কোন্ সাগরের তীরে মা গো,
কোন্ পাহাড়ের পারে,
কোন্ রাজাদের দেশে মা গো,
কোন্ নদীটির ধারে।
কোনোখানে আল বাঁধা তার
নাই ডাইনে বাঁয়ে?
পথ দিয়ে তার সন্ধেবেলায়
পৌঁছে না কেউ গাঁয়ে?
সারা দিন কি ধূ ধূ করে
শুকনো ঘাসের জমি?
একটি গাছে থাকে শুধু
ব্যাঙ্গমা – বেঙ্গমী?
সেখান দিয়ে কাঠকুড়ুনি
যায় না নিয়ে কাঠ?
বল্ গো আমায় কোথায় আছে
তেপান্তরের মাঠ।
এমনিতরো মেঘ করেছে
সারা আকাশ ব্যেপে,
রাজপুত্তুর যাচ্ছে মাঠে
একলা ঘোড়ায় চেপে।
গজমোতির মালাটি তার
বুকের ‘পরে নাচে—
রাজকন্যা কোথায় আছে
খোঁজ পেলে কার কাছে।
মেঘে যখন ঝিলিক মারে
আকাশের এক কোণে
দুয়োরানী – মায়ের কথা
পড়ে না তার মনে?
দুখিনা মা গোয়াল – ঘরে
দিচ্ছে এখন ঝাঁট,
রাজপুত্তুর চলে যে কোন্
তেপান্তরের মাঠ।
ওই দেখো মা, গাঁয়ের পথে
লোক নেইকো মোটে,
রাখাল – ছেলে সকাল করে
ফিরেছে আজ গোঠে।
আজকে দেখো রাত হয়েছে
দিস না যেতে যেতে,
কৃষাণেরা বসে আছে
দাওয়ায় মাদুর পেতে।
আজকে আমি নুকিয়েছি মা,
পুঁথিপত্তর যত—
পড়ার কথা আজ বোলো না।
যখন বাবার মতো।
বড়ো হব তখন আমি
পড়ব প্রথম পাঠ—
আজ বলো মা, কোথায় আছে
তেপান্তরের মাঠ।
ছোটোবড়ো
এখনো তো বড়ো হই নি আমি,
ছোটো আছি ছেলেমানুষ বলে।
দাদার চেয়ে অনেক মস্ত হব
বড়ো হয়ে বাবার মতো হলে।
দাদা তখন পড়তে যদি না চায়,
পাখির ছানা পোষে কেবল খাঁচায়,
তখন তারে এমনি বকে দেব!
বলব, ‘তুমি চুপটি করে পড়ো। ‘
বলব, ‘তুমি ভারি দুষ্টু ছেলে’—
যখন হব বাবার মতো বড়ো।
তখন নিয়ে দাদার খাঁচাখানা
ভালো ভালো পুষব পাখির ছানা।
সাড়ে দশটা যখন যাবে বেজে
নাবার জন্যে করব না তো তাড়া।
ছাতা একটা ঘাড়ে করে নিয়ে
চটি পায়ে বেড়িয়ে আসব পাড়া।
গুরুমশায় দাওয়ায় এলে পরে
চৌকি এনে দিতে বলব ঘরে,
তিনি যদি বলেন ‘সেলেট কোথা?
দেরি হচ্ছে, বসে পড়া করো’
আমি বলব, ‘খোকা তো আর নেই,
হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো। ‘
গুরুমশায় শুনে তখন কবে,
‘বাবুমশায়, আসি এখন তবে। ‘
খেলা করতে নিয়ে যেতে মাঠে
ভুলু যখন আসবে বিকেল বেলা,
আমি তাকে ধমক দিয়ে কব,
‘ কাজ করছি, গোল কোরো না মেলা। ‘
রথের দিনে খুব যদি ভিড় হয়
একলা যাব, করব না তো ভয়—
মামা যদি বলেন ছুটে এসে
‘ হারিয়ে যাবে, আমার কোলে চড়ো’
বলব আমি, ‘দেখছ না কি মামা,
হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো। ‘
দেখে দেখে মামা বলবে, ‘তাই তো,
খোকা আমার সে খোকা আর নাই তো। ‘
আমি যেদিন প্রথম বড়ো হব
মা সেদিনে গঙ্গাস্নানের পরে
আসবে যখন খিড়কি – দুয়োর দিয়ে
ভাববে ‘কেন গোল শুনি নে ঘরে। ‘
তখন আমি চাবি খুলতে শিখে
যত ইচ্ছে টাকা দিচ্ছি ঝিকে,
মা দেখে তাই বলবে তাড়াতাড়ি,
‘ খোকা, তোমার খেলা কেমনতরো। ‘
আমি বলব, ‘মাইনে দিচ্ছি আমি,
হয়েছি যে বাবার মতো বড়ো।
ফুরোয় যদি টাকা, ফুরোয় খাবার,
