মা দেখিল চেয়ে, কহিল হাসিয়ে,
‘কিবা জিনিসের ছিরি!’
ভূমিতে ফেলিয়া গেল সে চলিয়া,
আর না চাহিল ফিরি।
মেয়েটির মুখে কথা না ফুটিল,
মাটিতে রহিল বসি।
শূন্য হতে যেন পাখির পালক
ভূতলে পড়িল খসি।
খেলাধুলো তার হল নাকো আর,
হাসি মিলাইল মুখে,
ধীরে ধীরে শেষে দুটি ফোঁটা জল
দেখা দিল দুটি চোখে।
পালকটি লয়ে রাখিল লুকায়ে
গোপনের ধন তার—
আপনি খেলিত, আপনি তুলিত,
দেখাত না কারে আর।
পুরোনো বট
লুটিয়ে পড়ে জটিল জটা,
ঘন পাতার গহন ঘটা,
হেথা হোথায় রবির ছটা,
পুকুর-ধারে বট।
দশ দিকেতে ছড়িয়ে শাখা
কঠিন বাহু আঁকাবাঁকা
স্তব্ধ যেন আছে আঁকা,
শিরে আকাশ-পট।
নেবে নেবে গেছে জলে
শিকড়গুলো দলে দলে,
সাপের মতো রসাতলে
আলয় খুঁজে মরে।
শতেক শাখা-বাহু তুলি
বায়ুর সাথে কোলাকুলি,
আনন্দেতে দোলাদুলি
গভীর প্রেমভরে।
ঝড়ের তালে নড়ে মাথা,
কাঁপে লক্ষকোটি পাতা,
আপন-মনে গায় সে গাথা,
দুলায় মহাকায়া।
তড়িৎ পাশে উঠে হেসে,
ঝড়ের মেঘ ঝটিৎ এসে
দাঁড়িয়ে থাকে এলোকেশে,
তলে গভীর ছায়া।
নিশিদিশি দাঁড়িয়ে আছ
মাথার লয়ে জট,
ছোটো ছেলেটি মনে কি পড়ে
ওগো প্রাচীন বট!
কতই পাখি তোমার শাখে
বসে যে চলে গেছে,
ছোটো ছেলেরে তাদেরই মতো
ভুলে কি যেতে আছে?
তোমার মাঝে হৃদয় তারি
বেঁধেছিল যে নীড়।
ডালেপালায় সাধগুলি তার
কত করেছে ভিড়।
মনে কি নেই সারাটা দিন
বসিয়ে বাতায়নে,
তোমার পানে রইত চেয়ে
অবাক দুনয়নে?
ভাঙা ঘাটে নাইত কারা,
তুলত কারা জল,
পুকুরেতে ছায়া তোমার
করত টলমল।
জলের উপর রোদ পড়েছে
সোনা-মাখা মায়া,
ভেসে বেড়ায় দুটি হাঁস
দুটি হাঁসের ছায়া।
ছোটো ছেলে রইত চেয়ে,
বাসনা অগাধ—
মনের মধ্যে খেলাত তার
কত খেলার সাধ।
বায়ুর মতো খেলত যদি
তোমার চারি ভিতে,
ছায়ার মতো শুত যদি
তোমার ছায়াটিতে,
পাখির মতো উড়ে যেত
উড়ে আসত ফিরে,
হাঁসের মতো ভেসে যেত
তোমার তীরে তীরে।
মনে হত, তোমার ছায়ে
কতই যে কী আছে,
কাদের যেন ঘুম পাড়াতে
ঘুঘু ডাকত গাছে।
মনে হত, তোমার মাঝে
কাদের যেন ঘর।
আমি যদি তাদের হতেম!
কেন হলেম পর।
ছায়ার মতো ছায়ায় তারা
থাকে পাতার ‘পরে,
গুন্গুনিয়ে সবাই মিলে
কতই যে গান করে।
দূর লাগে মূলতানে তান,
পড়ে আসে বেলা,
ঘাটে বসে দেখে জলে
আলোছায়ার খেলা।
সন্ধে হলে খোঁপা বাঁধে
তাদের মেয়েগুলি,
ছেলেরা সব দোলায় বসে
খেলায় দুলি দুলি।
তোমার পানে রইত চেয়ে
অবাক দুনয়নে?
