সংশয়ের আবেগ
ভালোবাস কি না বাস বুঝিতে পারি নে,
তাই কাছে থাকি।
তাই তব মুখপানে রাখিয়াছি মেলি
সর্বগ্রাসী আঁখি।
তাই সারা রাত্রিদিন শ্রান্তি তৃপ্তি-নিদ্রাহীন
করিতেছি পান
যতটুকু হাসি পাই, যতটুকু কথা,
যতটুকু গান।
তাই কভু ফিরে যাই, কভু ফেলি শ্বাস,
কভু ধরি হাত।
কখনো কঠিন কথা, কখনো সোহাগ,
কভু অশ্রুপাত।
তুলি ফুল দেব ব’লে, ফেলে দিই ভূমিতলে
করি’ খান খান।
কখনো আপন মনে আপনার সাথে
করি অভিমান।
জানি যদি ভালোবাস চির-ভালোবাসা
জনমে বিশ্বাস,
যেথা তুমি যেতে বল সেথা যেতে পারি—
ফেলি নে নিশ্বাস।
তরঙ্গিত এ হৃদয় তরঙ্গিত সমুদয়
বিশ্বচরাচর
মুহূর্তে হইবে শান্ত, টলমল প্রাণ
পাইবে নির্ভর।
বাসনার তীব্র জ্বালা দূর হয়ে যাবে,
যাবে অভিমান,
হৃদয়দেবতা হবে, করিব চরণে
পুষ্প-অর্ঘ্য দান।
দিবানিশি অবিরল লয়ে শ্বাস অশ্রুজল
লয়ে হাহুতাশ
চির ক্ষুধাতৃষা লয়ে আঁখির সম্মুখে
করিব না বাস।
তোমার প্রেমের ছায়া আমারে ছাড়ায়ে
পড়িবে জগতে,
মধুর আঁখির আলো পড়িবে সতত
সংসারের পথে।
দূরে যাবে ভয় লাজ, সাধিব আপন কাজ
শত গুণ বলে—
বাড়িবে আমার প্রেম পেয়ে তব প্রেম,
দিব তা সকলে।
নহে তো আঘাত করো কঠোর কঠিন
কেঁদে যাই চলে।
কেড়ে লও বাহু তব, ফিরে লও আঁখি,
প্রেম দাও দলে।
কেন এ সংশয়-ডোরে বাঁধিয়া রেখেছ মোরে,
বহে যায় বেলা।
জীবনের কাজ আছে— প্রেম নহে ফাঁকি,
প্রাণ নহে খেলা।
সন্ধ্যায়
ওগো তুমি, অমনি সন্ধ্যার মতো হও।
সুদূর পশ্চিমাচলে কনক-আকাশতলে
অমনি নিস্তব্ধ চেয়ে রও।
অমনি সুন্দর শান্ত অমনি করুণ কান্ত
অমনি নীরব উদাসিনী,
ওইমতো ধীরে ধীরে আমার জীবনতীরে
বারেক দাঁড়াও একাকিনী।
জগতের পরপারে নিয়ে যাও আপনারে
দিবসনিশার প্রান্তদেশে।
থাক্ হাস্য-উৎসব, না আসুক কলরব
সংসারের জনহীন শেষে।
এস তুমি চুপে চুপে শ্রান্তিরূপে নিদ্রারূপে,
এস তুমি নয়ন-আনত।
এস তুমি ম্লান হেসে দিবাদগ্ধ আয়ুশেষে
মরণের আশ্বাসের মতো।
আমি শুধু চেয়ে থাকি অশ্রুহীন শ্রান্ত-আঁখি,
পড়ে থাকি পৃথিবীর’পরে—
খুলে দাও কেশভার, ঘনস্নিগ্ধ অন্ধকার
মোরে ঢেকে দিক স্তরে স্তরে।
রাখো এ কপালে মম নিদ্রার আবেশ-সম
হিমস্নিগ্ধ করতলখানি।
বাক্যহীন স্নেহভরে অবশ দেহের’পরে
অঞ্চলের প্রান্ত দাও টানি।
তার পরে পলে পলে করুণার অশ্রুজলে
ভরে যাক নয়নপল্লব।
সেই স্তব্ধ আকুলতা গভীর বিদায়ব্যথা
কায়মনে করি অনুভব।
সিন্ধুতরঙ্গ
পুরী-তীর্থযাত্রী তরণীর নিমজ্জন উপলক্ষে
দোলে রে প্রলয় দোলে অকূল সমুদ্র-কোলে,
উৎসব ভীষণ।
শত পক্ষ ঝাপটিয়া বেড়াইছে দাপটিয়া
দুর্দম পবন।
আকাশ সমুদ্র-সাথে প্রচণ্ড মিলনে মাতে,
অখিলের আঁখিপাতে আবরি তিমির।
