সংহিতা আর মুর্গি -জবাই
এই দুটো কাজে লেগেছি সবাই,
বিশেষত এই আমরা ক’ভাই
নিমাই নেপাল ভূতো।
দেশের লোকের কানের গোড়াতে
বিদ্যেটা নিয়ে লাটিম ঘোরাতে,
বক্তৃতা আর কাগজ পোরাতে
শিখেছি হাজার ছুতো।
ম্যারাথন আর ধর্মপলিতে
কী যে হয়েছিল বলিতে বলিতে
শিরায় শোণিত রহে গো জ্বলিতে
পাটের পলিতে-সম।
মূর্খ যাহারা কিছু পড়ে নাই
তারা এত কথা কী বুঝিবে ছাই—
হাঁ করিয়া থাকে, কভু তোলে হাই—
বুক ফেটে যায় মম।
আগাগোড়া যদি তাহারা পড়িত
গারিবাল্ডির জীবনচরিত
না জানি তা হলে কী তারা করিত
কেদারায় দিয়ে ঠেস!
মিল ক’রে ক’রে কবিতা লিখিত,
দু-চারটে কথা বলিতে শিখিত,
কিছুদিন তবু কাগজ টিকিত
উন্নত হত দেশ।
না জানিল তারা সাহিত্যরস,
ইতিহাস নাহি করিল পরশ,
ওয়াশিংটনের জন্ম-বরষ
মুখস্থ হল নাকো।
ম্যাট্সিনি-লীলা এমন সরেস
এরা সে কথার না জানিল লেশ—
হা অশিক্ষিত অভাগা স্বদেশ,
লজ্জায় মুখ ঢাকো।
আমি দেখো ঘরে চৌকি টানিয়ে
লাইব্রেরি হতে হিস্ট্রি আনিয়ে
কত পড়ি, লিখি বানিয়ে বানিয়ে
শানিয়ে শানিয়ে ভাষা।
জলে ওঠে প্রাণ, মরি পাখা করে,
উদ্দীপনায় শুধু মাথা ঘোরে—
তবুও যা হোক স্বদেশের তরে
একটুকু হয় আশা।
যাক, পড়া যাক ‘ন্যাস্বি’ সমর—
আহা, ক্রমোয়েল, তুমিই অমর।
থাক্ এইখেনে, ব্যথিছে কোমর—
কাহিল হতেছে বোধ।
ঝি কোথায় গেল, নিয়ে আয় সাবু।
আরে, আরে এসো! এসো ননিবাবু,
তাস পেড়ে নিয়ে খেলা যাক গ্রাবু—
কালকের দেব শোধ!
বধূ
‘বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্ !’—
পুরানো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে,
কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল!
কোথা সে বাঁধা ঘাট, অশথতল!
ছিলাম আনমনে একেলা গৃহকোণে,
কে যেন ডাকিল রে ‘জলকে চল্’।
কলসী লয়ে কাঁখে— পথ সে বাঁকা,
বামেতে মাঠ শুধু সদাই করে ধূ ধূ ,
ডাহিনে বাঁশবন হেলায়ে শাখা।
দিঘির কালো জলে সাঁঝের আলো ঝলে,
দু ধারে ঘন বন ছায়ায় ঢাকা।
গভীর থির নীরে ভাসিয়া যাই ধীরে,
পিক কুহরে তীরে অমিয়-মাখা।
পথে আসিতে ফিরে, আঁধার তরুশিরে
সহসা দেখি চাঁদ আকাশে আঁকা।
অশথ উঠিয়াছে প্রাচীর টুটি,
সেখানে ছুটিতাম সকালে উঠি।
শরতে ধরাতল শিশিরে ঝলমল,
করবী থোলো থোলো রয়েছে ফুটি।
প্রাচীর বেয়ে বেয়ে সবুজে ফেলে ছেয়ে
বেগুনি-ফুলে-ভরা লতিকা দুটি।
ফাটলে দিয়ে আঁখি আড়ালে বসে থাকি,
আঁচল পদতলে পড়েছে লুটি।
মাঠের পরে মাঠ, মাঠের শেষে
সুদূর গ্রামখানি আকাশে মেশে।
এ ধারে পুরাতন শ্যামল তালবন
সঘন সারি দিয়ে দাঁড়ায় ঘেঁষে।
বাঁধের জলরেখা ঝলসে যায় দেখা,
জটলা করে তীরে রাখাল এসে।
চলেছে পথখানি কোথায় নাহি জানি,
কে জানে কত শত নূতন দেশে।
হায় রে রাজধানী পাষাণকায়া!
