প্রাণ যাহা চায় তাহা দাও বা না দাও,
তা বলে কি করুণা পাব না?
দুর্লভ ধনের তরে শিশু কাঁদে সকাতরে,
তা বলে কি জননীর বাজে না বেদনা?
দুর্বল মানব-হিয়া বিদীর্ণ যেথায়,
মর্মভেদী যন্ত্রণা বিষম,
জীবন নির্ভরহারা ধুলায় লুটায়ে সারা,
সেথাও কেন গো তব কঠিন নিয়ম।
সেথাও জগৎ তব চিরমৌনী কেন,
নাহি দেয় আশ্বাসের সুখ।
ছিন্ন করি অন্তরাল অসীম রহস্যজাল
কেন না প্রকাশ পায় গুপ্ত স্নেহমুখ!
ধরণী জননী কেন বলিয়া উঠে না
—করুণমর্মর কণ্ঠস্বর—
“আমি শুধু ধূলি নই, বৎস, আমি প্রাণময়ী
জননী, তোদের লাগি অন্তর কাতর।
“নহ তুমি পরিত্যক্ত অনাথ সন্তান
চরাচর নিখিলের মাঝে;
তোমার ব্যাকুল স্বর উঠিছে আকাশ-’পর,
তারায় তারায় তার ব্যথা গিয়ে বাজে।”
কাল ছিল প্রাণ জুড়ে, আজ কাছে নাই—
নিতান্ত সামান্য এ কি নাথ?
তোমার বিচিত্র ভবে কত আছে কত হবে,
কোথাও কি আছে প্রভু, হেন বজ্রপাত?
আছে সেই সূর্যালোক, নাই সেই হাসি—
আছে চাঁদ, নাই চাঁদমুখ।
শূন্য পড়ে আছে গেহ, নাই কেহ, নাই কেহ—
রয়েছে জীবন, নেই জীবনের সুখ।
সেইটুকু মুখখানি, সেই দুটি হাত,
সেই হাসি অধরের ধারে,
সে নহিলে এ জগৎ শুষ্ক মরুভূমিবৎ—
নিতান্ত সামান্য এ কি এ বিশ্বব্যাপারে?
এ আর্তস্বরের কাছে রহিবে অটুট
চৌদিকের চিরনীরবতা?
সমস্ত মানবপ্রাণ বেদনায় কম্পমান
নিয়মের লৌহবক্ষে বাজিবে না ব্যথা!
শেষ উপহার
আমি রাত্রি, তুমি ফুল। যতক্ষণ ছিলে কুঁড়ি
জাগিয়া চাহিয়া ছিনু আঁধার আকাশ জুড়ি
সমস্ত নক্ষত্র নিয়ে, তোমারে লুকায়ে বুকে।
যখন ফুটিলে তুমি সুন্দর-তরুণ-মুখে,
তখনি প্রভাত এল, ফুরালো আমার কাল;
আলোকে ভাঙিয়া গেল রজনীর অন্তরাল।
এখন বিশ্বের তুমি; গুন্ গুন্ মধুকর
চারি দিকে তুলিয়াছে বিস্ময়ব্যাকুল স্বর;
গাহে পাখি, বহে বায়ু; প্রমোদহিল্লোলধারা
নবস্ফুট জীবনেরে করিতেছে দিশাহারা।
এত আলো, এত সুখ, এত গান, এত প্রাণ
ছিল না আমার কাছে— আমি করেছিনু দান
শুধু নিদ্রা, শুধু শান্তি, সযতন নীরবতা,
শুধু চেয়ে-থাকা আঁখি, শুধু মনে মনে কথা।
আর কি দিই নি কিছু? প্রলুব্ধ প্রভাত যবে
চাহিল তোমার পানে, শত পাখি শত রবে
ডাকিল তোমার নাম, তখন পড়িল ঝ’রে
আমার নয়ন হতে তোমার নয়ন-’পরে
একটি শিশিরকণা। চলে গেনু পরপার।
সেই বিষাদের বিন্দু, বিদায়ের উপহার
প্রখর প্রমোদ হতে রাখিবে শীতল ক’রে
তোমার তরুণ মুখ; রজনীর অশ্রু-’পরে
পড়ি প্রভাতের হাসি দিবে শোভা অনুপম,
বিকচ সৌন্দর্য তব করিবে সুন্দরতম।
শ্রান্তি
কত বার মনে করি পূর্ণিমানিশীথে
স্নিগ্ধ সমীরণ,
নিদ্রালস আঁখি-সম ধীরে যদি মুদে আসে
এ শ্রান্ত জীবন।
গগনের অনিমেষ জাগ্রত চাঁদের পানে
মুক্ত দুটি বাতায়নদ্বার—
সুদূরে প্রহর বাজে, গঙ্গা কোথা বহে চলে,
নিদ্রায় সুষুপ্ত দুই পার।
মাঝি গান গেয়ে যায় বৃন্দাবনগাথা
আপনার মনে,
চিরজীবনের স্মৃতি অশ্রু হয়ে গলে আসে
নয়নের কোণে।
স্বপ্নের সুধীর স্রোতে দূরে ভেসে যায় প্রাণ
স্বপ্ন হতে নিঃস্বপ্ন অতলে,
ভাসানো প্রদীপ যথা নিবে গিয়ে সন্ধ্যাবায়ে
ডুবে যায় জাহ্নবীর জলে।
শ্রাবণের পত্র
বন্ধু হে,
পরিপূর্ণ বরষায় আছি তব ভরসায়,
কাজকর্ম করো সায়, এস চট্পট্!
