তবে ভালো করে বলে যাও।
আঁখিতে বাঁশিতে যে কথা ভাষিতে
সে কথা বুঝায়ে দাও।
শুধু কম্পিত সুরে আধো ভাষা পূরে
কেন এসে গান গাও!
ভুল-ভাঙা
বুঝেছি আমার নিশার স্বপন
হয়েছে ভোর।
মালা ছিল, তার ফুলগুলি গেছে,
রয়েছে ডোর।
নেই আর সেই চুপি-চুপি চাওয়া,
ধীরে কাছে এসে ফিরে ফিরে যাওয়া—
চেয়ে আছে আঁখি, নাই ও আঁখিতে
প্রেমের ঘোর।
বাহুলতা শুধু বন্ধনপাশ
বাহুতে মোর।
হাসিটুকু আর পড়ে না তো ধরা
অধরকোণে,
আপনারে আর চাহ না লুকাতে
আপন মনে।
স্বর শুনে আর উতলা হৃদয়
উথলি উঠে না সারা দেহময়,
গান শুনে আর ভাসে না নয়নে
নয়নলোর।
আঁখিজলরেখা ঢাকিতে চাহে না
শরম চোর।
বসন্ত নাহি এ ধরায় আর
আগের মতো,
জ্যোৎস্নাযামিনী যৌবনহারা
জীবনহত।
আর বুঝি কেহ বাজায় না বীণা,
কে জানে কাননে ফুল ফোটে কি না—
কে জানে সে ফুল তোলে কি না কেউ
ভরি আঁচোর।
কে জানে সে ফুলে মালা গাঁথে কি না
সারা প্রহর।
বাঁশি বেজেছিল, ধরা দিনু যেই
থামিল বাঁশি—
এখন কেবল চরণে শিকল
কঠিন ফাঁসি।
মধু নিশা গেছে, স্মৃতি তারি আজ
মর্মে মর্মে হানিতেছে লাজ—
সুখ গেছে, আছে সুখের ছলনা
হৃদয়ে তোর।
প্রেম গেছে, শুধু আছে প্রাণপণ
মিছে আদর।
কতই না জানি জেগেছ রজনী
করুণ দুখে,
সদয় নয়নে চেয়েছ আমার
মলিন মুখে।
পরদুখভার সহে নাকো আর,
লতায়ে পড়িছে দেহ সুকুমার—
তবু আসি আমি পাষাণহৃদয়
বড়ো কঠোর।
ঘুমাও, ঘুমাও, আঁখি ঢুলে আসে
ঘুমে কাতর।
ভুলে
কে আমারে যেন এনেছে ডাকিয়া,
এসেছি ভুলে।
তবু একবার চাও মুখপানে
নয়ন তুলে।
দেখি, ও নয়নে নিমেষের তরে
সেদিনের ছায়া পড়ে কি না পড়ে,
সজল আবেগে আঁখিপাতা দুটি
পড়ে কি ঢুলে।
ক্ষণেকের তরে ভুল ভাঙায়ো না,
এসেছি ভুলে।
বেল-কুঁড়ি দুটি করে ফুটি-ফুটি
অধর খোলা।
মনে পড়ে গেল সেকালের সেই
কুসুম তোলা।
সেই শুকতারা সেই চোখে চায়,
বাতাস কাহারে খুঁজিয়া বেড়ায়,
উষা না ফুটিতে হাসি ফুটে তার
গগনমূলে।
সেদিন যে গেছে ভুলে গেছি, তাই
এসেছি ভুলে।
ব্যথা দিয়ে কবে কথা কয়েছিলে
পড়ে না মনে,
দূরে থেকে কবে ফিরে গিয়েছিলে
নাই স্মরণে।
শুধু মনে পড়ে হাসিমুখখানি,
লাজে বাধো-বাধো সোহাগের বাণী,
মনে পড়ে সেই হৃদয়-উছাস
নয়ন-কূলে।
তুমি যে ভুলেছ ভুলে গেছি, তাই
এসেছি ভুলে।
কাননের ফুল, এরা তো ভোলে নি,
আমরা ভুলি?
সেই তো ফুটেছে পাতায় পাতায়
কামিনীগুলি।
চাঁপা কোথা হতে এনেছে ধরিয়া
অরুণকিরণ কোমল করিয়া,
বকুল ঝরিয়া মরিবারে চায়
কাহার চুলে?
কেহ ভোলে, কেউ ভোলে না যে, তাই
এসেছি ভুলে।
এমন করিয়া কেমনে কাটিবে
মাধবী রাতি?
