উপহার
নিভৃত এ চিত্তমাঝে নিমেষে নিমেষে বাজে
জগতের তরঙ্গ-আঘাত,
ধ্বনিত হৃদয়ে তাই মুহূর্ত বিরাম নাই
নিদ্রাহীন সারা দিনরাত।
সুখ দুঃখ গীতস্বর ফুটিতেছে নিরন্তর—
ধ্বনি শুধু, সাথে নাই ভাষা।
বিচিত্র সে কলরোলে ব্যাকুল করিয়া তোলে
জাগাইয়া বিচিত্র দুরাশা।
এ চিরজীবন তাই আর কিছু কাজ নাই
রচি শুধু অসীমের সীমা।
আশা দিয়ে, ভাষা দিয়ে, তাহে ভালোবাসা দিয়ে
গড়ে তুলি মানসী-প্রতিমা।
বাহিরে পাঠায় বিশ্ব কত গন্ধ গান দৃশ্য
সঙ্গীহারা সৌন্দর্যের বেশে,
বিরহী সে ঘুরে ঘুরে ব্যথাভরা কত সুরে
কাঁদে হৃদয়ের দ্বারে এসে।
সেই মোহমন্ত্র গানে কবির গভীর প্রাণে
জেগে ওঠে বিরহী ভাবনা,
ছাড়ি অন্তঃপুরবাসে সলজ্জ চরণে আসে
মূর্তিমতী মর্মের কামনা।
অন্তরে বাহিরে সেই ব্যাকুলিত মিলনেই
কবির একান্ত সুখোচ্ছ্বাস।
সেই আনন্দমুহূর্তগুলি তব করে দিনু তুলি
সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ।
একাল ও সেকাল
বর্ষা এলায়েছে তার মেঘময় বেণী।
গাঢ় ছায়া সারাদিন,
মধ্যাহ্ন তপনহীন,
দেখায় শ্যামলতর শ্যাম বনশ্রেণী।
আজিকে এমন দিনে শুধু পড়ে মনে
সেই দিবা-অভিসার
পাগলিনী রাধিকার,
না জানি সে কবেকার দূর বৃন্দাবনে।
সেদিনও এমনি বায়ু রহিয়া রহিয়া।
এমনি অশ্রান্ত বৃষ্টি,
তড়িৎচকিত দৃষ্টি,
এমনি কাতর হায় রমণীর হিয়া।
বিরহিণী মর্মে-মরা মেঘমন্দ্র স্বরে।
নয়নে নিমেষ নাহি,
গগনে রহিত চাহি,
আঁকিত প্রাণের আশা জলদের স্তরে।
চাহিত পথিকবধূ শূন্য পথপানে।
মল্লার গাহিত কারা,
ঝরিত বরষাধারা,
নিতান্ত বাজিত গিয়া কাতর পরানে।
যক্ষনারী বীণা কোলে ভূমিতে বিলীন;
বক্ষে পড়ে রুক্ষ কেশ,
অযত্নশিথিল বেশ,
সেদিনও এমনিতরো অন্ধকার দিন।
সেই কদম্বের মূল, যমুনার তীর,
সেই সে শিখীর নৃত্য
এখনো হরিছে চিত্ত—
ফেলিছে বিরহ-ছায়া শ্রাবণতিমির।
আজও আছে বৃন্দাবন মানবের মনে।
শরতের পূর্ণিমায়
শ্রাবণের বরিষায়
উঠে বিরহের গাথা বনে উপবনে।
এখনো সে বাঁশি বাজে যমুনার তীরে।
এখনো প্রেমের খেলা
সারা নিশি, সারা বেলা,
এখনো কাঁদিছে রাধা হৃদয়কুটিরে।
কবির প্রতি নিবেদন
হেথা কেন দাঁড়ায়েছ, কবি,
যেন কাষ্ঠপুত্তলছবি?
চারি দিকে লোকজন চলিতেছে সারাখন,
আকাশে উঠিছে খর রবি।
কোথা তব বিজন ভবন,
কোথা তব মানসভুবন?
তোমারে ঘেরিয়া ফেলি কোথা সেই করে কেলি
কল্পনা, মুক্ত পবন?
নিখিলের আনন্দধাম
কোথা সেই গভীর বিরাম?
জগতের গীতধার কেমনে শুনিবে আর?
শুনিতেছ আপনারি নাম।
আকাশের পাখি তুমি ছিলে,
ধরণীতে কেন ধরা দিলে?
বলে সবে বাহা-বাহা, সকলে পড়ায় যাহা
তুমি তাই পড়িতে শিখিলে!