শামলা আঁটিয়া নিত্য তুমি কর ডেপুটিত্ব,
একা প’ড়ে মোর চিত্ত করে ছট্ফট্।
যখন যা সাজে ভাই তখন করিবে তাই,
কালাকাল মানা নাই কলির বিচার!
শ্রাবণে ডেপুটিপনা এ তো কভু নয় সনা—
তন প্রথা, এ যে অনা-সৃষ্টি অনাচার।
ছুটি লয়ে কোনোমতে পোট্মাণ্টো তুলি রথে
সেজেগুজে রেলপথে করো অভিসার।
লয়ে দাড়ি লয়ে হাসি অবতীর্ণ হও আসি,
রুধিয়া জানালা শাসি বসি একবার।
বজ্ররবে সচকিত কাঁপিবে গৃহের ভিত,
পথে শুনি কদাচিৎ চক্র খড়্খড়্।
হা রে রে ইংরাজ-রাজ, এ সাধে হানিলি বাজ—
শুধু কাজ, শুধু কাজ, শুধু ধড়্ফড়্।
আম্লা-শাম্লা-স্রোতে ভাসাইলি এ ভারতে,
যেন নেই ত্রিজগতে হাসি গল্প গান—
নেই বাঁশি, নেই বঁধু, নেই রে যৌবনমধু,
মুছেছে পথিকবধূ সজল নয়ান।
যেন রে শরম টুটে কদম্ব আর না ফুটে,
কেতকী শিহরী উঠে করে না আকুল—
কেবল জগৎটাকে জড়ায়ে সহস্র পাকে
গবর্মেণ্ট পড়ে থাকে বিরাট বিপুল।
বিষম রাক্ষস ওটা, মেলিয়া আপিস-কোটা
গ্রাস করে গোটা গোটা বন্ধুবান্ধবেরে—
বৃহৎ বিদেশে দেশে কে কোথা তলায় শেষে
কোথাকার সর্বনেশে সর্বিসের ফেরে।
এ দিকে বাদর ভরা, নবীন শ্যামল ধরা,
নিশিদিন জল-ঝরা সঘন গগন।
এ দিকে ঘরের কোণে বিরহিণী বাতায়নে,
দিগন্তে তমালবনে নয়ন মগন।
হেঁট মুণ্ড করি হেঁট মিছে কর agitate,
খালি রেখে খালি পেট ভরিছ কাগজ।
এ দিকে যে গোরা মিলে কালা বন্ধু লুটে নিলে,
তার বেলা কী করিলে নাই কোনো খোঁজ।
দেখিছ না আঁখি খুলে ম্যাঞ্চেস্ট্র লিভারপুলে
দেশী শিল্প জলে গুলে করিল Finish।
‘আষাঢ়ে গল্প’ সে কই, সেও বুঝি গেল ওই
আমাদের নিতান্তই দেশের জিনিস।
তুমি আছ কোথা গিয়া, আমি আছি শূন্যহিয়া,
কোথায় বা সে তাকিয়া শোকতাপহরা।
সে তাকিয়া— গল্পগীতি সাহিত্যচর্চার স্মৃতি
কত হাসি কত প্রীতি কত তুলো -ভরা!
কোথায় সে যদুপতি, কোথা মথুরার গতি,
অথ, চিন্তা করি ইতি কুরু মনস্থির—
মায়াময় এ জগৎ নহে সৎ নহে সৎ,
যেন পদ্মপত্রবৎ, তদুপরি নীর।
অতএব ত্বরা ক’রে উত্তর লিখিবে মোরে,
সর্বদা নিকটে ঘোরে কাল সে করাল—
( সুধী তুমি ত্যজি নীর গ্রহণ করিয়ো ক্ষীর )
এই তত্ত্ব এ চিঠির জানিয়ো moral।