মেঘের খেলা
স্বপ্ন যদি হ’ত জাগরণ,
সত্য যদি হ’ত কল্পনা,
তবে এ ভালোবাসা হ’ত না হত-আশা
কেবল কবিতার জল্পনা।
মেঘের খেলা-সম হ’ত সব
মধুর মায়াময় ছায়াময়।
কেবল আনাগোনা, নীরবে জানাশোনা,
জগতে কিছু আর কিছু নয়।
কেবল মেলামেশা গগনে,
সুনীল সাগরের পরপারে
সুদূরে ছায়াগিরি তাহারে ঘিরি ঘিরি
শ্যামল ধরণীর ধারে ধারে।
কখনো ধীরে ধীরে ভেসে যায়,
কখনো মিশে যায় ভাঙিয়া—
কখনো ঘননীল বিজুলি-ঝিলিমিল,
কখনো উষারাগে রাঙিয়া।
যেমন প্রাণপণ বাসনা
তেমনি বাধা তার সুকঠিন—
সকলি লঘু হয়ে কোথায় যেত বয়ে,
ছায়ার মতো হ’ত কায়াহীন।
চাঁদের আলো হ’ত সুখহাস,
অশ্রু শরতের বরষণ।
সাক্ষী করি বিধু মিলন হ’ত মৃদু
কেবল প্রাণে প্রাণে পরশন।
শান্তি পেত এই চিরতৃষা
চিত্ত চঞ্চল সকাতর,
প্রেমের থরে থরে বিরাম জাগিত রে—
দুখের ছায়া মাঝে রবিকর।
মৌন ভাষা
থাক্ থাক্, কাজ নাই, বলিয়ো না কোনো কথা।
চেয়ে দেখি, চলে যাই, মনে মনে গান গাই,
মনে মনে রচি বসে কত সুখ কত ব্যথা।
বিরহী পাখির প্রায় অজানা কানন-ছায়
উড়িয়া বেড়াক সদা হৃদয়ের কাতরতা—
তারে বাঁধিয়ো না ধরে, বলিয়ো না কোনো কথা।
আঁখি দিয়ে যাহা বল সহসা আসিয়া কাছে
সেই ভালো, থাক্ তাই, তার বেশি কাজ নাই—
কথা দিয়ে বল যদি মোহ ভেঙে যায় পাছে।
এত মৃদু, এত আধো, অশ্রুজলে বাধো-বাধো
শরমে সভয়ে ম্লান এমন কি ভাষা আছে?
কথায় বোলো না তাহা আঁখি যাহা বলিয়াছে।
তুমি হয়তো বা পারো আপনারে বুঝাইতে—
মনের সকল ভাষা প্রাণের সকল আশা
পারো তুমি গেঁথে গেঁথে রচিতে মধুর গীতে।
আমি তো জানি নে মোরে, দেখি নাই ভালো করে
মনের সকল কথা পশিয়া আপন চিতে—
কী বুঝিতে কী বুঝেছি, কী বলব কী বলিতে।
তবে থাক্। ওই শোনো, অন্ধকারে শোনা যায়
জলের কল্লোলস্বর পল্লবের মরমর—
বাতাসের দীর্ঘশ্বাস শুনিয়া শিহরে কায়।
আরো ঊর্ধ্বে দেখো চেয়ে অনন্ত আকাশ ছেয়ে
কোটি কোটি মৌন দৃষ্টি তারকায়।
প্রাণপণ দীর্ঘ ভাষা জ্বলিয়া ফুটিতে চায়।
এসো চুপ করে শুনি এই বাণী স্তব্ধতার—
এই অরণ্যের তলে কানাকানি জলে স্থলে,
মনে করি হল বলা ছিল যাহা বলিবার।
হয়তো তোমার ভাবে তুমি এক বুঝে যাবে,
আমার মনের মতো আমি বুঝে যাব আর—
নিশীথের কন্ঠ দিয়ে কথা হবে দুজনার।
মনে করি দুটি তারা জগতের এক ধারে
পাশাপাশি কাছাকাছি তৃষাতুর চেয়ে আছি,
চিনিতেছি চিরযুগ, চিনি নাকো কেহ কারে।
দিবসের কোলাহলে প্রতিদিন যাই চলে,
ফিরে আসি রজনীর ভাষাহীন অন্ধকারে—
বুঝিবার নহে যাহা চাই তাহা বুঝিবারে।
তোমার সাহস আছে, আমার সাহস নাই।
এই-যে শঙ্কিত আলো অন্ধকারে জ্বলে ভালো,
কে বলিতে পারে বলো যাহা চাও এ কি তাই।
তবে ইহা থাক্ দূরে কল্পনার স্বপ্নপুরে,
যার যাহা মনে লয় তাই মনে করে যাই—
এই চির-আবরণ খুলে ফেলে কাজ নাই।
এস তবে বসি হেথা, বলিয়ো না কোনো কথা।
নিশীথের অন্ধকারে ঘিরে দিক দুজনারে,
আমাদের দুজনের জীবনের নীরবতা।
দুজনের কোলে বুকে আঁধারে বাড়ুক সুখে
দুজনের এক শিশু জনমের মনোব্যথা।
তবে আর কাজ নাই, বলিয়ো না কোনো কথা।
শূণ্য হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা
আবার মোরে পাগল করে
দিবে কে?
