ছেলেরে ডাকিয়া চুপি কহিলেন, ‘ওরে গুপি,
তোর জামা দে তুই মধুকে। ‘
গুপির সে জামা পেয়ে মধু ঘরে যায় ধেয়ে
হাসি আর নাহি ধরে মুখে।
বুক ফুলাইয়া চলে— সবারে ডাকিয়া বলে,
‘দেখো কাকা! দেখো চেয়ে মামা!
ওই আমাদের বিধু ছিট পরিয়াছে শুধু,
মোর গায়ে সাটিনের জামা। ‘
মা শুনি কহেন আসি লাজে অশ্রুজলে ভাসি
কপালে করিয়া করাঘাত,
‘হই দুঃখী হই দীন কাহারো রাখি না ঋণ,
কারো কাছে পাতি নাই হাত।
তুমি আমাদেরই ছেলে ভিক্ষা লয়ে অবহেলে
অহংকার কর ধেয়ে ধেয়ে!
ছেঁড়া ধুতি আপনার ঢের বেশি দাম তার
ভিক্ষা-করা সাটিনের চেয়ে।
আয় বিধু, আয় বুকে, চুমো খাই চাঁদমুখে,
তোর সাজ সব চেয়ে ভালো।
দরিদ্র ছেলের দেহে দরিদ্র বাপের স্নেহে
ছিটের জামাটি করে আলো।
প্রশ্ন
মা গো, আমায় ছুটি দিতে বল্,
সকাল থেকে পড়েছি যে মেলা।
এখন আমি তোমার ঘরে বসে
করব শুধু পড়া-পড়া খেলা।
তুমি বলছ দুপুর এখন সবে,
নাহয় যেন সত্যি হল তাই,
একদিনও কি দুপুরবেলা হলে
বিকেল হল মনে করতে নাই?
আমি তো বেশ ভাবতে পারি মনে
সুয্যি ডুবে গেছে মাঠের শেষে,
বাগ্দি-বুড়ি চুবড়ি ভরে নিয়ে
শাক তুলেছে পুকুর-ধারে এসে।
আঁধার হল মাদার-গাছের তলা,
কালি হয়ে এল দিঘির জল,
হাটের থেকে সবাই এল ফিরে,
মাঠের থেকে এল চাষির দল।
মনে কর্-না উঠল সাঁঝের তারা,
মনে কর্-না সন্ধে হল যেন।
রাতের বেলা দুপুর যদি হয়
দুপুর বেলা রাত হবে না কেন।
ফুলের ইতিহাস
বসন্তপ্রভাতে এক মালতীর ফুল
প্রথম মেলিল আঁখি তার,
প্রথম হেরিল চারি ধার।
মধুকর গান গেয়ে বলে,
‘মধু কই, মধু দাও দাও। ‘
হরষে হৃদয় ফেটে গিয়ে
ফুল বলে, ‘এই লও লও। ‘
বায়ু আসি কহে কানে কানে,
‘ফুলবালা, পরিমল দাও। ‘
আনন্দে কাঁদিয়া কহে ফুল,
‘যাহা আছে সব লয়ে যাও। ‘
তরুতলে চ্যুতবৃন্ত মালতীর ফুল
মুদিয়া আসিছে আঁখি তার,
চাহিয়া দেখিল চারি ধার।
মধুকর কাছে এসে বলে,
‘মধু কই, মধু চাই চাই। ‘
ধীরে ধীরে নিশ্বাস ফেলিয়া
ফুল বলে, ‘কিছু নাই নাই। ‘
‘ফুলবালা, পরিমল দাও’
বায়ু আসি কহিতেছে কাছে।
মলিন বদন ফিরাইয়া
ফুল বলে, ‘আর কী বা আছে।
বনবাস
বাবা যদি রামের মতো
পাঠায় আমায় বনে
যেতে আমি পারি নে কি
তুমি ভাবছ মনে?