বিদ্যুৎ চমকে ত্রাসি, হা হা করে ফেনরাশি,
তীক্ষ্ম শ্বেত রুদ্র হাসি জড়-প্রকৃতির।
চক্ষুহীন কর্ণহীন গেহহীন স্নেহহীন
মত্ত দৈত্যগণ
মরিতে ছুটেছে কোথা, ছিঁড়েছে বন্ধন।
হারাইয়া চারি ধার নীলাম্বুধি অন্ধকার
কল্লোলে, ক্রন্দনে,
রোষে, ত্রাসে, ঊর্ধ্বশ্বাসে, অট্টরোলে, অট্টহাসে,
উন্মাদ গর্জনে,
ফাটিয়া ফুটিয়া উঠে, চূর্ণ হয়ে যায় টুটে,
খুঁজিয়া মরিছে ছুটে আপনার কূল—
যেন রে পৃথিবী ফেলি বাসুকী করিছে কেলি
সহস্রৈক ফণা মেলি, আছাড়ি লাঙ্গুল।
যেন রে তরল নিশি টলমলি দশ দিশি
উঠিছে নড়িয়া,
আপন নিদ্রার জাল ফেলিছে ছিঁড়িয়া।
নাই সুর, নাই ছন্দ, অর্থহীন, নিরানন্দ
জড়ের নর্তন।
সহস্র জীবনে বেঁচে ওই কি উঠেছে নেচে
প্রকাণ্ড মরণ?
জল বাষ্প বজ্র বায়ু লভিয়াছে অন্ধ আয়ু,
নূতন জীবনস্নায়ু টানিছে হতাশে,
দিগ্বিদিক নাহি জানে, বাধাবিঘ্ন নাহি মানে
ছুটেছে প্রলয়-পানে আপনারি ত্রাসে;
হেরো, মাঝখানে তারি আট শত নরনারী
বাহু বাঁধি বুকে,
প্রাণে আঁকড়িয়া প্রাণ, চাহিয়া সম্মুখে।
তরণী ধরিয়া ঝাঁকে— রাক্ষসী ঝটিকা হাঁকে,
“দাও, দাও, দাও! ”
সিন্ধু ফেনোচ্ছল ছলে কোটি ঊর্ধ্বকরে বলে,
“দাও, দাও, দাও! ”
বিলম্ব দেখিয়া রোষে ফেনায়ে ফেনায়ে ফোঁষে,
নীল মৃত্যু মহাক্রোশে শ্বেত হয়ে উঠে।
ক্ষুদ্র তরী গুরুভার সহিতে পারে না আর,
লৌহবক্ষ ওই তার যায় বুঝি টুটে।
অধ ঊর্ধ্ব এক হয়ে ক্ষুদ্র এ খেলনা লয়ে
খেলিবারে চায়।
দাঁড়াইয়া কর্ণধার তরীর মাথায়।
নরনারী কম্পমাপ ডাকিতেছে, ভগবান!
হায় ভগবান!
দয়া করো, দয়া করো! উঠিছে কাতর স্বর,
রাখো রাখো প্রাণ!
কোথা সেই পুরাতন রবি শশী তারাগণ
কোথা আপনার ধন ধরণীর কোল!
আজন্মের স্নেহসার কোথা সেই ঘরদ্বার,
পিশাচী এ বিমাতার হিংস্র উতরোল!
যে দিকে ফিরিয়া চাই পরিচিত কিছু নাই,
নাই আপনার—
সহস্র করাল মুখ সহস্র-আকার।
ফেটেছে তরণীতল, সবেগে উঠিছে জল,
সিন্ধু মেলে গ্রাস।
নাই তুমি, ভগবান, নাই দয়া, নাই প্রাণ—
জড়ের বিলাস।
ভয় দেখে ভয় পায়, শিশু কাঁদে উভরায়—
নিদারুণ হায়-হায় থামিল চকিতে।
নিমেষেই ফুরাইল, কখন জীবন ছিল
কখন জীবন গেল নারিল লখিতে।
যেন রে একই ঝড়ে নিবে গেল একত্তরে
শত দীপ আলো,
চকিতে সহস্র গৃহে আনন্দ ফুরালো।
প্রাণহীন এ মত্ততা না জানে পরের ব্যথা,
না জানে আপন।
এর মাঝে কেন রয় ব্যথাভরা স্নেহময়
মানবের মন।
মা কেন রে এইখানে, শিশুচায় তার পানে,
ভাই সে ভায়ের টানে কেন পড়ে বুকে।
মধুর রবির করে কত ভালোবাসা-ভরে
কতদিন খেলা করে কত সুখে দুখে।
কেন করে টলমল দুটি ছোটো অশ্রুজল,
সকরুণ আশা।
দীপশিখাসম কাঁপে ভীত ভালোবাসা।