যত চাই মা, এনে দেব আবার। ‘
আশ্বিনেতে পুজোর ছুটি হবে,
মেলা বসবে গাজনতলার হাটে,
বাবার নৌকো কত দূরের থেকে
লাগবে এসে বাবুগঞ্জের ঘাটে।
বাবা মনে ভাববে সোজাসুজি,
খোকা তেমনি খোকাই আছে বুঝি,
ছোটো ছোটো রঙিন জামা জুতো
কিনে এনে বলবে আমায় ‘পরো’।
আমি বলব, ‘দাদা পরুক এসে,
আমি এখন তোমার মতো বড়ো।
দেখছ না কি যে ছোটো মাপ জামার—
পরতে গেলে আঁট হবে যে আমার।
জন্মকথা
খোকা মাকে শুধায় ডেকে —
‘ এলেম আমি কোথা থেকে ,
কোন্খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে । ‘
মা শুনে কয় হেসে কেঁদে
খোকারে তার বুকে বেঁধে —
‘ ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে ।
ছিলি আমার পুতুল – খেলায় ,
প্রভাতে শিবপূজার বেলায়
তোরে আমি ভেঙেছি আর গড়েছি ।
তুই আমার ঠাকুরের সনে
ছিলি পূজার সিংহাসনে ,
তাঁরি পূজায় তোমার পূজা করেছি ।
আমার চিরকালের আশায় ,
আমার সকল ভালোবাসায় ,
আমার মায়ের দিদিমায়ের পরানে —
পুরানো এই মোদের ঘরে
গৃহদেবীর কোলের ‘পরে
যে লুকিয়ে ছিলি কে জানে ।
যৌবনেতে যখন হিয়া
উঠেছিল প্রস্ফুটিয়া ,
তুই ছিলি সৌরভের মতো মিলায়ে ,
আমার তরুণ অঙ্গে অঙ্গে
জড়িয়ে ছিলি সঙ্গে সঙ্গে
তোর লাবণ্য কোমলতা বিলায়ে ।
সব দেবতার আদরের ধন
নিত্যকালের তুই পুরাতন ,
তুই প্রভাতের আলোর সমবয়সী —
তুই জগতের স্বপ্ন হতে
এসেছিস আনন্দ – স্রোতে
নূতন হয়ে আমার বুকে বিলসি ।
নির্নিমেষে তোমায় হেরে
তোর রহস্য বুঝি নে রে ,
সবার ছিলি আমার হলি কেমনে ।
ওই দেহে এই দেহ চুমি
মায়ের খোকা হয়ে তুমি
মধুর হেসে দেখা দিলে ভুবনে ।
হারাই হারাই ভয়ে গো তাই
বুকে চেপে রাখতে যে চাই ,
কেঁদে মরি একটু সরে দাঁড়ালে ।
জানি না কোন্ মায়ায় ফেঁদে
বিশ্বের ধন রাখব বেঁধে
আমার এ ক্ষীণ বাহু দুটির আড়ালে ।
জ্যোতিষ-শাস্ত্র
আমি শুধু বলেছিলেম—
‘কদম গাছের ডালে
পূর্ণিমা-চাঁদ আটকা পড়ে
যখন সন্ধেকালে
তখন কি কেউ তারে
ধরে আনতে পারে। ‘
শুনে দাদা হেসে কেন
বললে আমায়, ‘ খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাইকো বোকা।
চাঁদ যে থাকে অনেক দূরে
কেমন করে ছুঁই;
আমি বলি, ‘দাদা, তুমি
জান না কিচ্ছুই।
মা আমাদের হাসে যখন
ওই জানলার ফাঁকে
তখন তুমি বলবে কি, মা
অনেক দূরে থাকে। ‘
তবু দাদা বলে আমায়, ‘খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা। ‘
দাদা বলে, ‘পাবি কোথায়
অত বড়ো ফাঁদ। ‘
আমি বলি, ‘কেন দাদা,
ওই তো ছোটো চাঁদ,
দুটি মুঠোয় ওরে
আনতে পারি ধরে। ‘
শুনে দাদা হেসে কেন
বললে আমায়, ‘খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা।
চাঁদ যদি এই কাছে আসত
দেখতে কত বড়ো। ‘
আমি বলি, ‘কী তুমি ছাই
ইস্কুলে যে পড়।
মা আমাদের চুমো খেতে
মাথা করে নিচু,
তখন কি আর মুখটি দেখায়
মস্ত বড়ো কিছু। ‘
তবু দাদা বলে আমায়, ‘খোকা,
তোর মতো আর দেখি নাই তো বোকা।