“সন্ধ্যা হল গো—
ওমা সন্ধ্যা হল বুকে ধর
অতল কালে৷ স্নেহের মাঝে
ডুবিয়ে আমায় স্নিগ্ধ কর॥
ফিরিয়ে নে, মা, ফিরিয়ে নে গো
সব যে কোথায় হারিয়েছে গো
ছড়ানো এই জীবন, তোমার
আঁধার মাঝে হোক্ না জড়॥
আর আমারে বাইরে তোমার
কোথাও যেন না যায় দেখা
তোমার রাতে মিলাক আমার
জীবন-সাঁঝের রশ্মিরেখা॥
আমায় ঘিরি’ আমায় চুমি’
কেবল তুমি, কেবল তুমি!
আমার বলে যাহা আছে, মা
তোমার করে সকল হর॥”
বুক সন্ধ্যার বুকের স্পন্দন অনুভব করলে, নয়নের দৃষ্টি অতল কালোর স্নেহভরা পরশ নিবিড় করে উপভোগ করলে, ফিরে এলো নতুন করে তরুণ দৃষ্টির করুণ চাহনি, নতুন করে জাগালো প্রাণভরে শুনে নেবার, গেয়ে ওঠবার ইচ্ছা, সারা সংসারে ছড়ানো জীবনের দিনগুলো সাঁঝের আঁধারের মধ্যে দিয়ে মিল্লো এসে একেবারে।
সন্ধ্যা তারার কোলের কাছটিতে রহস্য নিকেতনে, আলো আর কালোর ছন্দে প্রাণকে দুলিয়ে দিলে, রাতের সুরে গিয়ে মিল্লো দিনের সুর, আঁধারে গিয়ে মিশলো—আলো। একেবারে ঢেলে দেওয়া গেল সব স্বার্থে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজকে গভীর রিক্ততার প্রশান্ত আলিঙ্গনে। সন্ধ্যা, কতদিন ধরে যার সঙ্গে দেখা-শোনা হয়ে আসছে তাকে এমন করে দেখা ক’জন দেখলে? নিত্য সন্ধ্যার হাওয়াটা গড়ের মাঠে গিয়ে খেয়ে এসে এবং পূজো-বাড়িতে গিয়ে শাঁখঘণ্টা শুনে এসে আমরা পুঁথিগত ত্রিসন্ধ্যার মন্ত্রগুলোর চেয়ে একটুও অধিক দেখতে শুনতে পেলেম না। কিন্তু কবীর দুছত্রে সমস্ত সন্ধ্যার প্রাণটি একমুহূর্তে টেনে আনলেন আমাদের দিকে—
“সাঁঝ পড়ে দিন বীতরে
চকরী দীন্হা রোয়।
চল চকরা বা দেশকো
জঁহা রৈন ন হোয়॥”
এ কোন্ অগম্য দেশের খবর এসে পৌঁছল! রাত্রির পরপারে যুগল তারার রাজত্বে যাবার সকরুণ ডাক, ভীরু-পাখীর গলার সুর ধরে’ এ কোন্ চির-মিলনের বাণী অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে এসে পৌঁছল যারা দেখেও দেখছে না, শুনেও শুনছে না, ধরেও ধরতে পারছে না তাদের কাছে!
যে চোখের দেখায় সন্ধ্যার অন্ধকার রাত্রির কালিমা শুধু আমাদের শঙ্কা আর সংশয়-বুদ্ধিই জাগিয়ে তোলে, ভাবুকের দেখা কি সেই চলতি চোখ দিয়ে দেখা, না তেমন শোনা দিয়ে, তেমন পরখ দিয়ে চেয়ে-দেখা, শুনে-দেখা, ছুঁয়ে-দেখা? এ সে ভাবুকের কবির শিল্পীর সেই দিব্য দৃষ্টি, যা অন্ধকারে আলো দেখলে, দুঃখের পরশেও আনন্দ পেল, অসীম স্তব্ধতার ভিতরে সন্ধান পেয়ে গেল সুরের—
“তিঁবির সাঁঝকা গহিরা আবৈ
ছাবৈ প্রেম মন অসেঁ
পশ্চিম দিগকী খিড়কী খোলো
ডুবহু প্রেম গগন মেঁ।
চেত-সংবল-দল রস পিয়োরে
লহর লেহ যা তনমেঁ॥
সংখ ঘণ্টা সহ নাই বাজে
শোভা-সিন্ধু মহল মেঁ॥”
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, আঁধারের প্রেম তনু মনকে আবৃত করলে, আলো যে দিকে অস্ত যাচ্ছে সেই দুয়ার খোলো, এই সন্ধ্যাকাশের মত বিস্তৃত অন্ধকারের প্রেমে নিমগ্ন হও, চিত্ত-শতদল পান করুক রাত্রির রস, মনে লাগুক, মনে ধরুক অতল কালোর প্রেম-লহরী, সীমাহীন গভীরে বাজ্তে থাকুক আরতির শঙ্খঘণ্টা, মিলনের বাঁশি,—আঁধার-সমুদ্রে ফুটে উঠুক অপরূপ রূপ।