তোমার তলে মধুর ছায়া
তোমার তলে ছুটি,
তোমার তলে নাচত বসে
শালিখ পাখি দুটি।
গহিন রাতে দখিন বাতে
নিঝুম চারি ভিত,
চাঁদের আলোয় শুভ্র তনু,
ঝিমি ঝিমি গীত।
ওখানেতে পাঠশালা নেই,
পণ্ডিতমশাই—
বেত হাতে নাইকো বসে
মাধব গোসাঁই।
সারাটা দিন ছুটি কেবল,
সারাটা দিন খেলা—
পুকুর-ধারে আঁধার-করা
বটগাছের তলা।
আজকে কেন নাইকো তারা।
আছে আর-সকলে,
তারা তাদের বাসা ভেঙে
কোথায় গেছে চলে।
ছায়ার মধ্যে মায়া ছিল
ভেঙে দিল কে।
ছায়া কেবল রইল প’ড়ে,
কোথায় গেল সে।
ডালে বসে পাখিরা আজ
কোন্ প্রাণেতে ডাকে।
রবির আলো কাদের খোঁজে
পাতার ফাঁকে ফাঁকে।
গল্প কত ছিল যেন
তোমার খোপে-খাপে,
পাখির সঙ্গে মিলে-মিশে
ছিল চুপে-চাপে,
দুপুর বেলা নূপুর তাদের
বাজত অনুক্ষণ,
ছোটো দুটি ভাই-ভগিনীর
আকুল হত মন।
ছেলেবেলায় ছিল তারা,
কোথায় গেল শেষে।
গেছে বুঝি ঘুম-পাড়ানি
মাসিপিসির দেশে।
পূজার সাজ
আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি,
পূজার সময় এল কাছে।
মধু বিধু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই,
আনন্দে দু-হাত তুলি নাচে।
পিতা বসি ছিল দ্বারে, দুজনে শুধালো তারে,
‘কী পোশাক আনিয়াছ কিনে। ‘
পিতা কহে, ‘আছে আছে তোদের মায়ের কাছে,
দেখিতে পাইবি ঠিক দিনে। ‘
সবুর সহে না আর— জননীরে বার বার
কহে, ‘মা গো, ধরি তোর পায়ে,
বাবা আমাদের তরে কী কিনে এনেছে ঘরে
একবার দে না মা, দেখায়ে। ‘
ব্যস্ত দেখি হাসিয়া মা দুখানি ছিটের জামা
দেখাইল করিয়া আদর।
মধু কহে, ‘আর নেই?’ মা কহিল, ‘আছে এই
একজোড়া ধুতি ও চাদর। ‘
রাগিয়া আগুন ছেলে, কাপড় ধুলায় ফেলে
কাঁদিয়া কহিল, ‘চাহি না মা,
রায়বাবুদের গুপি পেয়েছে জরির টুপি,
ফুলকাটা সাটিনের জামা। ‘
মা কহিল, ‘মধু, ছি ছি, কেন কাঁদ মিছামিছি,
গরিব যে তোমাদের বাপ।
এবার হয় নি ধান, কত গেছে লোকসান,
পেয়েছেন কত দুঃখতাপ।
তবু দেখো বহু ক্লেশে তোমাদের ভালোবেসে
সাধ্যমত এনেছেন কিনে।
সে জিনিস অনাদরে ফেলিলি ধূলির ‘পরে—
এই শিক্ষা হল এতদিনে। ‘
বিধু বলে, ‘এ কাপড় পছন্দ হয়েছে মোর,
এই জামা পরাস আমারে। ‘
মধু শুনে আরো রেগে ঘর ছেড়ে দ্রুতবেগে
গেল রায়বাবুদের দ্বারে।
সেথা মেলা লোক জড়ো, রায়বাবু ব্যস্ত বড়ো;
দালান সাজাতে গেছে রাত।
মধু যবে এক কোণে দাঁড়াইল ম্লান মনে
চোখে তাঁর পড়িল হঠাৎ।
কাছে ডাকি স্নেহভরে কহেন করুণ স্বরে
তারে দুই বাহুতে বাঁধিয়া,
‘কী রে মধু, হয়েছে কী। তোরে যে শুক্নো দেখি। ‘
শুনি মধু উঠিল কাঁদিয়া,
কহিল, ‘আমার তরে বাবা আনিয়াছে ঘরে
শুধু এক ছিটের কাপড়। ‘
শুনি রায়মহাশয় হাসিয়া মধুরে কয়,
‘সেজন্য ভাবনা কিবা তোর। ‘