কিছু দিয়ে-থুয়ে চিরদিন-তরে
কিনে রেখে দেব মন তোর—
এমন আমার মন্ত্রণা নেই,
জানি নে ও হেন মন্তর।
নবীন জীবন, বহুদূর পথ
পড়ে আছে তোর সুমুখে;
স্নেহরস মোরা যেটুকু যা দিই
পিয়ে নিস এক চুমুকে।
সাথিদলে জুটে চলে যাস ছুটে
নব আশে নব পিয়াসে,
যদি ভুলে যাস, সময় না পাস,
কী যায় তাহাতে কী আসে।
মনে রাখিবার চির-অবকাশ
থাকে আমাদেরই বয়সে,
বাহিরেতে যার না পাই নাগাল
অন্তরে জেগে রয় সে।
পাষাণের বাধা ঠেলেঠুলে নদী
আপনার মনে সিধে সে
কলগান গেয়ে দুই তীর বেয়ে
যায় চলে দেশ-বিদেশে—
যার কোল হতে ঝরনার স্রোতে
এসেছে আদরে গলিয়া
তারে ছেড়ে দূরে যায় দিনে দিনে
অজানা সাগরে চলিয়া।
অচল শিখর ছোটো নদীটিরে
চিরদিন রাখে স্মরণে—
যতদূর যায় স্নেহধারা তার
সাথে যায় দ্রুতচরণে।
তেমনি তুমিও থাক না’ই থাক,
মনে কর মনে কর না,
পিছে পিছে তব চলিবে ঝরিয়া
আমার আশিস-ঝরনা।।
কাগজের নৌকা
ছুটি হলে রোজ ভাসাই জলে
কাগজ-নৌকাখানি।
লিখে রাখি তাতে আপনার নাম
লিখি আমাদের বাড়ি কোন্ গ্রাম
বড়ো বড়ো করে মোটা অক্ষরে,
যতনে লাইন টানি।
যদি সে নৌকা আর-কোনো দেশে
আর-কারো হাতে পড়ে গিয়ে শেষে
আমার লিখন পড়িয়া তখন
বুঝিবে সে অনুমানি
কার কাছ হতে ভেসে এল স্রোতে
কাগজ-নৌকাখানি।
আমার নৌকা সাজাই যতনে
শিউলি বকুলে ভরি।
বাড়ির বাগানে গাছের তলায়
ছেয়ে থাকে ফুল সকালবেলায়,
শিশিরের জল করে ঝলমল
প্রভাতের আলো পড়ি।
সেই কুসুমের অতি ছোটো বোঝা
কোন্ দিক-পানে চলে যায় সোজা,
বেলাশেষে যদি পার হয়ে নদী
ঠেকে কোনোখানে যেয়ে—
প্রভাতের ফুল সাঁঝে পাবে কূল
কাগজের তরী বেয়ে।
আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে
চেয়ে থাকি বসি তীরে।
ছোটো ছোটো ঢেউ ওঠে আর পড়ে,
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে,
আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি,
বায়ু বহে ধীরে ধীরে।
গগনের তলে মেঘ ভাসে কত
আমারি সে ছোটো নৌকার মতো—
কে ভাসালে তায়, কোথা ভেসে যায়,
কোন্ দেশে গিয়ে লাগে।
ওই মেঘ আর তরণী আমার
কে যাবে কাহার আগে।
বেলা হলে শেষে বাড়ি থেকে এসে
নিয়ে যায় মোরে টানি;
আমি ঘরে ফিরি, থাকি কোণে মিশি,
যেথা কাটে দিন সেথা কাটে নিশি—
কোথা কোন্ গাঁয় ভেসে চলে যায়
আমার নৌকাখানি।
কোন্ পথে যাবে কিছু নাই জানা,
কেহ তারে কভু নাহি করে মানা,
ধরে নাহি রাখে, ফিরে নাহি ডাকে—
ধায় নব নব দেশে।
কাগজের তরী, তারি ‘পরে চড়ি
মন যায় ভেসে ভেসে।
রাত হয়ে আসে, শুই বিছানায়,
মুখ ঢাকি দুই হাতে—
চোখ বুজে ভাবি— এমন আঁধার,
কালি দিয়ে ঢালা নদীর দু ধার
তারি মাঝখানে কোথায় কে জানে
নৌকা চলেছে রাতে।
আকাশের তারা মিটি-মিটি করে,