এ যে হৃদয়ে এসে মিলতে চাইলো নূতনতরো দেখা শোনা ছোঁয়া দিয়ে বিশ্বচরাচরের সঙ্গে। আগে আসছিল মানুষের বাইরেটা তার বুদ্ধির গোচরে ইন্দ্রিয়ের সহায়তায় যন্ত্রে ধরা, এখন চল্লো মানুষের অন্তরটা বাইরের সঙ্গে মিলতে হাতে হাতে চোখে চোখে গলায় গলায়—বাইরের আসা এবং বেরিয়ে যাওয়া এরি ছন্দ আবিষ্কৃত হ’ল ভাবুক মানুষের জীবনে। অভিনিবেশ করে বস্তুতে ঘটনাতে নিবিষ্ট হবার শিক্ষা ও সাধনায় আপনার কার্যকরী ইন্দ্রিয়-শক্তি সকলকে নতুনতরো শক্তিমান করে তুল্লেন যে মুহূর্তে ভাবুক—সৌন্দর্যে অর্থে সম্পদে সৃষ্টির জিনিষ ভরে উঠলো, জগৎ এক অপরূপ বেশে সেজে দাঁড়ালো মানুষের মনের দুয়ারে; বারমহল ছেড়ে অভ্যাগত এল যেন অন্দরের ভিতর ভালবাসার রাজত্বে। রসের স্বাদ অনুভব করলে মানুষ, যেটা সে কিছুতে পেতে পারতো না যদি সে ইন্দ্রিয় সমস্তকে কেবলি প্রহরী ও মন্ত্রীর কায দিয়ে বসিয়ে রাখতো বুদ্ধির কোঠার দেউড়িতে। এই নতুন শিক্ষা, নতুন সাধনা যখন মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো লাভ করলে, তখন মানুষের কণ্ঠ শুধু বলা-কওয়া হাঁক-ডাক করেই বসে রইলো না; সে গেয়ে উঠলো। হাতের আঙ্গুলগুলো নানা জিনিষ স্পর্শ করে নরম গরম কঠিন কি মৃদু ইত্যাদির পরখ করেই ক্ষান্ত হল না, তারা সংযত হয়ে তুলি বাটালি সূঁচ হাতুড়ি এমনি নানা জিনিষকে চালাতে শিখে নিলে, বীণা-যন্ত্রের উপরে সুর ধরতে লাগলো হাত আঙ্গুলের আগা, শুধু লোহার তারকে তার মাত্র জেনেই ক্ষান্ত হল না, সুরের তার পেয়ে যন্ত্রের পর্দায় পর্দায় বিচরণ করতে থাকলো আঙ্গুলের পরশ গুন্ গুন্ স্বরে ফুলের উপরে ভ্রমরের মতো, কোলের বীণার সঙ্গে যেন প্রেম করে চল্লো হাত, কাণ শুনতে লাগলো প্রেমিকের মতো কোলের বীণার প্রেমালাপ। সরু সূঁচের, সোনার সূতোর, রংএ ভরা তুলির সজীব ছন্দ ধরে তালে তালে চল্লো আঙ্গুল, হাতুড়ি বাটালির ওঠা-পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাণ্ডব নৃত্য করতে শিক্ষা নিলে শিল্পীর হাত—কাযের ভিড় থেকে মানুষের চোখ ও হাত, সেই সঙ্গে মনও ছুটি পেয়ে খেলাবার ও ডানা মেলবার অবসর পেয়ে গেল।
সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে সৃষ্টির দিকে এই অভিনিবিষ্ট দৃষ্টি—এইটুকুই ভাবুকের সাধনার চরম হল তা তো নয়, সৃষ্টির বাইরে যা তাকেও ধরবার জন্যে ভাবুক আরো এক নতুন নেত্র খুল্লেন—খুবই প্রখর দৃষ্টি যার এমন যে দূরবীক্ষণ-যন্ত্র তাকেও হার মানালে মানুষের এই মানস-নেত্র, চোখের দৃষ্টি যেখানে চলে না,—দূরবীক্ষণের দূরদৃষ্টিরও অগম্য যে স্থান। মানুষ এই আর এক নতুন দৃষ্টির সাধনায় বলীয়ান্ হয়ে নিজের মনের দেখা নিয়ে বিশ্বরাজ্যের পরপারেও সন্ধানে বেরিয়ে গেল—সেই রাজত্বে যেখানে সৃষ্টির অবগুণ্ঠনে নিজকে আবৃত করে স্রষ্টা রয়েছেন গোপনে—