“যথাদর্শে তথাত্মনি যথাপ্স্যুৎপরিব তথা গন্ধর্ব্বলোকে
ছায়াতপয়োরিব ব্রহ্মলোকে৷”
এই ব্ৰহ্মলোক যেখানে ছায়া-তপে সমস্ত প্রকাশ পাচ্ছে, গন্ধৰ্বলোক যেখানে রূপ ও সুর উভয়ে জলের উপরে যেন তরঙ্গিত হচ্ছে, এবং আত্মার মধ্যে যেখানে নিখিলের সমস্তই দর্পণের মতো প্রতিবিম্বিত দেখা যাচ্ছে, সমস্তই দিব্য দৃষ্টিতে পরশ ও পরখ করে নিলে মানুষ। দর্শকের ও শ্রোতার জায়গায় বসে মানুষ দেখবার মতো করে দেখলে, শোনবার মত করে শুনে নিলে নিখিলের এই রূপের লীলা সুরের খেলা, এবং এরও ওপরে যে লীলাময় মানুষকে সমস্ত পদার্থ সমস্ত বস্তুর সঙ্গে একসূত্রে বেঁধে একই নাট্যশালায় নাচিয়ে গাইয়ে চলেছেন তাঁকে পর্যন্ত ছুঁয়ে এল মানুষ নেপথ্য সরিয়ে। দেখা শোনা পরশ করার চরম হয়ে গেল, তারপর এল দেখানোর পালা। মানুষ এবারে আর এক নতুন অদ্ভুত অনিয়ন্ত্রিত অভূতপূর্ব সৃষ্টি সাধন করে গুণী শিল্পী হয়ে বসলো। এই দৃষ্টিবলে আপনার কল্পনালোকের মনোরাজ্যের গোপনতা থেকে মানুষ নতুন নতুন সৃষ্টি বার করে আনতে লাগলো। যে এতদিন দর্শক ছিল সে হল প্রদর্শক, দ্রষ্টা হয়ে বসলো দ্বিতীয় স্রষ্টা। অরূপকে রূপ দিয়ে, অসুন্দরকে সুন্দর করে, অবোলাকে সুর দিয়ে, ছবিকে প্রাণ, রঙ্গহীনকে রং দিয়ে চল্লো মানুষ—
“প্রেমের করুণ কোমলতা
ফুটিল তা’
সৌন্দর্যের পুষ্পপুঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে॥”
দ্মের মৃণাল
পদ্মের মৃণাল এক, সুনীল হিল্লোলে,
দেখিলাম সরোবরে ঘন ঘন দোলে—
কখন ডুবায় কায়, কভু ভাসে পুনরায়,
হেলেদুলে আশে পাশে তরঙ্গের কোলে—
পদ্মের মৃণাল এক সুনীল হিল্লোলে।
শ্বেত আভা স্বচ্ছ পাতা, পদ্ম শতদলে গাঁথা,
উলটিপালটি বেগে স্রোতে ফেলে তোলে—
পদ্মের মৃণাল এক সুনীল হিল্লোলে।
একদৃষ্টে কতক্ষণ, কৌতুকে অবশ মন,
দেখিতে শোকের বেগ ছুটিল কল্পোলে—
পদ্মের মৃণাল এক তরঙ্গের কোলে।
২
সহসা চিন্তার বেগ উঠিল উথলি;
পদ্ম, জল, জলাশয় ভুলিয়া সকলি,
অদৃষ্টের নিবন্ধন ভাবিয়া ব্যাকুল মন—
অই মৃণালের মত হায় কি সকলি!
রাজ রাজমন্ত্রীলীলা, বলবীর্য্য স্রোতশীলা,
সকলি কি ক্ষণস্থায়ী দেখিতে কেবলি?—
অই মৃণালের মত নিস্তেজ সকলি!
অদৃষ্ট বিরোধী যার, নাহি কি নিস্তার তার,
কিবা পশুপক্ষী আর মানব মণ্ডলী?—
লতা, পশু, পক্ষী সম মানবেরো পরাক্রম,
জ্ঞান, বুদ্ধি, যত্ন, বলে বাঁধা কি শিকলি?—
অই মৃণালের মত হায় কি সকলি!
৩
কোথা সে প্রাচীনজাতি মানবের দল
শাসন করিত যারা অবনীমণ্ডল?
বলবীর্য্য পরাক্রমে ভবে অবলীলা ক্রমে,
ছড়াইত মহিমার কিরণ উজ্জ্বল—
কোথা সে প্রাচীনজাতি মানবের দল?