প্রভাতের আলোকের সনে
অনাবৃত প্রভাতগগনে
বহিয়া নূতন প্রাণ ঝরিয়া পড়ে না গান
ঊর্ধ্বনয়ন এ ভুবনে।
পথ হতে শত কলরবে
‘গাও গাও’ বলিতেছে সবে।
ভাবিতে সময় নাই— গান চাই, গান চাই,
থামিতে চাহিছে প্রাণ যবে।
থামিলে চলিয়া যাবে সবে,
দেখিতে কেমনতর হবে!
উচ্চ আসনে লীন প্রাণহীন গানহীন
পুতলির মতো বসে রবে।
শ্রান্তি লুকাতে চাও ত্রাসে,
কন্ঠ শুষ্ক হয়ে আসে।
শুনে যারা যায় চলে দু-চারিটা কথা ব’লে
তারা কি তোমায় ভালোবাসে?
কত মতো পরিয়া মুখোশ
মাগিছ সবার পরিতোষ।
মিছে হাসি আনো দাঁতে, মিছে জল আঁখিপাতে,
তবু তারা ধরে কত দোষ।
মন্দ কহিছে কেহ ব’সে,
কেহ বা নিন্দা তব ঘোষে।
তাই নিয়ে অবিরত তর্ক করিছ কত,
জ্বলিয়া মরিছ মিছে রোষে।
মূর্খ, দম্ভ-ভরা দেহ,
তোমারে করিয়া যায় স্নেহ।
হাত বুলাইয়া পিঠে কথা বলে মিঠে মিঠে,
‘শাবাশ’ ‘শাবাশ’ বলে কেহ।
হায় কবি, এত দেশ ঘুরে
আসিয়া পড়েছ কোন্ দূরে!
এ যে কোলাহলমরু— নাই ছায়া, নাই তরু,
যশের কিরণে মরো পুড়ে।
দেখো, হোথা নদী-পর্বত,
অবারিত অসীমের পথ।
প্রকৃতি শান্ত মুখে ছুটায় গগনবুকে
গ্রহতারাময় তার রথ।
সবাই আপন কাজে ধায়,
পাশে কেহ ফিরিয়া না চায়।
ফুটে চিররূপরাশি চিরমধুময় হাসি,
আপনারে দেখিতে না পায়।
হোথা দেখো একেলা আপনি
আকাশের তারা গণি গণি
ঘোর নিশীথের মাঝে কে জাগে আপন কাজে,
সেথায় পশে না কলধ্বনি।
দেখো হোথা নূতন জগৎ—
ওই কারা আত্মহারাবৎ
যশ-অপযশ-বাণী কোনো কিছু নাহি মানি
রচিছে সুদূর ভবিষ্যৎ।
ওই দেখো, না পুরিতে আশ
মরণ করিল কারে গ্রাস।
নিশি না হইতে সারা খসিয়া পড়িল তারা,
রাখিয়া গেল না ইতিহাস।
ওই কারা গিরির মতন
আপনাতে আপনি বিজন—
হৃদয়ের স্রোত উঠি গোপন আলয় টুটি
দূর দূর করিছে মগন।
ওই কারা বসে আছে দূরে
কল্পনা-উদয়াচল-পুরে—
অরুণপ্রকাশ-প্রায় আকাশ ভরিয়া যায়
প্রতিদিন নব নব সুরে।
হোথা উঠে নবীন তপন,
হোথা হতে বহিছে পবন।
হোথা চির ভালোবাসা— নব গান, নব আশা—
অসীম বিরামনিকেতন।
হোথা মানবের জয় উঠিছে জগৎময়,
ওইখানে মিলিয়াছে নরনারায়ণ।
হেথা, কবি, তোমারে কি সাজে
ধূলি আর কলরোল -মাঝে?