হৃদয় যেন পাষাণ-হেন
বিরাগ-ভরা বিবেকে।
আবার প্রাণে নূতন টানে
প্রেমের নদী
পাষাণ হতে উছল স্রোতে
বহায় যদি।
আবার দুটি নয়নে লুটি
হৃদয় হরে নিবে কে?
আবার মোরে পাগল করে
দিবে কে?
আবার কবে ধরণী হবে
তরুণা?
কাহার প্রেমে আসিবে নেমে
স্বরগ হতে করুণা?
নিশীথনভে শুনিব কবে
গভীর গান,
যে দিকে চাব দেখিতে পাব
নবীন প্রাণ,
নূতন প্রীতি আনিবে নিতি
কুমারী উষা অরুণা।
আবার কবে ধরণী হবে
তরুণা?
কোথা এ মোর জীবন-ডোর
বাঁধা রে?
প্রেমের ফুল ফুটে’ আকুল
কোথায় কোন্ আঁধারে?
গভীরতম বাসনা মম
কোথায় আছে?
আমার গান আমার প্রাণ
কাহার কাছে?
কোন গগনে মেঘের কোণে
লুকায়ে কোন্ চাঁদা রে?
কোথায় মোর জীবন-ডোর
বাঁধা রে?
অনেক দিন পরানহীন
ধরণী।
বসনাবৃত খাঁচার মতো
তামসঘনবরনী।
নাই সে শাখা, নাই সে পাখা,
নাই সে পাতা,
নাই সে ছবি, নাই সে রবি,
নাই সে গাথা;
জীবন চলে আঁধার জলে
আলোকহীন তরণী।
অনেক দিন পরানহীন
ধরণী।
মায়া-কারায় বিভোর প্রায়
সকলি;
শতেক পাকে জড়ায়ে রাখে
ঘুমের ঘোর শিকলি।
দানব-হেন আছে কে যেন
দুয়ার আঁটি।
কাহার কাছে না জানি আছে
সোনার কাঠি?
পরশ লেগে উঠিবে জেগে
হরষ-রস-কাকলি।
মায়া-কারায় বিভোর-প্রায়
সকলি।
দিবে সে খুলি এ ঘোর ধূলি-
আবরণ।
তাহার হাতে আঁখির পাতে
জগত-জাগা জাগরণ।
সে হাসিখানি আনিবে টানি
সবার হাসি,
গড়িবে গেহ, জাগাবে স্নেহ
জীবনরাশি।
প্রকৃতিবধূ চাহিবে মধু,
পরিবে নব আভরণ।
সে দিবে খুলি এ ঘোর ধূলি-
আবরণ।
পাগল করে দিবে সে মোরে
চাহিয়া,
হৃদয়ে এসে মধুর হেসে
প্রাণের গান গাহিয়া।
আপনা থাকি ভাসিবে আঁখি
আকুল নীরে,
ঝরনা সম জগৎ মম
ঝরিবে শিরে।
তাহার বাণী দিবে গো আনি
সকল বাণী বাহিয়া।
পাগল করে দিবে সে মোরে
চাহিয়া।
শূন্য গৃহে
কে তুমি দিয়েছ স্নেহ মানবহৃদয়ে,
কে তুমি দিয়েছ প্রিয়জন!
বিরহের অন্ধকারে কে তুমি কাঁদাও তারে,
তুমি ও কেন গো সাথে কর না ক্রন্দন!