লুকোচুরি
আমি যদি দুষ্টুমি করে
চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি,
ভোরের বেলা মা গো, ডালের ‘পরে
কচি পাতায় করি লুটোপুটি,
তবে তুমি আমার কাছে হারো,
তখন কি মা চিনতে আমায় পারো।
তুমি ডাক, ‘খোকা কোথায় ওরে। ‘
আমি শুধু হাসি চুপটি করে।
যখন তুমি থাকবে যে কাজ নিয়ে
সবই আমি দেখব নয়ন মেলে।
স্নানটি করে চাঁপার তলা দিয়ে
আসবে তুমি পিঠেতে চুল ফেলে;
এখান দিয়ে পুজোর ঘরে যাবে,
দূরের থেকে ফুলের গন্ধ পাবে—
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার খোকার গায়ের গন্ধ আসে।
দুপুর বেলা মহাভারত-হাতে
বসবে তুমি সবার খাওয়া হলে,
গাছের ছায়া ঘরের জানালাতে
পড়বে এসে তোমার পিঠে কোলে,
আমি আমার ছোট্ট ছায়াখানি
দোলাব তোর বইয়ের ‘পরে আনি—
তখন তুমি বুঝতে পারবে না সে
তোমার চোখে খোকার ছায়া ভাসে।
সন্ধেবেলায় প্রদীপখানি জ্বেলে
যখন তুমি যাবে গোয়ালঘরে
তখন আমি ফুলের খেলা খেলে
টুপ্ করে মা , পড়ব ভুঁয়ে ঝরে।
আবার আমি তোমার খোকা হব,
‘গল্প বলো’ তোমায় গিয়ে কব।
তুমি বলবে, ‘দুষ্টু, ছিলি কোথা। ‘
আমি বলব, ‘ বলব না সে কথা। ‘
শীত
পাখি বলে ‘আমি চলিলাম’,
ফুল বলে ‘আমি ফুটিব না’,
মলয় কহিয়া গেল শুধু
‘বনে বনে আমি ছুটিব না’।
কিশলয় মাথাটি না তুলে
মরিয়া পড়িয়া গেল ঝরি,
সায়াহ্ন ধুমলঘন বাস
টানি দিল মুখের উপরি।
পাখি কেন গেল গো চলিয়া,
কেন ফুল কেন সে ফুটে না।
চপল মলয় সমীরণ
বনে বনে কেন সে ছুটে না।
শীতের হৃদয় গেছে চলে,
অসাড় হয়েছে তার মন,
ত্রিবলিবলিত তার ভাল
কঠোর জ্ঞানের নিকেতন।
জ্যোৎস্নার যৌবন-ভরা রূপ,
ফুলের যৌবন পরিমল,
মলয়ের বাল্যখেলা যত,
পল্লবের বাল্য – কোলাহল—
সকলি সে মনে করে পাপ,
মনে করে প্রকৃতির ভ্রম,
ছবির মতন বসে থাকা
সেই জানে জ্ঞানীর ধরম।
তাই পাখি বলে ‘চলিলাম’,
ফুল বলে ‘আমি ফুটিব না’।
মলয় কহিয়া গেল শুধু
‘বনে বনে আমি ছুটিব না’।
আশা বলে ‘বসন্ত আসিবে’,
ফুল বলে ‘আমিও আসিব’,
পাখি বলে ‘আমিও গাহিব’,
চাঁদ বলে ‘আমিও হাসিব’।
বসন্তের নবীন হৃদয়
নূতন উঠেছে আঁখি মেলে—
যাহা দেখে তাই দেখে হাসে,
যাহা পায় তাই নিয়ে খেলে।
মনে তার শত আশা জাগে,
কী যে চায় আপনি না বুঝে—
প্রাণ তার দশ দিকে ধায়
প্রাণের মানুষ খুঁজে খুঁজে।
ফুল ফুটে, তারো মুখ ফুটে—
পাখি গায়, সেও গান গায়—
বাতাস বুকের কাছে এলে
গলা ধ’রে দুজনে খেলায়।
তাই শুনি ‘বসন্ত আসিবে’
ফুল বলে ‘আমিও আসিব’ ,
পাখি বলে ‘আমিও গাহিব’,
চাঁদ বলে ‘আমিও হাসিব’।
শীত, তুমি হেথা কেন এলে।
উত্তরে তোমার দেশ আছে—
পাখি সেথা নাহি গাহে গান,
ফুল সেথা নাহি ফুটে গাছে।
সকলি তুষারমরুময়,
সকলিআঁধার জনহীন—
সেথায় একেলা বসি বসি
জ্ঞানী গো, কাটায়ো তব দিন।
শীতের বিদায়
বসন্ত বালক মুখ-ভরা হাসিটি,
