আমি যখন বাবার খাতা টেনে
লিখি বসে দোয়াত কলম এনে—
ক খ গ ঘ ঙ হ য ব র,
আমার বেলা কেন মা, রাগ কর।
বাবা যখন লেখে
কথা কও না দেখে।
বড়ো বড়ো রুল – কাটা কাগজ
নষ্ট বাবা করেন না কি রোজ।
আমি যদি নৌকো করতে চাই
অম্নি বল, নষ্ট করতে নাই।
সাদা কাগজ কালো
করলে বুঝি ভালো?
সাত ভাই চম্পা
সাতটি চাঁপা সাতটি গাছে,
সাতটি চাঁপা ভাই—
রাঙা – বসন পারুলদিদি,
তুলনা তার নাই।
সাতটি সোনা চাঁপার মধ্যে
সাতটি সোনা মুখ,
পারুলদিদির কচি মুখটি
করতেছে টুক্টুক্।
ঘুমটি ভাঙে পাখির ডাকে,
রাতটি যে পোহালো—
ভোরের বেলা চাঁপায় পড়ে
চাঁপার মতো আলো।
শিশির দিয়ে মুখটি মেজে
মুখখানি বের করে
কী দেখছে সাত ভায়েতে
সারা সকাল ধ’রে।
দেখছে চেয়ে ফুলের বনে
গোলাপ ফোটে – ফোটে,
পাতায় পাতায় রোদ পড়েছে,
চিক্চিকিয়ে ওঠে।
দোলা দিয়ে বাতাস পালায়
দুষ্টু ছেলের মতো,
লতায় পাতায় হেলাদোলা
কোলাকুলি কত।
গাছটি কাঁপে নদীর ধারে
ছায়াটি কাঁপে জলে—
ফুলগুলি সব কেঁদে পড়ে
শিউলি গাছের তলে।
ফুলের থেকে মুখ বাড়িয়ে
দেখতেছে ভাই বোন—
দুখিণী এক মায়ের তরে
আকুল হল মন।
সারাটা দিন কেঁপে কেঁপে
পাতার ঝুরুঝুরু,
মনের সুখে বনের যেন
বুকের দুরুদুরু।
কেবল শুনি কুলুকুলু
একি ঢেউয়ের খেলা।
বনের মধ্যে ডাকে ঘুঘু
সারা দুপুরবেলা।
মৌমাছি সে গুনগুনিয়ে
খুঁজে বেড়ায় কাকে,
ঘাসের মধ্যে ঝিঁ ঝিঁ করে
ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে।
ফুলের পাতায় মাথা রেখে
শুনতেছে ভাই বোন—
মায়ের কথা মনে পড়ে,
আকুল করে মন।
মেঘের পানে চেয়ে দেখে—
মেঘ চলেছে ভেসে,
রাজহাঁসেরা উড়ে উড়ে
চলেছে কোন্ দেশে।
প্রজাপতির বাড়ি কোথায়
জানে না তো কেউ,
সমস্ত দিন কোথায় চলে
লক্ষ হাজার ঢেউ।
দুপুর বেলা থেকে থেকে
উদাস হল বায়,
শুকনো পাতা খ’সে প’ড়ে
কোথায় উড়ে যায়!