বঁধিয়ে পাষাণস্তুপ, অবনীতে অপরূপ,
দেখাইলা মানবের কি কৌশল বল—
প্রাচীন মিসরবাসী কোথা সে সকল?
পড়িয়া রয়েছে কূপ অবনীতে অপরূপ,
কোথা তারা, এবে কারা হয়েছে প্রবল
শাসন করিতে এই অবনীমণ্ডল।
৪
জগতের অলঙ্কার আছিল যে জাতি;
জ্বালিল উন্নতিদীপ অরুণের ভাতি;
অতুল্য অবনীতলে এখনো মহিমা জ্বলে,
কে আছে সে নরধন্য কুলে দিতে বাতি?—
এই কি কালের গতি, এই কি নিয়তি।
ম্যারাথন্, থার্মপলি, হয়েছে শ্মশানস্থলী
গিরীস আঁধারে আজ পোহাইছে রাতি;—
এই কি কালের গতি এই কি নিয়তি!
যার পদচিহ্ন ধরে, অন্য জাতি দম্ভ করে,
আকাশ পয়োধিনীরে ছড়াইছে ভাতি—
জগতের অলঙ্কার কোথায় সে জাতি।
৫
দোর্দ্দন্ত প্রতাপ যার কোথায় সে রোম?
কাঁপিত যাহার তেজে মহী, সিন্ধু, ব্যোম।
ধরণীর সীমা যার, ছিল রাজ্য অধিকার,
সহস্র বৎসরাবধি একাদি নিয়ম—
দোর্দ্দন্ত প্রতাপ আজি কোথায় সে রোম!
সাহস ঐশ্বর্য্যে যার, ত্রিভুবন চমৎকার—
সে জাতি কোথায় আজি, কোথা সে বিক্রম?
এমনি অব্যর্থ কি রে কালের নিয়ম!
কি চিহ্ন আছে রে তার, রাজপথ দুর্গে যার,
পৃথিবী বন্ধন ছিল কোথায় সে রোম?—
নিয়তির কাছে নর এত কি অক্ষম!
৬
আরবের পারস্যের কি দশা এখন;
সে তেজ নাহিক আর, নাহি সে তর্জ্জন।
সৌভাগ্য কিরণজালে, উহারাই কোন কালে
করেছিল মহাতেজে পৃথিবী শাসন।—
আরবের পারস্যের কি দশা এখন!
পশ্চিমে হিস্পানীশেষ, পূবে সিন্ধু হিন্দুদেশ,
কাফর যবনবৃন্দে করিয়া দমন—
উল্কা সম অকস্মাৎ হইল পতন!
“দীন” ব’ল্যে মহীতলে, যে কাণ্ড করিলা বলে,
সে দিনের কথা এবে হয়েছে স্বপন—
আরবের উপন্যাস অদ্ভুত যেমন!
৭
আজি এ ভারতে, হায়, কেন হাহাধ্বনি।
কলঙ্ক লিখিতে যার কাঁদিছে লেখনী।
তরঙ্গে তরঙ্গে নত পদ্মমৃণালের মত,
পড়িয়া পরের পায় লুটায় ধরণী।
আজি এ ভারতে কেন হাহাকার-ধ্বনি।
জগতের চক্ষু ছিল, কত রশ্মি ছড়াইল,
সে দেশে নিবিড় আজ আঁধার রজনী—
পূর্ণগ্রাসে প্রভাকর নিস্তেজ যেমনি!
বুদ্ধিবীর্য্য বাহুবলে, সুধন্য জগতী-তলে,
ছিল যারা আজি তারা অসার তেমনি।
আজি এ ভারতে কেন হাহাকার-ধ্বনি?
৮
কোথা বা সে ইন্দ্রালয়, কোথা সে কৈলাস!
কোথা সে উন্নতি আশা, কোথা সে উল্লাস।
দম্ভে বসুধার পরে, বেড়াইত তেজোভরে,
আজি তারা ভয়ে ভীত হয়েছে হতাশ—
কোথা বা সে ইন্দ্রালয়, কোথা সে কৈলাস!
কত যত্নে কত যুগে, বনবাসে কষ্ট ভুগে,
কালজয়ী হলো বল্যে করিত বিশ্বাস—
হায় রে সে ঋষিদের কোথা অভিলাষ!
সে শাস্ত্র, সে দরশন, সে দেব কোথা এখন?
পড়ে অাছে হিমালয় ভাবিয়া হতাশ—
কোথা বা সে ইন্দ্রালয়, কোথা সে কৈলাস!