রচার?—
পেয়ে নিজ মান, পরে নিজ বেশ
জ্ঞান, দত্ত তেজে পূরে নিজ দেশ,—
বীর বংশাবলী প্রসূতি হবে?
এহেন প্রকাণ্ড মহীখণ্ড মাঝে
নাহি কিরে কোন বীরাত্মা বিরাজে—
এখনি উঠিয়া করে খণ্ড খণ্ড
সমাজের জাল করাল প্রচণ্ড—
স্বজাতি উজ্জ্বল করিয়া ভবে?
চৈতন্য গৌতম নাহি কিরে আর,
ভারত সৌভাগ্য করিতে উদ্ধার?—
ঋষি বিশ্বামিত্র, রাঘব, পাণ্ডব,
কেন জন্মেছিলা মহাত্মা সে সব—
ভারত যদি না উন্নত হবে?