তবে লুকাব না আমি আর
এই ব্যথিত হৃদয়ভার।
আপনার হাতে চাব না রাখিতে
আপনার অধিকার।
বাঁচিলাম প্রাণে তেয়াগিয়া লাজ,
বদ্ধ বেদনা ছাড়া পেল আজ,
আশা-নিরাশায় তোমারি যে আমি
জানাইনু শত বার।
আমার সুখ
ভালোবাসা-ঘেরা ঘরে কোমল শয়নে তুমি
যে সুখেই থাকো,
যে মাধুরী এ জীবনে আমি পাইয়াছি তাহা
তুমি পেলে নাকো।
এই-যে অলস বেলা, অলস মেঘের মেলা,
জলেতে আলোতে খেলা সারা দিনমান,
এরই মাঝে চারি পাশে কোথা হতে ভেসে আসে
ওই মুখ, ওই হাসি, ওই দু’নয়ান।
সদা শুনি কাছে দূরে মধুর কোমল সুরে
তুমি মোরে ডাকো—
তাই ভাবি, এ জীবনে আমি যাহা পাইয়াছি
তুমি পেলে নাকো।
কোনোদিন একদিন আপনার মনে, শুধু
এক সন্ধ্যাবেলা,
আমারে এমনি করে ভাবিতে পারিতে যদি
বসিয়া একেলা—
এমনি সুদূর বাঁশি শ্রবণে পশিত আসি,
বিষাদকোমল হাসি ভাসিত অধরে,
নয়নে জলের রেখা এক বিন্দু দিত দেখা,
তারি’পরে সন্ধ্যালোক কাঁপিত কাতরে—
ভেসে যেত মনখানি কনকতরণীসম
গৃহহীন স্রোতে—
শুধু একদিন-তরে আমি ধন্য হইতাম
তুমি ধন্য হতে।
তুমি কি করেছ মনে দেখেছ, পেয়েছ তুমি
সীমারেখা মম?
ফেলিয়া দিয়াছ মোরে আদি অন্ত শেষ করে
পড়া পুঁথি-সম?
নাই সীমা আগে পাছে, যত চাও তত আছে,
যতই আসিবে কাছে তত পাবে মোরে।
আমারেও দিয়ে তুমি এ বিপুল বিশ্বভূমি
এ আকাশে এ বাতাস দিতে পারো ভরে।
আমাতেও স্থান পেত অবাধে সমস্ত তব
জীবনের আশা।
একবার ভেবে দেখো এ পরানে ধরিয়াছে
কত ভালোবাসা।
সহসা কী শুভক্ষণে অসীম হৃদয়রাশি
দৈবে পড়ে চোখে।
দেখিতে পাও নি যদি, দেখিতে পাবে না আর,
মিছে মরি বকে।
আমি যা পেয়েছি তাই সাথে নিয়ে ভেসে যাই,
কোনোখানে সীমা নাই ও মধু মুখের—
শুধু স্বপ্ন, শুধু স্মৃতি, তাই নিয়ে থাকি নিতি,
আর আশা নাহি রাখি সুখের দুখের।
আমি যাহা দেখিয়াছি, আমি যাহা পাইয়াছি
এ জনম-সই,
জীবনের সব শূন্য আমি যাহে ভরিয়াছি
তোমার তা কই।
আশঙ্কা
কে জানে এ কি ভালো!
আকাশ-ভরা কিরণধারা
আছিল মোর তপন-তারা,
আজিকে শুধু একেলা তুমি
আমার আঁখি-আলো—
কে জানে এ কি ভালো!
কত-না শোভা, কত-না সুখ,
কত-না ছিল অমিয়-মুখ,
নিত্য-নব পুষ্পরাশি
ফুটিত মোর দ্বারে—
ক্ষুদ্র আশা ক্ষুদ্র স্নেহ
মনের ছিল শতেক গেহ,
আকাশ ছিল, ধরণী ছিল
আমার চারি ধারে—
কোথায় তারা, সকলে আজি
তোমাতেই লুকালো।
কে জানে এ কি ভালো!
কম্পিত এ হৃদয়খানি
তোমার কাছে তাই।
দিবসনিশি জাগিয়া আছি,
নয়নে ঘুম নাই।
সকল গান সকল প্রাণ
তোমারে আমি করেছি দান—
তোমারে ছেড়ে বিশ্বে মোর
তিলেক নাহি ঠাঁই।
সকল পেয়ে তবুও যদি
তৃপ্তি নাহি মেলে,
তবুও যদি চলিয়া যাও
আমারে পাছে ফেলে,
নিমেষে সব শূন্য হবে
তোমারি এই আসন ভবে,
চিহ্নসম কেবল রবে
মৃত্যুরেখা কালো।
কে জানে এ কি ভালো!
উচ্ছৃঙ্খল
এ মুখের পানে চাহিয়া রয়েছ
কেন গো অমন করে?
তুমি চিনিতে নারিবে, বুঝিতে নারিবে মোরে।
আমি কেঁদেছি হেসেছি, ভালো যে বেসেছি
এসেছি যেতেছি সরে
কী জানি কিসের ঘোরে।
কোথা হতে এত বেদনা বহিয়া
এসেছে পরান মম।
বিধাতার এক অর্থবিহীন
প্রলাপবচন-সম।
প্রতিদিন যারা আছে সুখে দুখে
আমি তাহাদের নই—
আমি এসেছি নিমেষে, যাইব নিমেষ বই।
আমি আমারে চিনি নে, তোমারে জানি নে,
আমার আলয় কই!
জগৎ বেড়িয়া নিয়মের পাশ,
অনিয়ম শুধু আমি।
বাসা বেঁধে আছে কাছে কাছে সবে,
কত কাজ করে কত কলরবে,
চিরকাল ধরে দিবস চলিছে
দিবসের অনুগামী—
শুধু আমি নিজবেগ সামালিতে নারি
ছুটেছি দিবসযামী।
প্রতিদিন বহে মৃদু সমীরণ,
প্রতিদিন ফুটে ফুল।
ঝড় শুধু আসে ক্ষণেকের তরে
সৃজনের এক ভুল—
দুরন্ত সাধ কাতর বেদনা
ফুকারিয়া উভরায়
আঁধার হইতে আঁধারে ছুটিয়া যায়।
এ আবেগ নিয়ে কার কাছে যাব,
নিতে কে পারিবে মোরে!
কে আমারে পারে আঁকড়ি রাখিতে
দুখানি বাহুর ডোরে!
আমি কেবল কাতর গীত!
কেহ বা শুনিয়া ঘুমায় নিশীথে,
কেহ জাগে চমকিত।
কত-যে বেদনা সে কেহ বোঝে না,
কত-যে আকুল আশা,
কত-যে তীব্র পিপাসাকাতর ভাষা।
ওগো তোমরা জগৎবাসী,
তোমাদের আছে বরষ বরষ
দরশ-পরশ-রাশি—
আমার কেবল একটি নিমেষ,
তারি তরে ধেয়ে আসি।
মহাসুন্দর একটি নিমেষ
ফুটেছে কাননশেষে,
আমি তারি পানে ধাই, ছিঁড়ে নিতে চাই,
ব্যাকুল বাসনা-সংগীত গাই
অসীমকালের আঁধার হইতে
বাহির হইয়া এসে।
শুধু একটি মুখের এক নিমেষের
একটি মধুর কথা,
তারি তরে বহি চিরদিবসের
চিরমনোব্যাকুলতা।
কালের কাননে নিমেষ লুটিয়া
কে জানে চলেছি কোথা!
ওগো, মিটে না তাহাতে মিটে না প্রাণের ব্যথা।
অধিক সময় নাই।
ঝড়ের জীবন ছুটে চলে যায়
শুধু কেঁদে “চাই চাই”—
যার কাছে আসি তার কাছে শুধু
হাহাকার রেখে যাই।
ওগো, তবে থাক্, যে যায় সে যাক—
তোমরা দিয়ো না ধরা।
আমি চলে যাব ত্বরা।
মোরে কেহ কোরো ভয়, কেহ কোরো ঘৃণা,
ক্ষমা কোরো যদি পারো!
বিস্মিত চোখে ক্ষণেক চাহিয়া
তার পরে পথ ছাড়ো!
তার পরদিনে উঠিবে প্রভাত,
ফুটিবে কুসুম কত,
নিয়মে চলিবে নিখিল জগৎ
প্রতিদিবসের মতো।
কোথাকার এই শৃঙ্খল-ছেঁড়া
সৃষ্টি-ছাড়া এ ব্যথা
কাঁদিয়া কাঁদিয়া গাহিয়া গাহিয়া,
অজানা আঁধার-সাগর বাহিয়া,
মিশায়ে যাইবে কোথা!
এক রজনীর প্রহরের মাঝে
ফুরাবে সকল কথা।