শিয়াল ডাকিছে প্রহরে প্রহরে,
তরীখানি বুঝি ঘর খুঁজি খুঁজি
তীরে তীরে ফিরে ভাসি।
ঘুম লয়ে সাথে চড়েছে তাহাতে
ঘুমপাড়ানিয়া মাসি।
কেন মধুর
রঙিন খেলেনা দিলে ও রাঙা হাতে
তখন বুঝি রে বাছা, কেন যে প্রাতে
এত রঙ খেলে মেঘে জলে রঙ ওঠে জেগে,
কেন এত রঙ লেগে ফুলের পাতে—
রাঙা খেলা দেখি যবে ও রাঙা হাতে।
গান গেয়ে তোরে আমি নাচাই যবে
আপন হৃদয়-মাঝে বুঝি রে তবে,
পাতায় পাতায় বনে ধ্বনি এত কী কারণে,
ঢেউ বহে নিজমনে তরল রবে,
বুঝি তা তোমারে গান শুনাই যবে।
যখন নবনী দিই লোলুপ করে
হাতে মুখে মেখেচুকে বেড়াও ঘরে,
তখন বুঝিতে পারি স্বাদু কেন নদীবারি,
ফল মধুরসে ভারী কিসের তরে,
যখন নবনী দিই লোলুপ করে।
যখন চুমিয়ে তোর বদনখানি
হাসিটি ফুটায়ে তুলি তখনি জানি
আকাশ কিসের সুখে আলো দেয় মোর মুখে,
বায়ু দিয়ে যায় বুকে অমৃত আনি—
বুঝি তা চুমিলে তোর বদনখানি।
খেলা
তোমার কটি – তটের ধটি
কে দিল রাঙিয়া ।
কোমল গায়ে দিল পরায়ে
রঙিন আঙিয়া ।
বিহানবেলা আঙিনাতলে
এসেছ তুমি কী খেলাছলে ,
চরণ দুটি চলিতে ছুটি
পড়িছে ভাঙিয়া ।
তোমার কটি – তটের ধটি
কে দিল রাঙিয়া ।
কিসের সুখে সহাস মুখে
নাচিছ বাছনি ,
দুয়ার – পাশে জননী হাসে
হেরিয়া নাচনি ।
তাথেই থেই তালির সাথে
কাঁকন বাজে মায়ের হাতে ,
রাখাল – বেশে ধরেছ হেসে
বেণুর পাঁচনি ।
কিসের সুখে সহাস মুখে
নাচিছ বাছনি ।
ভিখারি ওরে , অমন করে
শরম ভুলিয়া
মাগিস কী বা মায়ের গ্রীবা
আঁকড়ি ঝুলিয়া ।
ওরে রে লোভী , ভুবনখানি
গগন হতে উপাড়ি আনি
ভরিয়া দুটি ললিত মুঠি
দিব কি তুলিয়া ।
কী চাস ওরে অমন করে
শরম ভুলিয়া ।
নিখিল শোনে আকুল মনে
নূপুর – বাজনা ।
তপন শশী হেরিছে বসি
তোমার সাজনা।
ঘুমাও যবে মায়ের বুকে
আকাশ চেয়ে রহে ও মুখে ,
জাগিলে পরে প্রভাত করে
নয়ন – মাজনা ।
নিখিল শোনে আকুল মনে
নূপুর – বাজনা ।
ঘুমের বুড়ি আসিছে উড়ি
নয়ন – ঢুলানী ,
গায়ের ‘পরে কোমল করে
পরশ – বুলানী ।
মায়ের প্রাণে তোমারি লাগি
জগৎ – মাতা রয়েছে জাগি ,
ভুবন – মাঝে নিয়ত রাজে
ভুবন – ভুলানী ।
ঘুমের বুড়ি আসিছে উড়ি
নয়ন – ঢুলানী ।
খোকা
খোকার চোখে যে ঘুম আসে
সকল – তাপ – নাশা —
জান কি কেউ কোথা হতে যে
করে সে যাওয়া – আসা ।
শুনেছি রূপকথার গাঁয়ে
জোনাকি – জ্বলা বনের ছায়ে
দুলিছে দুটি পারুল – কুঁড়ি ,
তাহারি মাঝে বাসা —
সেখান থেকে খোকার চোখে
করে সে যাওয়া – আসা ।
খোকার ঠোঁটে যে হাসিখানি
চমকে ঘুমঘোরে —
কোন্ দেশে যে জনম তার
কে কবে তাহা মোরে ।
শুনেছি কোন্ শরৎ – মেঘে
শিশু – শশীর কিরণ লেগে
সে হাসিরুচি জনমি ছিল
শিশিরশুচি ভোরে —
খোকার ঠোঁটে যে হাসিখানি
চমকে ঘুমঘোরে ।