বিরাট মুঠিতলে চাপিছে দৃঢ়বলে
ব্যাকুল বালিকারে, নাহিকো মায়া!
কোথা সে খোলা মাঠ, উদার পথঘাট,
পাখির গান কই, বনের ছায়া!
কে যেন চারি দিকে দাঁড়িয়ে আছে,
খুলিতে নারি মন শুনিবে পাছে!
হেথায় বৃথা কাঁদা, দেয়ালে পেয়ে বাধা
কাঁদন ফিরে আসে আপন-কাছে।
আমার আঁখিজল কেহ না বোঝে,
অবাক্ হয়ে সবে কারণ খোঁজে।
‘কিছুতে নাহি তোষ, এ তো বিষম দোষ
গ্রাম্য বালিকার স্বভাব ও যে !
স্বজন প্রতিবেশী এত যে মেশামেশি,
ও কেন কোণে বসে নয়ন বোজে? ‘
কেহ বা দেখে মুখ কেহ বা দেহ—
কেহ বা ভালো বলে, বলে না কেহ।
ফুলের মালাগাছি বিকাতে আসিয়াছি,
পরখ করে সবে, করে না স্নেহ।
সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা।
কেমন করে কাটে সারাটা বেলা!
ইঁটের’পরে ইঁট, মাঝে মানুষ-কীট—
নাইকো ভালোবাসা, নাইকো খেলা।
কোথায় আছ তুমি কোথায় মা গো !
কেমনে ভুলে তুই আছিস হাঁ গো !
উঠিলে নব শশী ছাদের ’পরে বসি
আর কি রূপকথা বলিবি না গো!
হৃদয়বেদনায় শূন্য বিছানায়
বুঝি মা, আঁখিজলে রজনী জাগো !
কুসুম তুলি লয়ে প্রভাতে শিবালয়ে
প্রবাসী তনয়ার কুশল মাগো।
হেথাও ওঠে চাঁদ ছাদের পারে,
প্রবেশ মাগে আলো ঘরের দ্বারে।
আমারে খুঁজিতে সে ফিরিছে দেশে দেশে,
যেন সে ভালোবেসে চাহে আমারে।
নিমেষতরে তাই আপনা ভুলি
ব্যাকুল ছুটে যাই দুয়ার খুলি।
অমনি চারি ধারে নয়ন উঁকি মারে,
শাসন ছুটে আসে ঝটিকা তুলি।
দেবে না ভালোবাসা, দেবে না আলো।
সদাই মনে হয় আঁধার ছায়াময়
দিঘির সেই জল শীতল কালো,
তাহারি কোলে গিয়ে মরণ ভালো।
ডাক্ লো ডাক্ তোরা, বল্ লো বল্—
‘বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্।’
কবে পড়িবে বেলা, ফুরাবে সব খেলা,
নিবাবে সব জ্বালা শীতল জল,
জানিস যদি কেহ আমায় বল্।
বর্ষার দিনে
এমন দিনে তারে বলা যায়,
এমন ঘনঘোর বরিষায়!
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী,
আকাশে জল ঝরে অনিবার।
জগতে কেহ যেন নাহি আর।
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব।
আঁধারে মিশে গেছে আর সব।
বলিতে বাজিবে না নিজ কানে,
চমক লাগিবে না নিজ প্রাণে।
সে কথা আঁখিনীরে মিশিয়া যাবে ধীরে
এ ভরা বাদলের মাঝখানে।
সে কথা মিশে যাবে দুটি প্রাণে।
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার?
শ্রাবণবরিষনে একদা গৃহকোণে
দু কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার?