- বইয়ের নামঃ কবিতাবলী
- লেখকের নামঃহেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আর্যা সাহিত্য সামাচার
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অশোকতরু
১
কে তোমারে তরুবর, করে এত মনোহর,
রাখিল এ ধরাতলে, ধরা ধন্য কর্যে?
এত শোভা আছে কি এ পৃথিবী ভিতরে!
দেখ দেখ কি সুন্দর, পুষ্পগুচ্ছ থরেথর,
বিরাজে শাখীর পর সদা হাস্যভরে—
সিন্দূরের ঝারা যেন বিটপী উপরে!
মরি কিবা মনোলোভা, ছড়ায়ে রয়েছে শোভা,
আভা যেন উথলিয়া পড়িছে অম্বরে।—
কে আনিল হেন তরু পৃথিবী ভিতরে?
২
বল বল তরুবর, তুমি যে এত সুন্দর
অন্তরও তোমার, কি হে, ইহারি মতন?
কিম্বা সুধু নেত্রশোভা মানব যেমন?
আমি দুঃখী তরুবর, তাপিত মম অন্তর,
না জানি মনের সুখ, সন্তোষ কেমন;
তরুবর তুমি বুঝি না হবে তেমন?
অরে তরু খুলে বল, শুনে হই সুশীতল,
ধরণীতে সদানন্দ আছে এক জন,—
না হয় সন্তাপে যারে করিতে ক্রন্দন।
৩
জানিতাম, তরুবর, যদি হে তব অন্তর,
দেখাতাম একবার পৃথিবী তোমায়—
মানবের মনচিত্রে কি আছে কোথায়।
কত মরু, বালুস্তূপ, কত কাঁটা, শুষ্ক কূপ,
ধূ ধু করে নিরবধি অন্ধ ঝটিকায়—
সরসী নির্ঝর, নদী, কিছু নাহি তায়।
তা হ’লে বুঝিতে তুমি, কেন ত্যজি বাসভূমি,
নিত্য আসি কাঁদি বসি তোমার তলায়;
ত্যজে নর, ধরি কেন তোমার গলায়।
৪
তুমি তরু নিরন্তর, আনন্দে অবনী পর,
বিরাজ বন্ধুর মাঝে, স্বজন সোহাগে;
তরুবর, কেহ নাহি তোমারে বিরাগে।
ধরণী করান পান, সুরস সুধা সমান,
দিবানিশি বার মাস সম অনুরাগে,—
পবন তোমার তরে যামিনীতে জাগে।
স্রোতোধারা ধরি পায়, কুলু কুলু করি ধায়,
আপনি বরষা নীর ডালে শিরোভাগে;—
তরু রে বসন্ত তোর স্নেহ করে আগে।
৫
কলকণ্ঠ মধুমাসে, তোমারি নিকটে আসে,
শুনাতে আনন্দে বসে কুহু কুহু রব;
তরুবর, তোমার কি সুখের বিভব।
তলদেশে মখমল, তৃণ করে ঢল ঢল,
পতঙ্গ তাহাতে সুখে কেলি করে সব,
কতই সুখেতে তরু, শুন ঝিল্লীরব!
আসি সুখেপাঁতি পাঁতি, ছড়ায়ে বিমল ভাতি,
খদ্যোত যখন তব সাজায় পল্লব—
কি আনন্দ তরু তোর হয় অনুভব!
৬
তরু রে আমার মন, তাপদগ্ধ অনুক্ষণ,
কেহ নাই শোকানলে ঢালে বারিধারা;
আমি, তরু, জগতের স্নেহ, সুখ হারা!
জায়া, বন্ধু, পরিবার, সকলি আছে আমার,
তবু এ সংসার যেন বিষতুল্য কারা;—
মনে ভাল, কেহ মোরে, বাসে না তাহারা!
এ দোষ কাহারো নয়, আমিই কলঙ্কময়,
আমারি অন্তর হয়, কঙ্কালেতে ভরা—
আমি, তরু, বড় পাপী, তাই ঠেলে তারা।
৭
বড় দুঃখী তরু আমি, জানেন অন্তরষামী,
তোমার তলায় আসি ভাসি অশ্রুনীরে,
দেখিয়া জীবের সুখ ভবের মন্দিরে।
এই ভিন্ন সুখ নাই, তরু তাই ভিক্ষা চাই,
পাই যেন এই রূপে কাঁদিতে গম্ভীরে,
যত দিন নাহি যাই বৈতরণী তীরে।
এক ভিক্ষা আছে আর, অন্য যদি কেহ আর,
আমার মতন দুঃখী আসে এই স্থানে,
তরু, তারে দয়া করে তুষিও পরাণে।
ইন্দ্রের সুধাপান
১
একদিন দেব দেবপুরন্দর,
বামে শচীসতী নন্দন ভিতর,
বলিল গন্ধৰ্ব্ব সখারে ডাকি;–
যাও চিত্ররথ, সুধাভাণ্ড ভরি
আন ত্বরা করি পীযূষ লহরী,
আন বাদিত্রবাদকে ডাকি।
আন বাদিত্র সুধাতরঙ্গে,
যত দেবগণ বলিল রঙ্গে,
অমর মাতিল সুরেশ সঙ্গে।
২
সুবৰ্ণ মঞ্চেতে সুর আখণ্ডল,
চারিদিকে যত অমরের দল,
বিজলীর মত করে ঝলমল,
শোভে পারিজাত হার গ্রীবাতে;
বামে দৈত্যবালা রূপে করে আল,
কোথা যে চঞ্চল তড়িত উজ্জ্বল,
কোথা বা উমার রূপ নিরমল?
পলকে পারে সে জগতে ভুলাতে।
আহা মরি মরি কিবা ভাগ্যধর,
যার কোলে হেন নারী মনোহর,
কত সুখ তার হয় রে।
বীর বিনা আহা রমণীরতন,
বীর বই আর রমণীরতন,
বীর বিনা আহা রমণীরতন,
কারে আর শোভা পায় রে!
(চিতেন[১])
আহা মরি মরি কিবা ভাগ্যধর,
গাহিল যতেক কিন্নরী কিন্নর,
কত সুখ তার হয় রে;
বীর বিনা আহা রমণীরতন,
বীর বই আর রমণীরতন,
বীর বিনা আহা রমণীরতন
কারে আর শোভা পায় রে।
৩
এলো চিত্ররথ মনোরথ গতি,
স্বর্ণপাত্রে সুধা, সঙ্গে বিদ্যারথী,[২]
উঠিল সুরব “জয় শচীপতি”
অমর মণ্ডলী মাঝেতে;
দেব পুরন্দর দেবদল সহ,
সুধা, সোমরস পিয়ে মুহমুহ,
গন্ধে আমোদিত মারুত প্রবাহ,
গগন কাঁপিল বেগেতে—
বায়ু মাতোয়ারা, রবি, শশী, তারা,
অরুণ, বরুণ, দিক্পাল যারা,
সবে মাতোয়ারা সুধা পানেতে।
হ’লো ভয়ঙ্কর কাঁপে চরাচর
আকাশ, পাতাল, মহী, মহীধর,
জলধি হুঙ্কারে বেগেতে।
( চিতেন )
বায়ু মাতোয়ারা রবি, শশী, তারা,
অরুণ, বরুণ, দিক্পাল যারা,
সবে মাতোয়ারা সুধা পানেতে।
৪
বসিয়ে উন্নত আসন উপরে,
গুণী বিশ্বাবসু বীণা নিল করে,
মেঘের গরজে গভীর ঝঙ্কারে,
মোহিত করিল অমরগণে;
দেবাসুর রণ গাহিতে লাগিল,
কিরূপে অসুরে অমরে নাশিল,
কিরূপে ইন্দ্র দেবরাজ হ’লো,
শুনাইল বীণা বাজায়ে ঘনে।
“পুলোমদুহিতা তোমারি গৃহীতা,
ওহে দেবরাজ তুমিই দেবতা;
রণে পরাজয় করি বাহুবলে,
এ অমরপুরী নিলে করতলে,
সমুদ্র মথিয়া অমৃত লভিলে,—
অহে দেব তব অসাধ্য ক্ষমতা।”
হ’লে প্রতিধ্বনি—“পুলোমদুহিতা,
অহে দেবরাজ তোমারি গৃহীতা;”—
ঘন ঘন ঘোর সুগভীর স্বরে,
কাননে, বিপিনে, নদী, সরোবরে,
উঠিল নিনাদি যতেক দেবতা।
ভাবে গদ গদ মুদিত নয়ন,
উঠিয়া গরজি গরজি সঘন
ছাড়িল হুঙ্কার দনুজঘাতা।