দখিনে বাতাসে কেহ নেই পাশে
সাথের সাথি।
চারি দিক হতে বাঁশি শোনা যায়,
সুখে আছে যারা তারা গান গায়—
আকুল বাতাসে, মদির সুবাসে,
বিকচ ফুলে,
এখনো কি কেঁদে চাহিবে না কেউ
আসিলে ভুলে?
ভৈরবী গান
ওগো, কে তুমি বসিয়া উদাসমুরতি
বিষাদশান্ত শোভাতে!
ওই ভৈরবী আর গেয়ো নাকো এই
প্রভাতে—
মোর গৃহছাড়া এই পথিক-পরান
তরুণ হৃদয় লোভাতে।
ওই মন-উদাসীন ওই আশাহীন
ওই ভাষাহীন কাকলি
দেয় ব্যাকুল পরশে সকল জীবন
বিকলি।
দেয় চরণে বাঁধিয়া প্রেমবাহু-ঘেরা
অশ্রুকোমল শিকলি।
হায়, মিছে মনে হয় জীবনের ব্রত
মিছে মনে হয় সকলি।
যারে ফেলিয়া এসেছি, মনে করি, তারে
ফিরে দেখে আসি শেষ বার।
ওই কাঁদিছে সে যেন এলায়ে আকুল
কেশভার।
যারা গৃহছায়ে বসি সজলনয়ন
মুখ মনে পড়ে সে সবার।
এই সংকটময় কর্মজীবন
মনে হয় মরু সাহারা,
দূরে মায়াময় পুরে দিতেছে দৈত্য
পাহারা।
তবে ফিরে যাওয়া ভালো তাহাদের পাশে
পথ চেয়ে আছে যাহারা।
সেই ছায়াতে বসিয়া সারা দিনমান
তরুমর্মর পবনে,
সেই মুকুল-আকুল বকুলকুঞ্জ-
ভবনে,
সেই কুহুকুহরিত বিরহরোদন
থেকে থেকে পশে শ্রবণে।
সেই চিরকলতান উদার গঙ্গা
বহিছে আঁধারে আলোকে,
সেই তীরে চিরদিন খেলিছে বালিকা-
বালকে।
ধীরে সারা দেহ যেন মুদিয়া আসিছে
স্বপ্নপাখির পালকে।
হায়, অতৃপ্ত যত মহৎ বাসনা
গোপনমর্মদাহিনী,
এই আপনা-মাঝারে শুষ্ক জীবন—
বাহিনী!
ওই ভৈরবী দিয়া গাঁথিয়া গাঁথিয়া
রচিব নিরাশাকাহিনী
সদা করুণ কন্ঠ কাঁদিয়া গাহিবে—
‘হল না, কিছুই হবে না।
এই মায়াময় ভবে চিরদিন কিছু
রবে না।
কেহ জীবনের যত গুরুভার ব্রত
ধুলি হতে তুলি লবে না।
‘এই সংশয়মাঝে কোন্ পথে যাই,
কার তরে মরি খাটিয়া!
আমি কার মিছে দুখে মরিতেছি বুক
ফাটিয়া!
ভবে সত্য মিথ্যা কে করেছে ভাগ,
কে রেখেছে মত আঁটিয়া!
‘যদি কাজ নিতে হয়, কত কাজ আছে,
একা কি পারিব করিতে!
কাঁদে শিশিরবিন্দু জগতের তৃষা
হরিতে!
কেন অকূল সাগরে জীবন সঁপিব
একেলা জীর্ণ তরীতে!
‘শেষে দেখিব, পড়িল সুখযৌবন
ফুলের মতন খসিয়া,
হায় বসন্তবায়ু মিছে চলে গেল
শ্বসিয়া,
সেই যেখানে জগৎ ছিল এক কালে
সেইখানে আছে বসিয়া!
‘শুধু আমারি জীবন মরিল ঝুরিয়া
চিরজীবনের তিয়াষে।
এই দগ্ধ হৃদয় এত দিন আছে
কী আশে!
সেই ডাগর নয়ন, সরস অধর
গেল চলি কোথা দিয়া সে!’
ওগো, থামো, যারে তুমি বিদায় দিয়েছ
তারে আর ফিরে চেয়ো না।
ওই অশ্রুসজল ভৈরবী আর
গেয়ো না।
আজি প্রথম প্রভাতে চলিবার পথ
নয়নবাষ্পে ছেয়ো না।