চোদ্দ বছর ক’ দিনে হয়
জানি নে মা ঠিক,
দণ্ডক বন আছে কোথায়
ওই মাঠে কোন্ দিক।
কিন্তু আমি পারি যেতে,
ভয় করি নে তাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
বনের মধ্যে গাছের ছায়ায়
বেঁধে নিতেম ঘর—
সামনে দিয়ে বইত নদী,
পড়ত বালির চর।
ছোটো একটি থাকত ডিঙি
পারে যেতেম বেয়ে—
হরিণ চ’রে বেড়ায় সেথা,
কাছে আসত ধেয়ে।
গাছের পাতা খাইয়ে দিতেম
আমি নিজের হাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
কত যে গাছ ছেয়ে থাকত
কত রকম ফুলে,
মালা গেঁথে পরে নিতেম
জড়িয়ে মাথার চুলে।
নানা রঙের ফলগুলি সব
ভুঁয়ে পড়ত পেকে,
ঝুড়ি ভরে ভরে এনে
ঘরে দিতেম রেখে;
খিদে পেলে দুই ভায়েতে
খেতেম পদ্মপাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
রোদের বেলায় অশথ – তলায়
ঘাসের ‘পরে আসি
রাখাল – ছেলের মতো কেবল
বাজাই বসে বাঁশি।
ডালের ‘পরে ময়ূর থাকে,
পেখম পড়ে ঝুলে—
কাঠবিড়ালি ছুটে বেড়ায়
ন্যাজটি পিঠে তুলে।
কখন আমি ঘুমিয়ে যেতেম
দুপুরবেলার তাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
সন্ধেবেলায় কুড়িয়ে আনি
শুকোনো ডালপালা,
বনের ধারে বসে থাকি
আগুন হলে জ্বালা।
পাখিরা সব বাসায় ফেরে,
দূরে শেয়াল ডাকে,
সন্ধেতারা দেখা যে যায়
ডালের ফাঁকে ফাঁকে।
মায়ের কথা মনে করি
বসে আঁধার রাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
ঠাকুরদাদার মতো বনে
আছেন ঋষি মুনি,
তাঁদের পায়ে প্রণাম করে
গল্প অনেক শুনি।
রাক্ষসেরে ভয় করি নে,
আছে গুহক মিতা—
রাবণ আমার কী করবে মা,
নেই তো আমার সীতা।
হনুমানকে যত্ন করে
খাওয়াই দুধে – ভাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
মা গো, আমায় দে – না কেন
একটি ছোটো ভাই—
দুইজনেতে মিলে আমরা
বনে চলে যাই।
আমাকে মা, শিখিয়ে দিবি
রাম – যাত্রার গান,
মাথায় বেঁধে দিবি চুড়ো,
হাতে ধনুক – বাণ।
চিত্রকূটের পাহাড়ে যাই
এম্নি বরষাতে—
লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার
থাকত সাথে সাথে।
বিচার
আমার খোকার কত যে দোষ
সে-সব আমি জানি,
লোকের কাছে মানি বা নাই মানি।
দুষ্টামি তার পারি কিম্বা
নারি থামাতে,
ভালোমন্দ বোঝাপড়া
তাতে আমাতে।
বাহির হতে তুমি তারে
যেমনি কর দুষী
যত তোমার খুশি,
সে বিচারে আমার কী বা হয়।
খোকা বলেই ভালোবাসি,
ভালো বলেই নয়।
খোকা আমার কতখানি
সে কি তোমরা বোঝ।
তোমরা শুধু দোষ গুণ তার খোঁজ।
আমি তারে শাসন করি
বুকেতে বেঁধে ,
আমি তারে কাঁদাই যে গো
আপনি কেঁদে।
বিচার করি, শাসন করি,
করি তারে দুষী
আমার যাহা খুশি।
তোমার শাসন আমরা মানি নে গো।
শাসন করা তারেই সাজে
সোহাগ করে যে গো।
বিচিত্র সাধ
আমি যখন পাঠশালাতে যাই
আমাদের এই বাড়ির গলি দিয়ে,
দশটা বেলায় রোজ দেখতে পাই
ফেরিওলা যাচ্ছে ফেরি নিয়ে।
‘চুড়ি চা— ই, চুড়ি চাই’ সে হাঁকে,
চীনের পুতুল ঝুড়িতে তার থাকে,
যায় সে চলে যে পথে তার খুশি,
যখন খুশি খায় সে বাড়ি গিয়ে।
দশটা বাজে, সাড়ে দশটা বাজে,
নাইকো তাড়া হয় বা পাছে দেরি।
ইচ্ছে করে সেলেট ফেলে দিয়ে
অম্নি করে বেড়াই নিয়ে ফেরি।
আমি যখন হাতে মেখে কালি
ঘরে ফিরি, সাড়ে চারটে বাজে,
কোদাল নিয়ে মাটি কোপায় মালী
বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মাঝে।
কেউ তো তারে মানা নাহি করে
কোদাল পাছে পড়ে পায়ের ‘পরে।
গায়ে মাথায় লাগছে কত ধুলো,
কেউ তো এসে বকে না তার কাজে।
মা তারে তো পরায় না সাফ জামা,
ধুয়ে দিতে চায় না ধুলোবালি।
ইচ্ছে করে আমি হতেম যদি
বাবুদের ওই ফুল-বাগানের মালী।