কুহুধ্বনি
প্রখর মধ্যাহ্নতাপে প্রান্তর ব্যাপিয়া কাঁপে
বাষ্পশিখা অনলশ্বসনা,
অম্বেষিয়া দশ দিশা যেন ধরণীর তৃষা
মেলিয়াছে লেলিহা রসনা।
ছায়া মেলি সারি সারি স্তব্ধ আছে তিন-চারি
সিসু গাছ পাণ্ডুকিশলয়,
নিম্ববৃক্ষ ঘনশাখা গুচ্ছ গুচ্ছ পুষ্পে ঢাকা,
আম্রবন তাম্রফলময়।
গোলক-চাঁপার ফুলে গন্ধের হিল্লোল তুলে,
বন হতে আসে বাতায়নে—
ঝাউ গাছ ছায়াহীন নিশ্বসিছে উদাসীন
শূন্যে চাহি আপনার মনে।
দুরান্ত প্রান্তর শুধু তপনে করিছে ধু ধু,
বাঁকা পথ শুষ্ক তপ্তকায়া—
তারি প্রান্তে উপবন, মৃদুমন্দ সমীরণ,
ফুলগন্ধ, শ্যামস্নিগ্ধ ছায়া।
ছায়ায় কুটিরখানা দু ধারে বিছায়ে ডানা
পক্ষী-সম করিছে বিরাজ,
তারি তলে সবে মিলি চলিতেছে নিরিবিলি
সুখে দুঃখে দিবসের কাজ।
কোথা হতে নিদ্রাহীন রৌদ্রদগ্ধ দীর্ঘ দিন
কোকিল গাহিছে কুহুস্বরে।
সেই পুরাতন তান প্রকৃতির মর্ম-গান
পশিতেছে মানবের ঘরে।
বসি আঙিনার কোণে গম ভাঙে দুই বোনে,
গান গাহে শ্রান্তি নাহি মানি।
বাঁধা কূপ, তরুতল, বালিকা তুলিছে জল
খরতাপে ম্লানমুখখানি।
দূরে নদী, মাঝে চর; বসিয়া মাচার’পর
শস্যখেত আগলিছে চাষি।
রাখালশিশুরা জুটে নাচে গায় খেলে ছুটে,
দূরে তরী চলিয়াছে ভাসি।
কত কাজ কত খেলা কত মানবের মেলা,
সুখ দুঃখ ভাবনা অশেষ—
তারি মাঝে কুহুস্বর একতান সকাতর
কোথা হতে লভিছে প্রবেশ।
নিখিল করিছে মগ্ন— জড়িত মিশ্রিত ভগ্ন
গীতহীন কলরব কত,
পড়িতেছে তারি’পর পরিপূর্ণ সুধাস্বর
পরিস্ফুট পুষ্পটির মতো।
এত কাণ্ড, এত গোল, বিচিত্র এ কলরোল
সংসারের আবর্তবিভ্রমে—
তবু সেই চিরকাল অরণ্যের অন্তরাল
কুহুধ্বনি ধ্বনিছে পঞ্চমে।
যেন কে বসিয়া আছে বিশ্বের বক্ষের কাছে
যেন কোন্ সরলা সুন্দরী,
যেন সেই রূপবতী সংগীতের সরস্বতী
সম্মোহন-বীণা করে ধরি’—
সুকুমার কর্ণে তার ব্যথা দেয় অনিবার
গণ্ডগোল দিবসে নিশীথে,
জটিল সে ঝঞ্ঝনায় বাঁধিয়া তুলিতে চায়
সৌন্দর্যের সরল সংগীতে।
তাই ওই চিরদিন ধ্বনিতেছে শ্রান্তিহীন
কুহুতান, করিছে কাতর—
সংগীতের ব্যথা বাজে, মিশিয়াছে তার মাঝে
করুণার অনুনয়স্বর।
কেহ বসে গৃহ-মাঝে, কেহ বা চলেছে কাজে,
কেহ শোনে, কেহ নাহি শোনে—
তবুও সে কী মায়ায় ওই ধ্বনি থেকে যায়
বিশ্বব্যাপী মানবের মনে।
তবু যুগ-যুগান্তর মানবজীবনস্তর
ওই গানে আর্দ্র হয়ে আসে,
কত কোটি কুহুতান মিশায়েছে নিজ প্রাণ
জীবের জীবন-ইতিহাসে।
সুখে দুঃখে উৎসবে গান উঠে কলরবে
বিরল গ্রামের মাঝখানে,
তারি সাথে সুধাস্বরে মিশে ভালোবাসাভরে
পাখি-গানে মানবের গানে।
কোজাগর পূর্ণিমায় শিশু শূন্যে হেসে চায়,
ঘিরে হাসে জনকজননী—
সুদূর বনান্ত হতে দক্ষিণ সমীর-স্রোতে
ভেসে আসে কুহুকুহু ধ্বনি।
প্রচ্ছায়তমসাতীরে শিশু কুশলব ফিরে,
সীতা হেরে বিষাদে হরিষে—
ঘন সহকারশাখে মাঝে মাঝে পিক ডাকে,
কুহুতানে করুণা বরিষে।
লতাকুঞ্জে তপোবনে বিজনে দুষ্মন্তসনে
শকুন্তলা লাজে থরথর,
তখনো সে কুহু ভাষা রমণীর ভালোবাসা
করেছিল সুমধুরতর।
নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নে তাই অতীতের মাঝে ধাই
শুনিয়া আকুল কুহুরব—
বিশাল মানবপ্রাণ মোর মাঝে বর্তমান
দেশ কাল করি অভিভব।
অতীতের দুঃখ সুখ, দূরবাসী প্রিয়মুখ,
শৈশবের স্বপ্নশ্রুত গান,
ওই কুহুমন্ত্রবলে জাগিতেছে দলে দলে,
লভিতেছে নূতন পরান।