ফুলের মাঝে দুই গালে হাত
দেখতেছে ভাই বোন—
মায়ের কথা পড়ছে মনে,
কাঁদছে পরান মন।
সন্ধে হলে জোনাই জ্বলে
পাতায় পাতায়,
অশথ গাছে দুটি তারা
গাছের মাথায়।
বাতাস বওয়া বন্ধ হল,
স্তব্ধ পাখির ডাক,
থেকে থেকে করছে কা – কা
দুটো – একটা কাক।
পশ্চিমেতে ঝিকিমিকি,
পুবে আঁধার করে—
সাতটি ভায়ে গুটিসুটি
চাঁপা ফুলের ঘরে।
‘গল্প বলো পারুলদিদি’
সাতটি চাঁপা ডাকে,
পারুলদিদির গল্প শুনে
মনে পড়ে মাকে।
প্রহর বাজে, রাত হয়েছে,
ঝাঁ ঝাঁ করে বন—
ফুলের মাঝে ঘুমিয়ে প’ল
আটটি ভাই বোন।
সাতটি তারা চেয়ে আছে
সাতটি চাঁপার বাগে,
চাঁদের আলো সাতটি ভায়ের
মুখের পরে লাগে।
ফুলের গন্ধ ঘিরে আছে
সাতটি ভায়ের তনু—
কোমন শয্যা কে পেতেছে
সাতটি ফুলের রেণু।
ফুলের মধ্যে সাত ভায়েতে
স্বপ্ন দেখে মাকে—
সকাল বেলা ‘জাগো জাগো’
পারুলদিদি ডাকে।
হাসিরাশি
নাম রেখেছি বাব্লারানী,
একরত্তি মেয়ে।
হাসিখুশি চাঁদের আলো
মুখটি আছে ছেয়ে।
ফুট্ফুটে তার দাঁত কখানি,
পুট্পুটে তার ঠোঁট।
মুখের মধ্যে কথাগুলি সব
উলোটপালোট।
কচি কচি হাত দুখানি,
কচি কচি মুঠি,
মুখ নেড়ে কেউ কথা ক’লে
হেসেই কুটি-কুটি।
তাই তাই তাই তালি দিয়ে
দুলে দুলে নড়ে,
চুলগুলি সব কালো কালো
মুখে এসে পড়ে।
‘চলি চলি পা পা’
টলি টলি যায়,
গরবিনী হেসে হেসে
আড়ে আড়ে চায়।
হাতটি তুলে চুড়ি দুগাছি
দেখায় যাকে তাকে,
হাসির সঙ্গে নেচে নেচে
নোলক দোলে নাকে।
রাঙা দুটি ঠোঁটের কাছে
মুক্তো আছে ফ’লে,
মায়ের চুমোখানি-যেন
মুক্তো হয়ে দোলে।
আকাশেতে চাঁদ দেখেছে,
দু হাত তুলে চায়,
মায়ের কোলে দুলে দুলে
ডাকে ‘আয় আয়’।
চাঁদের আঁখি জুড়িয়ে গেল
তার মুখেতে চেয়ে,
চাঁদ ভাবে কোত্থেকে এল
চাঁদের মতো মেয়ে।
কচি প্রাণের হাসিখানি
চাঁদের পানে ছোটে,
চাঁদের মুখের হাসি আরো
বেশি ফুঠে ওঠে।
এমন সাধের ডাক শুনে চাঁদ
কেমন করে আছে—
তারাগুলি ফেলে বুঝি
নেমে আসবে কাছে!
সুধামুখের হাসিখানি
চুরি করে নিয়ে
রাতারাতি পালিয়ে যাবে
মেঘের আড়াল দিয়ে।
আমরা তারে রাখব ধরে
রানীর পাশেতে।
হাসিরাশি বাঁধা রবে
হাসিরাশিতে।
০১.ভূমিকা (শিশু)
জগৎ – পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে মেলা ।
অন্তহীন গগনতল
মাথার ‘পরে অচঞ্চল ,
ফেনিল ওই সুনীল জল
নাচিছে সারা বেলা ।
উঠিছে তটে কী কোলাহল —
ছেলেরা করে মেলা ।
বালুকা দিয়ে বাঁধিছে ঘর ,
ঝিনুক নিয়ে খেলা ।
বিপুল নীল সলিল -‘ পরি
ভাসায় তারা খেলার তরী
আপন হাতে হেলায় গড়ি
পাতায় – গাঁথা ভেলা ।
জগৎ – পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে খেলা ।
জানে না তারা সাঁতার দেওয়া ,
জানে না জাল ফেলা ।
ডুবারি ডুবে মুকুতা চেয়ে ,
বণিক ধায় তরণী বেয়ে ,
ছেলেরা নুড়ি কুড়ায়ে পেয়ে
সাজায় বসি ঢেলা ।
রতন ধন খোঁজে না তারা ,
জানে না জাল ফেলা ।
ফেনিয়ে উঠে সাগর হাসে ,
হাসে সাগর – বেলা ।
ভীষণ ঢেউ শিশুর কানে
রচিছে গাথা তরল তানে ,
দোলনা ধরি যেমন গানে
জননী দেয় ঠেলা ।
সাগর খেলে শিশুর সাথে ,
হাসে সাগর – বেলা ।
জগৎ – পারাবারের তীরে
ছেলেরা করে মেলা ।
ঝঞ্ঝা ফিরে গগনতলে ,
তরণী ডুবে সুদূর জলে ,
মরণ – দূত উড়িয়া চলে ,
ছেলেরা করে খেলা ।
জগৎ – পারাবারের তীরে
শিশুর মহামেলা ।