দুঃখহারী
মনে করো, তুমি থাকবে ঘরে,
আমি যেন যাব দেশান্তরে।
ঘাটে আমার বাঁধা আছে তরী,
জিনিসপত্র নিয়েছি সব ভরি—
ভালো করে দেখ্ তো মনে করি
কী এনে মা, দেব তোমার তরে।
চাস কি মা, তুই এত এত সোনা—
সোনার দেশে করব আনাগোনা।
সোনামতী নদীতীরের কাছে
সোনার ফসল মাঠে ফ’লে আছে,
সোনার চাঁপা ফোটে সেথায় গাছে—
না কুড়িয়ে আমি তো ফিরব না।
পরতে কি চাস মুক্তো গেঁথে হারে —
জাহাজ বেয়ে যাব সাগর-পারে।
সেখানে মা, সকালবেলা হলে
ফুলের ‘পরে মুক্তোগুলি দোলে,
টুপটুপিয়ে পড়ে ঘাসের কোলে—
যত পারি আনব ভারে ভারে।
দাদার জন্যে আনব মেঘে – ওড়া
পক্ষিরাজের বাচ্ছা দুটি ঘোড়া।
বাবার জন্যে আনব আমি তুলি
কনক-লতার চারা অনেকগুলি—
তোর তরে মা, দেব কৌটা খুলি
সাত-রাজার – ধন মানিক একটি জোড়া।
নবীন অতিথি
গান
ওহে নবীন অতিথি,
তুমি নূতন কি তুমি চিরন্তন।
যুগে যুগে কোথা তুমি ছিলে সংগোপন।
যতনে কত কী আনি বেঁধেছিনু গৃহখানি,
হেথা কে তোমারে বলো করেছিল নিমন্ত্রণ।
কত আশা ভালোবাসা গভীর হৃদয়তলে
ঢেকে রেখেছিনু বুকে, কত হাসি অশ্রুজলে!
একটি না কহি বাণী তুমি এলে মহারানী,
কেমনে গোপনে মনে করিলে হে পদার্পণ।
নির্লিপ্ত
বাছা রে মোর বাছা,
ধূলির ‘পরে হরষভরে
লইয়া তৃণগাছা
আপন মনে খেলিছ কোণে,
কাটিছে সারা বেলা।
হাসি গো দেখে এ ধূলি মেখে
এ তৃণ লয়ে খেলা।
আমি যে কাজে রত,
লইয়া খাতা ঘুরাই মাথা
হিসাব কষি কত,
আঁকের সারি হতেছে ভারী
কাটিয়া যায় বেলা—
ভাবিছ দেখি মিথ্যা একি
সময় নিয়ে খেলা।
বাছা রে মোর বাছা,
খেলিতে ধূলি গিয়েছি ভুলি
লইয়ে তৃণগাছা।
কোথায় গেলে খেলেনা মেলে
ভাবিয়া কাটে বেলা,
বেড়াই খুঁজি করিতে পুঁজি
সোনারূপার ঢেলা।
যা পাও চারি দিকে
তাহাই ধরি তুলিছ গড়ি
মনের সুখটিকে।
না পাই যারে চাহিয়া তারে
আমার কাটে বেলা,
আশাতীতেরই আশায় ফিরি
ভাসাই মোর ভেলা।
নৌকাযাত্রা
মধু মাঝির ওই যে নৌকোখানা
বাঁধা আছে রাজগঞ্জের ঘাটে ,
কারো কোনো কাজে লাগছে না তো ,
বোঝাই করা আছে কেবল পাটে ।
আমায় যদি দেয় তারা নৌকাটি
আমি তবে একশোটা দাঁড় আঁটি ,
পাল তুলে দিই চারটে পাঁচটা ছটা —
মিথ্যে ঘুরে বেড়াই নাকো হাটে ।
আমি কেবল যাই একটিবার
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার ।
তখন তুমি কেঁদো না মা , যেন
বসে বসে একলা ঘরের কোণে —
আমি তো মা , যাচ্ছি নেকো চলে
রামের মতো চোদ্দ বছর বনে ।
আমি যাব রাজপুত্রু হয়ে
নৌকো – ভরা সোনামানিক বয়ে ,
আশুকে আর শ্যামকে নেব সাথে ,
আমরা শুধু যাব মা তিন জনে ।
আমি কেবল যাব একটিবার
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার ।
ভোরের বেলা দেব নৌকো ছেড়ে ,
দেখতে দেখতে কোথায় যাব ভেসে ।
দুপুরবেলা তুমি পুকুর – ঘাটে ,
আমরা তখন নতুন রাজার দেশে ।
পেরিয়ে যাব তির্পুর্নির ঘাট ,
পেরিয়ে যাব তেপান্তরের মাঠ ,
ফিরে আসতে সন্ধে হয়ে যাবে ,
গল্প বলব তোমার কোলে এসে ।
আমি কেবল যাব একটিবার
সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার ।
পরিচয়
একটি মেয়ে আছে জানি,
পল্লীটি তার দখলে,
সবাই তারি পুজো জোগায়
লক্ষ্মী বলে সকলে।
আমি কিন্তু বলি তোমায়
কথায় যদি মন দেহ—
খুব যে উনি লক্ষ্মী মেয়ে
আছে আমার সন্দেহ।
ভোরের বেলা আঁধার থাকে,
ঘুম যে কোথা ছোটে ওর—
বিছানাতে হুলুস্থুলু
কলরবের চোটে ওর।
খিল্খিলিয়ে হাসে শুধু
পাড়াসুদ্ধ জাগিয়ে,
আড়ি করে পালাতে যায়
মায়ের কোলে না গিয়ে।
হাত বাড়িয়ে মুখে সে চায়,
আমি তখন নাচারই,
কাঁধের ‘পরে তুলে তারে
করে বেড়াই পাচারি।
মনের মতো বাহন পেয়ে
ভারি মনের খুশিতে
মারে আমায় মোটা মোটা
নরম নরম ঘুষিতে।
আমি ব্যস্ত হয়ে বলি—
‘একটু রোসো রোসো মা। ‘
মুঠো করে ধরতে আসে
আমার চোখের চশমা।
আমার সঙ্গে কলভাষায়
করে কতই কলহ।
তুমুল কাণ্ড! তোমরা তারে
শিষ্ট আচার বলহ?