বাতাস ব’য়ে ওড়ে চুল—
শীত চলে যায়, মারে তার গায়
মোটা মোটা গোটা ফুল।
আঁচল ভরে গেছে শত ফুলের মেলা,
গোলাপ ছুঁড়ে মারে টগর চাঁপা বেলা—
শীত বলে, ‘ভাই, এ কেমন খেলা,
যাবার বেলা হল, আসি। ‘
বসন্ত হাসিয়ে বসন ধ’রে টানে,
পাগল করে দেয় কুহু কুহু গানে,
ফুলের গন্ধ নিয়ে প্রাণের ‘পরে হানে—
হাসির ‘পরে হানে হাসি।
ওড়ে ফুলের রেণু, ফুলের পরিমল,
ফুলের পাপড়ি উড়ে করে যে বিকল—
কুসুমিত শাখা, বনপথ ঢাকা,
ফুলের ‘পরে পড়ে ফুল।
দক্ষিনে বাতাসে ওড়ে শীতের বেশ,
উড়ে উড়ে পড়ে শীতের শুভ্র কেশ;
কোন্ পথে যাবে না পায় উদ্দেশ,
হয়ে যায় দিক ভুল।
বসন্ত বালক হেসেই কুটিকুটি,
টলমল করে রাঙা চরণ দুটি,
গান গেয়ে পিছে ধায় ছুটিছুটি—
বনে লুটোপুটি যায়।
নদী তালি দেয় শত হাত তুলি,
বলাবলি করে ডালপালাগুলি,
লতায় লতায় হেসে কোলাকুলি—
অঙ্গুলি তুলি চায়।
রঙ্গ দেখে হাসে মল্লিকা মালতী,
আশেপাশে হাসে কতই জাতী যূথী,
মুখে বসন দিয়ে হাসে লজ্জাবতী—
বনফুলবধূগুলি।
কত পাখি ডাকে কত পাখি গায়,
কিচিমিচিকিচি কত উড়ে যায়,
এ পাশে ও পাশে মাথাটি হেলায়—
নাচে পুচ্ছখানি তুলি।
শীত চলে যায়, ফিরে ফিরে চায়,
মনে মনে ভাবে ‘এ কেমন বিদায়’—
হাসির জ্বালায় কাঁদিয়ে পালায়,
ফুলঘায় হার মানে।
শুকনো পাতা তার সঙ্গে উড়ে যায়,
উত্তরে বাতাস করে হায়-হায়—
আপাদমস্তক ঢেকে কুয়াশায়
শীত গেল কোন্খানে।
সমব্যথী
যদি খোকা না হয়ে
আমি হতেম কুকুর-ছানা—
তবে পাছে তোমার পাতে
আমি মুখ দিতে যাই ভাতে
তুমি করতে আমায় মানা?
সত্যি করে বল্
আমায় করিস নে মা, ছল—
বলতে আমায় ‘দূর দূর দূর।
কোথা থেকে এল এই কুকুর’?
যা মা, তবে যা মা,
আমায় কোলের থেকে নামা।
আমি খাব না তোর হাতে,
আমি খাব না তোর পাতে।
যদি খোকা না হয়ে
আমি হতেম তোমার টিয়ে,
তবে পাছে যাই মা, উড়ে
আমায় রাখতে শিকল দিয়ে?
সত্যি করে বল্
আমায় করিস নে মা, ছল—
বলতে আমায় ‘হতভাগা পাখি
শিকল কেটে দিতে চায় রে ফাঁকি’?
তবে নামিয়ে দে মা,
আমায় ভালোবাসিস নে মা।
আমি রব না তোর কোলে,
আমি বনেই যাব চলে।
সমালোচক
বাবা নাকি বই লেখে সব নিজে।
কিছুই বোঝা যায় না লেখেন কী যে।
সেদিন পড়ে শোনাচ্ছিলেন তোরে,
বুঝেছিলি?— বল্ মা সত্যি করে।
এমন লেখায় তবে
বল্ দেখি কী হবে।
তোর মুখে মা, যেমন কথা শুনি,
তেমন কেন লেখেন নাকো উনি।
ঠাকুরমা কি বাবাকে কক্খনো
রাজার কথা শোনায় নিকো কোনো।
সে – সব কথাগুলি
গেছেন বুঝি ভুলি?
স্নান করতে বেলা হল দেখে
তুমি কেবল যাও মা, ডেকে ডেকে—
খাবার নিয়ে তুমি বসেই থাকো,
সে কথা তাঁর মনেই থাকে নাকো।
করেন সারা বেলা
লেখা – লেখা খেলা।
বাবার ঘরে আমি খেলতে গেলে
তুমি আমায় বল, ‘দুষ্টু ছেলে!’
বক আমায় গোল করলে পরে—
‘দেখছিস নে লিখছে বাবা ঘরে!’
বল্ তো, সত্যি বল্,
লিখে কী হয় ফল।