তবু তো তার সঙ্গে আমার
বিবাদ করা সাজে না।
সে নইলে যে তেমন করে
ঘরের বাঁশি বাজে না।
সে না হলে সকালবেলায়
এত কুসুম ফুটবে কি।
সে না হলে সন্ধেবেলায়
সন্ধেতারা উঠবে কি।
একটি দণ্ড ঘরে আমার
না যদি রয় দুরন্ত
কোনোমতে হয় না তবে
বুকের শূন্য পূরণ তো।
দুষ্টুমি তার দখিন-হাওয়া
সুখের তুফান-জাগানে
দোলা দিয়ে যায় গো আমার
হৃদয়ের ফুল-বাগানে।
নাম যদি তার জিজ্ঞেস কর
সেই আছে এক ভাবনা,
কোন্ নামে যে দিই পরিচয়
সে তো ভেবেই পাব না।
নামের খবর কে রাখে ওর,
ডাকি ওরে যা-খুশি—
দুষ্টু বল, দস্যি বল,
পোড়ারমুখী, রাক্ষুসি।
বাপ-মায়ে যে নাম দিয়েছে
বাপ-মায়েরই থাক্ সে নয়।
ছিষ্টি খুঁজে মিষ্টি নামটি
তুলে রাখুন বাক্সে নয়।
একজনেতে নাম রাখবে
কখন অন্নপ্রাশনে,
বিশ্বসুদ্ধ সে নাম নেবে—
ভারি বিষম শাসন এ।
নিজের মনের মতো সবাই
করুন কেন নামকরণ—
বাবা ডাকুন চন্দ্রকুমার,
খুড়ো ডাকুন রামচরণ।
ঘরের মেয়ে তার কি সাজে
সঙস্কৃত নামটা ওই।
এতে কারো দাম বাড়ে না
অভিধানের দামটা বৈ।
আমি বাপু, ডেকেই বসি
যেটাই মুখে আসুক-না—
যারে ডাকি সেই তা বোঝে,
আর সকলে হাসুক-না—
একটি ছোটো মানুষ তাহার
একশো রকম রঙ্গ তো।
এমন লোককে একটি নামেই
ডাকা কি হয় সংগত।
পাখির পালক
খেলাধুলো সব রহিল পড়িয়া,
ছুটে চ ‘ লে আসে মেয়ে—
বলে তাড়াতাড়ি, ‘ওমা, দেখ্ দেখ্,
কী এনেছি দেখ্ চেয়ে। ‘
আঁখির পাতায় হাসি চমকায়,
ঠোঁটে নেচে ওঠে হাসি—
হয়ে যায় ভুল, বাঁধে নাকো চুল,
খুলে পড়ে কেশরাশি।
দুটি হাত তার ঘিরিয়া ঘিরিয়া
রাঙা চুড়ি কয়গাছি,
করতালি পেয়ে বেজে ওঠে তারা;
কেঁপে ওঠে তারা নাচি।
মায়ের গলায় বাহু দুটি বেঁধে
কোলে এসে বসে মেয়ে।
বলে তাড়াতাড়ি, ‘ওমা, দেখ্ দেখ্,
কী এনেছি দেখ্ চেয়ে। ‘
সোনালি রঙের পাখির পালক
ধোওয়া সে সোনার স্রোতে—
খসে এল যেন তরুণ আলোক
অরুণের পাখা হতে।
নয়ন-ঢুলানো কোমল পরশ
ঘুমের পরশ যথা—
মাখা যেন তায় মেঘের কাহিনী,
নীল আকাশের কথা।
ছোটোখাটো নীড়, শাবকের ভিড়,
কতমত কলরব,
প্রভাতের সুখ, উড়িবার আশা—
মনে পড়ে যেন সব।
লয়ে সে পালক কপোলে বুলায়,
আঁখিতে বুলায় মেয়ে,
বলে হেসে হেসে, ‘ওমা, দেখ্ দেখ্,
কী এনেছি দেখ্ চেয়ে। ‘